হজরত লুত আ:-এর জাতির ধ্বংসের কারণ ছিল ‘সমকামিতা’। তারা পুরুষদের দ্বারা কামপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করত। তাদের সংশোধনের জন্য আল্লাহ তায়ালা হজরত লুত আ:-কে তাদের মধ্যে প্রেরণ করেন। হজরত লুত আ: ছিলেন হজরত ইবরাহিম আ:-এর ভাইপো। তিনি চাচার সাথে ইরাক থেকে বের হন এবং কিছুকাল সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও মিসর সফর করে দাওয়াতের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। অতঃপর স্বতন্ত্রভাবে রিসালাতের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়ে এ পথভ্রষ্ট জাতিটির সংস্কার ও সংশোধনের দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত হন। বর্তমান যে এলাকাটি ট্রান্স জর্দান বলা হয় সেখানেই ছিল এ জাতিটির বাস। মৃত সাগরের নিকটবর্তী কোথাও এর অবস্থান ছিল। এ এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মানুষকে মুগ্ধ ও বিমোহিত করত; কিন্তু এ জাতির নাম-নিশানা দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এমনকি তাদের জনপদগুলো কোথায় কোথায় অবস্থিত ছিল তাও আজ সঠিকভাবে জানা যায় না। মৃত সাগরই তাদের একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে টিকে আছে। বর্তমানে এটি লুত সাগর নামে পরিচিত। আল কুরআনে তাদের ঘৃণ্য কাজের বর্ণনা পাওয়া যায়।
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আর লুতকে আমি পয়গম্বর করে পাঠাই। তারপর স্মরণ করো, যখন সে নিজের সম্প্রদায়ের লোকদের বলল, তোমরা কি এতই নিলর্জ্জ হয়ে গেলে যে, দুনিয়ার ইতঃপূর্বে কেউ কখনো করেনি এমন অশ্লীল কাজ করে চলেছো। তোমরা মেয়েদের বাদ দিয়ে পুরুষদের দ্বারা কামপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করছো? প্রকৃতপক্ষে তোমরা একেবারেই সীমালঙ্ঘনকারী গোষ্ঠী। কিন্তু তার সম্প্রদায়ের জবাব- এ ছাড়া আর কিছুই ছিল না যে, এদেরকে তোমাদের জনপদ থেকে বের করে দাও। এরা বড়ই পবিত্রতার ধ্বজাধারী হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আমি লুতের স্ত্রীকে ছাড়া যে পেছনে অবস্থানকারীদের অনুসারী ছিল তাকে ও তার পরিবার পরিবারবর্গকে উদ্ধার করে নিয়ে আসি এবং এ সম্প্রদায়ের ওপর বৃষ্টি বর্ষণ করি। তারপর সেই অপরাধীদের কী পরিণতি হয়েছিল দেখো।’ (সূরা আরাফ : ৮০-৮৪)
সমকামিতার এ ঘৃণ্য অপকর্মটির বদৌলতে এ জাতি যদিও দুনিয়ার বুকে চিরদিনই ধিক্কার ও কুখ্যাতি কুড়িয়েছে; কিন্তু অসৎ ও দুষ্কর্মশীল লোকেরা এ অপকর্মটি থেকে কখনো বিরত থাকেনি। বর্তমান আধুনিক ইউরোপের শাসকরা এ জঘন্য অপরাধটিকে উৎকৃষ্ট নৈতিক গুণের পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করছে। ইউরোপের দেশে দেশে এর সপক্ষে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়েছে। এমনকি কোনো কোনো দেশের পার্লামেন্টে একে রীতিমতো বৈধ গণ্য করে আইনও প্রণয়ন করেছে। অথচ সমকামিতা যে সম্পূর্ণ প্রকৃতিবিরোধী এ কথা একটি অকাট্য সত্য। আামাদের দেশের কিছু বিকৃত স্বভাবের ব্যক্তি ও গোষ্ঠী এই অপকর্মটি আমদানি করার চেষ্টা করছে। এর প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে- আমাদের পরিবার ও সমাজব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়া।
উপরের আয়াত থেকে জানা যায়, লুত জাতির লোকগুলো কেবল নির্লজ্জ, দুষ্কৃতকারী ও দুশ্চরিত্রই ছিল না; বরং তারা নৈতিক অধঃপতনের এমন চরমে পৌঁছে গিয়েছিল যে, নিজেদের মধ্যে কিছু সৎ ব্যক্তির ও সৎকর্মের দিকে আহ্বানকারী এবং অসৎকর্মের সমালোচনাকারীর অস্তিত্ব পর্যন্ত সহ্য করতেও প্রস্তুত ছিল না। তারা অসৎকর্মের মধ্যে এতদূর ডুবে গিয়েছিল যে, সংশোধনের সামান্যতম আওয়াজও ছিল তাদের সহ্যের বাইরে। তাদের জঘন্যতম পরিবেশে পবিত্রতার যে সামান্যতম উপাদান অবশিষ্ট থেকে গিয়েছিল তাকেও তারা উৎখাত করতে চাইছিল। এ ধরনের একটি চূড়ান্ততম পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ার পর আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদেরকে উৎখাত করার সিদ্ধান্ত হয়। কারণ যে জাতির সমাজজীবনে পবিত্রতার সামান্যতম উপাদানও অবশিষ্ট থাকে না তাকে পৃথিবীর বুকে বাঁচিয়ে রাখার কোনো কারণই থাকতে পারে না। পচা ফলের ঝুড়িতে যতক্ষণ কয়েকটি ভালো ফল থাকে ততক্ষণ ঝুড়িটি যতেœর সাথে রেখে দেয়া যেতে পারে; কিন্তু এ ভালো ফলগুলো ঝুড়ি থেকে বের করে নেয়ার পর এই ঝুড়িটি যতেœর সাথে সংরক্ষিত করে রাখার পরিবর্তে পথের ধারে আবর্জনার স্তূপে নিক্ষেপ করারই যোগ্য হয়ে পড়ে।
আল্লাহ তায়ালা এ জাতির ধ্বংসকাজ সমাধানের জন্য হজরত লুত আ:-এর কাছে ফেরেশতা পাঠান। তারা সুন্দর ছেলেদের ছদ্মাবেশে লুতের গৃহে এসেছিলেন। তারা যে ফেরেশতা এ কথা লুত আ: জানতেন না। এ কারণে এ মেহমানদের আগমনে তিনি খুববেশি মানসিক উৎকণ্ঠা অনুভব করছিলেন এবং তাঁর মনও সঙ্কুচিত হয়ে গিয়েছিল। তিনি নিজের সম্প্রদায়কে জানতেন। তারা কেমন ব্যভিচারী এবং কী পর্যায়ের নির্লজ্জ হয়ে গেছে তা তাঁর জানা ছিল। আল্লাহ তায়াল বলেন- ‘আর যখন আমার ফেরেশতারা লুতের কাছে পৌঁছে গেল তখন তাদের আগমনে সে খুব ঘাবড়ে গেল এবং ভয়ে জড়সড় হয়ে গেল। সে বলতে লাগল, আজ বড় বিপদের দিন।’ (সূরা হুদ-৭৭) মূলত লুত আ: তাঁর জাতির লাম্পট্যের ভয়ে জড়সড় হয়ে পড়েছিলেন।
তারা স্বভাব-প্রকৃতি ও পবিত্রতার পথ পরিহার করে পূতিগন্ধময় প্রকৃতিবিরোধী পথে চলতে শুরু করেছিল। তাই তারা মেহমানদের আগমন খবর পেয়ে লুত আ:-এর বাড়িতে হামলে পড়ে। হজরত লুত আ: তাদেরকে হীন কাজ পরিহার করে মেয়েদেরকে পবিত্রভাবে কাম চরিতাত্রের পরামর্শ দিলেন। কিন্তু তারা তাঁর কথায় কর্ণপাত করেনি। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তারা জবাব দিলো- তুমি তো জানোই, তোমার মেয়েদের দিয়ে আমাদের কোনো কাজ নেই এবং আমরা কী চাই তাও তুমি জানো।’ (সূরা হুদ-৭৯) মহান আল্লাহ তায়ালা শুধু সন্তান উৎপাদন ও বংশরক্ষার উদ্দেশ্যেই সব প্রাণীর মধ্যে নর-নারীর পার্থক্য সৃষ্টি করে রেখেছেন। আর মানবজাতির মধ্যে এ বিভিন্নতার আরেকটি বাড়তি উদ্দেশ্য হচ্ছে নর ও নারী মিলে একেকটি পরিবারের জন্ম দেবে এবং তার মাধ্যমে সমাজ-সভ্যতা-সংস্কৃতির ভিত গড়ে উঠবে। এ উদ্দেশ্যেই নারী ও পুরুষের দু’টি পৃথক লিঙ্গের সৃষ্টি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে যৌন আকর্ষণ সৃষ্টি করা হয়েছে। পারস্পরিক দাম্পত্য উদ্দেশ্য পূর্ণ করার উপযোগী করে তাদের শারীরিক ও মানসিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। তাদের পারস্পরিক আকর্ষণ ও মিলনের মধ্যে এমন একটি আনন্দমধুর স্বাদ রাখা হয়েছে যা প্রকৃতির উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্য একই সাথে আকর্ষণকারী ও আহ্বায়কের কাজ করে এবং এ সাথে তাদেরকে দান করে এ কাজের প্রতিদানও।
কিন্তু যে ব্যক্তি প্রকৃতির এ পরিকল্পনার বিরুদ্ধাচরণ করে সমকামিতা বা সমমৈথুনের মাধ্যমে যৌন আনন্দ লাভ করে সে একই সাথে কয়েকটি অপরাধ করে। প্রথমত, সে নিজের এবং নিজের স্বাভাবিক দৈহিক ও মানসিক কাঠামোর সাথে যুদ্ধ করে এবং তার মধ্যে বিরাট বিপর্যয় সৃষ্টি করে। এর ফলে তাদের উভয়ের দেহ, মন ও নৈতিক বৃত্তির ওপর অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। দ্বিতীয়ত, সে প্রকৃতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। কারণ প্রকৃতি তাকে যে আনন্দ স্বাদ মানবজাতির ও মানসিক সংস্কৃতির সেবায় প্রতিদান হিসেবে দিয়েছিল এবং যা অর্জন করাকে তার দায়িত্ব, কর্তব্য ও অধিকারের সাথে শর্তযুক্ত করেছিল, সেই স্বাদ ও আনন্দ সে কোনো প্রকার সেবামূলক কার্যক্রম, কর্তব্য পালন, অধিকার আদায় ও দায়িত্ব সম্পাদন ছাড়াই ভোগ করে। তৃতীয়ত, সে মানবসমাজের সাথে প্রকাশ্যে বিশ্বাসঘাতকতা করে। কারণ সমাজে যেসব তামাদ্দুনিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে সেগুলোকে সে ব্যবহার করে এবং তার সাহায্যে লাভবান হয়। কিন্তু যখন তার নিজের দেয়ার পালা আসে তখন অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্যের বোঝা বহন করার পরিবর্তে সে নিজের পুরো শক্তিকে নিরেট স্বার্থপরতার সাথে এমনভাবে ব্যবহার করে যা সামাজিক সংস্কৃত ও নৈতিকতার জন্য কেবল অপ্রয়োজনীয় ও অলাভজনকই হয় নয়; বরং নিদারুণভাবে ক্ষতিকরও হয়। সে নিজেকে বংশ ও পরিবারের সেবায় অযোগ্য করে তোলে। নিজের সাথে অন্ততপক্ষে একজন পুরুষকে নারীসুলভ আচরণে লিপ্ত করে। আর এই সাথে কমপক্ষে দু’টি মেয়ের জন্য যৌনভ্রষ্টতা ও নৈতিক অধঃপতনের দরজা উন্মুক্ত করে দেয়।
আল কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বলা হয়েছে যে, লুত জাতি একটি অতি জঘন্য ও নোংরা পাপকাজের অনুশীলন করে যাচ্ছিল এবং এ ধরনের খারাপ কাজের পরিণামে এ জাতির ওপর আল্লাহর গজব নেমে আসে। এ সম্প্রদায়ের ওপর বৃষ্টি মানে পাথর বৃষ্টি নেমে এসেছিল। কুরআনের অন্যান্য স্থানে এ কথাটি সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে। তা ছাড়া কুরআনে এ কথাও বলা হয়েছে হয়েছে যে, তাদের জনপদকে উল্টিয়ে দিয়ে তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তারপর যখন আমার ফয়সালার সময় এসে গেল, আমি গোটা জনপদটি উল্টে দিলাম এবং তার ওপর পাকা মাটির পাথর অবিরামভাবে বর্ষণ করলাম।’ (সূরা হুদ-৮২) তারপর নবী সা:-এর নির্দেশনা থেকে আমরা এ কথা জানতে পেরেছি যে, এটি এমন একটি অপরাধ সমাজ অঙ্গনকে যার কলুষমুক্ত রাখার চেষ্টা করা ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্বেও অন্তর্ভুক্ত এবং এ ধরনের অপরাধকারীদের কঠোর শাস্তি দেয়া উচিত।
লেখক :
শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট