মানবদেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ কলব। মানবদেহকে মূলত পরিচালনা করে কলব। মহানবী সা: বলেছেন- মানবদেহে একটি গোশতের টুকরা আছে তা সুস্থ থাকলে সমস্ত দেহে সুস্থ থাকে, আর তা অসুস্থ হলে সমস্ত দেহ অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার নাম ‘কলব’। (সহিহ বুখারি ও মুসলিম) মানবজাতির নানাবিধ পাপের কারণে তা অসুস্থ হয়ে পড়ে। মহানবী সা: বলেছেন- ব্যক্তি একটি গুনাহ করলে তার কলবে একটি কালো দাগ পড়ে যায়, যদি সে তাওবাহ করে, তবে কলব পরিষ্কার হয়ে যায়। (তিরমিজি : ৩৩৩৪) আরো ইরশাদ করেন- যদি ব্যক্তি সত্য কথা বলে, তবে তার কলবে একটি শুভ্র দাগ পড়ে যায়, আর যদি মিথ্যা কথা বলে, তবে তার কলবে একটি কালো দাগ পড়ে যায়। (কুরতুবি প্রথম খণ্ড, পৃ: ১৬১) আল্লাহ তায়ালা বলেন, কখনো নয় এদের অন্তরে এদের কৃতকর্মই মরিচা ধরিয়েছে। (সূরা মুতাফফিফিন-১৪)
কলবের ব্যাধি : কলবকে পরিচ্ছন্ন ও কলুষমুক্ত রাখতে হলে যেসব ব্যাধি কলবকে অসুস্থ ও কলুষিত করে সেসব বিষয় জানা আবশ্যক। কলবের ব্যাধিগুলো হলো-
শিরক : আল্লাহ তায়ালার সাথে শিরক করা, চাই তা সূক্ষ্ম বা বৃহৎ হোক, ছোট হোক কিংবা বড় হোক তা কলবকে ধ্বংস করে দেয়। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- যারা ঈমান এনেছে এবং নিজেদের ঈমানকে জুলম তথা শিরকের সাথে সংমিশ্রিত করেনি তারাই (প্রকৃত) শান্তি ও নিরাপত্তার অধিকারী এবং তারাই সঠিক পথে পরিচালিত। (সূরা আনআম-৮২)
বিদয়াত : যে কাজ মহানবী সা:, সাহাবায়ে কিরাম, তাবেয়ি ও তাবে তাবেয়িদের যুগে ছিল না, এমন কাজ সাওয়াবের নিয়তে দ্বীনের মধ্যে অনুপ্রবেশ করানোর নাম বিদআত। বিদআত এমন মন্দ কাজ যা বিদআতিকে আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং কলবকে নষ্ট করে দেয়। মহানবী সা: বলেছেন- কোনো জাতি যখনই কোনো বিদআতের উদ্ভাবন করে তখন ওই পরিমাণ সুন্নাত অন্তর্হিত হয়ে যায়। সুতরাং কোনো বিদআত উদ্ভাবন না করে সুন্নাত আঁকড়ে ধরে থাকার মধ্যেই কল্যাণ নিহিত রয়েছে। (আহমদ, মিশকাত পৃ:-৩১)
নিফাক : নিফাক হলো মুখে একরকম প্রকাশ করা, আর অন্তরে অন্যরকম লালন করা। বাহ্যিকভাবে ইসলাম ও মুসলমানের সাথে সম্পর্ক রাখা; কিন্তু গোপনীয়ভাবে ইসলামের শত্রুদের সাথে সম্পর্ক রাখা। মহানবী সা: বলেছেন, মুনাফিকের আলামত তিনটি। কথা বললে মিথ্যা বলে, অঙ্গীকার করলে ভঙ্গ করে, আমানত রাখলে খিয়ানত করে। (বুখারি) অপর হাদিসে রয়েছে- মুনাফিকের স্বভাব চারটি, চতুর্থটি হলো- ঝগড়ার সময় গালাগালি করা। মুনাফিকি আচরণ ঈমানের আলোকে নির্বাপিত করে দেয়।
প্রবৃত্তির অনুসরণ : প্রবৃত্তির অনুসরণ ঈমানকে ধ্বংস করে দেয়। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- (হে রাসূল সা:!) আপনি কি লক্ষ করেছেন তাকে, যে তার খেয়াল খুশিকে নিজের মা’বুদ বানিয়ে নিয়েছে? আল্লাহ জেনে শুনেই তাকে বিভ্রান্ত করেছেন এবং তর কর্ণ ও হৃদয়ে মোহর করে দিয়েছেন এবং তার চক্ষুর উপর রেখেছেন আবরণ। অতঃপর, আল্লাহর পর কে তাকে পথনির্দেশ করবে? তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না? (সূরা জাসিয়াহ-২৩)
সংশয় ও সন্দেহ : সংশয় ও সন্দেহ এমন এক ব্যাধি যা অন্তরকে সত্য গ্রহণ থেকে অন্ধ করে দেয় এবং ব্যক্তিকে পথভ্রষ্ট করে দেয়। ফলে ব্যক্তি ঈমানের স্বাদ পায় না এবং কুরআন ও হাদিস থেকে উপকৃত হতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- অতএব যাদের অন্তরে বক্রতা রয়েছে ফলত তারাই অশান্তি সৃষ্টি ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যে অস্পষ্ট আয়াতের অনুসরণ করে। (সূরা আল ইমরান-৭)
অন্যমনস্কতা : অবহেলা, গাফিলতি বা অন্যমনস্কতা অধিকাংশ অন্যায় ও অপকর্মের প্রধান কারণ। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- আর প্রকৃতপক্ষে অনেক লোক আমার উপদেশাবলি হতে উদাসীন রয়েছে। (সূরা ইউনুস-৯২)। অন্যত্র ইরশাদ করেন- আর (হে নবী!) আপনি (এ ব্যাপারে) গাফিল ও উদাসীন হবেন না। (সূরা আরাফ-২০৫)
কলবের ব্যাধির প্রতিকার : কলবের ব্যাধির প্রতিকার আটটি।
কুরআন মাজিদ : কুরআন মাজিদ নাজিল হয়েছে মানবজাতির জন্য উপদেশ ও অন্তরের ব্যাধির চিকিংসা হিসেবে আর মু’মিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমত হিসেবে। তিনি ইরশাদ করেন- হে মানবজাতি! তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে এমন এক বস্তু সমাগত হয়েছে, যা নসিহত এবং অন্তরগুলোর সব রোগের আরোগ্যকারী, আর মু’মিনদের জন্য পথপ্রদর্শক ও রহমতস্বরূপ। (সূরা ইউনুস-৫৭)
আল্লাহর ভালোবাসা : আল্লাহর ভালোবাসা অন্তরের ব্যাধির মহৌষধ। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- আর মানবমণ্ডলীর মধ্যে এরূপ আছে যারা আল্লাহ ব্যতীত অপরকে সদৃশ বা শরিক সাব্যস্ত করে, আল্লাহকে ভালোবাসার মতো তারা তাদেরকে ভালোবাসে। আর যারা মু’মিন তাদের কাছে আল্লাহর ভালোবাসা খুবই প্রবল। (সূরা বাকারা-১৬৫)
আল্লাহর জিকির : অন্তরে ব্যাধি দূর করার জন্য অন্যতম মাধ্যম হলো- আল্লাহর জিকির। তাই আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- হে মু’মিনরা! তোমরা আল্লাহকে অধিক স্মরণ করো। (সূরা আহজাব-৪১) ইরশাদ করেন- আল্লাহর স্মরণেই চিত্ত প্রশান্ত হয়। (সূরা রা’দ-২৮) আরো ইরশাদ করেন- সেই সফলকাম হবে যে নিজেকে পবিত্র করে। (সূরায়ে শামস্-৯)
খালিস তাওবাহ : অন্তরের ব্যাধি দূর করার বিশেষ মাধ্যম হলো- খাঁটি তাওবাহ করা এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া। রাসূল সা: বলেছেন, অন্যমনস্কতা আমার অন্তরকে ঢেকে নেয়। তাই আমি দিনে আল্লাহর কাছে এক শতবার ইস্তেগফার করি। (আহমাদ-১৮০০২)
দোয়া : দোয়া ও প্রার্থনা করা অন্তরের ব্যাধি দূর করার বিশেষ অস্ত্র। চোখের পানি ফেলে দোয়া করলে তার কোনো গুনাহ থাকে না এবং তার অন্তরও পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ সা: দোয়ায় বলতেন- হে অন্তরের পরিবর্তনকারী! আমাদের অন্তরকে তোমার আনুগত্যের দিকে পরিবর্তন করো। (মুসলিম)
পরকালকে স্মরণ করা : আখেরাত সম্পর্কে গাফেল থাকা কল্যাণ এবং নেকির কাজে প্রতিবন্ধতা সৃষ্টি করে এবং অন্যায় ও ফিতনাকে আকর্ষণ করে। এ জন্য মহানবী সা: বলেছেন- তোমরা কবর জিয়ারত করো। কারণ কবর জিয়ারত তোমাদেরকে মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। (মুসলিম-৮৭৬)
নবী-রাসূল ও অলিদের জীবনী পাঠ : নবী-রাসূল, শহীদ, সালেহীন ও অন্যান্য আল্লাহর অলির জীবনী, কিসসা, ঘটনা ইত্যাদি পাঠ অন্তরকে স্থির রাখে এবং অন্তরকে সঠিকতা ও সৎকর্মশীলতার উত্তরাধিকারী বানায়।
সৎ লোকদের সাহচর্য লাভ : অন্তর পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন রাখার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হলো উত্তম, সৎ ও নেককার ব্যক্তিদের সাহচর্য ও সংশ্রব লাভ করা। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- (হে হাবিব!) নিজেকে রাখবে তাদের সাথে যারা সকাল ও সন্ধ্যায় আহ্বান করে তাদের প্রতিপালককে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে। (সূরা কাহাফ-২৮) আরো ইরশাদ করেন- হে মু’মিনরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সাথী হও (সূরা তাওবাহ-১১৯)। মহানবী সা: বলেন- ব্যক্তি তার বন্ধুর দ্বীনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকে, কাজেই তোমরা যারা বন্ধু গ্রহণ করবে, পর্যবেক্ষণ করে যেন বন্ধু গ্রহণ করে। (মুসনাদ আহমাদ)
লেখক :
প্রধান ফকিহ, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী