মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘর্ষের জেরে এখন পর্যন্ত মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ১১৭ জন সদস্য অস্ত্রসহ বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন।
মঙ্গলবার সকালে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) জনসংযোগ কর্মকর্তা মো: শরীফুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, ‘মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘর্ষের জেরে এখন পর্যন্ত মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের ১১৭ জন সদস্য বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বিজিবি তাদের নিরস্ত্রীকরণ করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়েছে।’
তিনি আরো জানান, আজ সকালে মিয়ানমার থেকে ছোড়া গোলা পড়লো ঘুমধুম সীমান্তে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। সকাল ৮টা ৫০ মিনিটের সময় ঘুমধুম এলাকার এক মুক্তিযোদ্ধার বাড়ির পাশে আবারো মর্টার শেল এসে পড়ে। মর্টার শেলের আঘাতে ভেঙ্গে গেছে জানালার কাচ। মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণ সংঘাতের জেরে সীমান্তে বিরতীহীনভাবে ভেসে আসছে ভারী গোলার শব্দ। তুমব্রু, ঘুমধুম পার হয়ে এবার উখিয়ার নয়াপাড়া সীমান্তে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে আতঙ্ক ছড়িয়েছে সীমান্তবর্তী বাসিন্দাদের মাঝে।’
স্থানীয়রা জানান, ‘দিবা-রাত্রি আমাদের চোখে মুখে ঘুম হারাম হয়ে গেছে।’
জানা গেছে, মঙ্গলবার সকালে সীমান্তের দু’পক্ষে ব্যাপক গোলাগুলি ঘটেছে। তুমব্রু সীমান্তে ঘেষা মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি’র রাইট ক্যাম্প দখলে নিয়ে পতাকা উড়ছে। কিন্তু সকাল থেকে এখনো থেমে থেমে গুলিবর্ষণ হচ্ছে। যার কারণে সীমান্তের বসবাসরত স্থানীয়রা আতঙ্কিত হয়ে ঘর ছাড়ছেন। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন পয়েন্টে চেক পোস্ট বসিয়ে তল্লাশি শুরু করেছেন।
এ দিকে, সীমান্তের উত্তেজনার কারণে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিবেচনায় বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ঘুমধুম সীমান্তে থাকা পাঁচটি প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পুনরাদেশ না দেয়া পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছে শিক্ষা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এর আগে, সোমবার সন্ধ্যায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব আক্তারুন্নাহার স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।
সীমান্তবর্তী বিদ্যালয়গুলো হলো বাইশ ফাঁড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভাজা বনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিমকুল তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও দক্ষিণ ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
এ বিষয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান জানিয়েছেন, ‘সীমান্তের পরিস্থিতি উত্তেজনা বিরাজ করছে। যার ফলে নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র স্থানে আশ্রয় নিয়েছে শিক্ষার্থীসহ পরিবার। তাই স্বাভাবিক পরিস্থিতি অবনতি না হওয়ার আগ পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। সেইসাথে সীমান্তবর্তী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হচ্ছে।’
এ দিকে, সোমবার বেলা আড়াইটার দিকে বান্দরবান নাইক্ষ্যংছড়ি ঘুমধুমে সীমান্তের মিয়ানমারের হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া মর্টারশেল বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে এসে পড়েছে। সে ছোড়া মর্টারশেল ঘুমধুমে ৪ নম্বর ওয়ার্ডের জলপাইতলী এলাকায় ঘরের ভিতর ঢুকে বিস্ফোরিত হয়। এ সময় ঘটনাস্থলে বাংলাদেশে নাগরিক হোসনেয়ারা (৪৫), ক্যাম্প ৯ নম্বর রোহিঙ্গা নাগরিক নবী হোসেন (৫৫) নিহত হন। একই ঘটনায় আহত হয়েছে ৭ বছর বয়সী নুসরাত মনি নামে এক শিশু। এই ঘটনাটির পর সীমান্তেবর্তী এলাকার জুড়ে পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও বিজিবি নিরাপত্তা জোরদার করেছে। শুধু তাই সীমান্তবর্তী সাধারণ মানুষদের সর্তকভাবে থাকার নির্দেশ দিয়েছে প্রশাসন।
কক্সবাজার র্যাব-১৫ উপ-অধিনায়ক আবু সালাম চৌধুরী বলেন, ‘বিগত কয়েকদিন ধরে সীমান্তেবর্তী এলাকার উত্তেজনা শুরু হয়েছে সেটি এখনো চলমান রয়েছে। সেক্ষেত্রে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), র্যাব ও পুলিশ যে যার ক্ষেত্র থেকে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। আর সীমান্তে ঘেঁষে যেসব পরিবার আছে তারা আতঙ্কে ঘর ছেড়ে অন্যত্র স্থানে আশ্রয় নিয়েছে এবং সবাইকে ঝুকিপূর্ণভাবে না থেকে নিরাপদে থাকার অনুরোধ জানান।
তিনি আরো বলেন, ‘পাশপাশি সীমান্তের জোরদার করার জন্য, বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ নিরাপত্তা ব্যবস্থাগুলো আরো জোড়দার করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
একইভাবে গত রোববার মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলিতে এপারে বাংলাদেশে প্রদীর চন্দ্র ধরসহ দুই ব্যক্তি আহত হয়েছে। ঘটনাটি সীমান্তবর্তী রক্ষাকারী মিয়ানমার বাহিনী বিজিপির ১৯ জন প্রাণ রক্ষার্থের ভয়ে বাংলাদেশে অভ্যন্তরে প্রবেশ আশ্রয় নেয়। সোমবার সকাল পর্যন্ত মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘর্ষের জেরে এখন পর্যন্ত মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)-এর ৯৫ জন সদস্য ও সন্ধ্যা ৭টায় আবারো ঢেকিবনিয়া ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসছে মিয়ানমার বিজিপির ২২ সৈনিক। মিয়ানমারের থাকে পালিয়ে আসা এই পর্যন্ত বিজিপির সংখ্যা দাঁড়ালো ১১৭ জনে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) তাদেরকে নিরস্ত্রীকরণ করে নিরাপদ আশ্রয় রেখে খাবার দিচ্ছে প্রশাসন।
সীমান্ত পরিদর্শনে গিয়ে কক্সবাজার-৩৪ বিজিবির ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোরশেদ আলম সাংবাদিকদের জানান, ‘বিদ্রোহী গোষ্ঠিকে যখন সীমান্তবর্তী মিয়ানমার বিজিপির যুদ্ধে পেরে উঠতে পারছিল না তখন তারা জীবন বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে চাই। সেসব বিষয়ে ঊধ্বর্তন কর্মকর্তাকে জানিয়ে মিয়ানমারের বিজিপির বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। তাদের মধ্যে যে কয়েকজন আহত রয়েছে তাদেরকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আদেশনুযায়ী খাবার দেয়া হচ্ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘সোমবার দুপুরে মিয়ানমারের ছোড়া মর্টারশেল বিস্ফোরণে দু’জন নিহত হয়েছে সেটি খুবই দুঃখের বিষয়। এ বিষয়ে মিয়ানমারের সরকারের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের ডিপারটেশন ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছে। সেইসাথে বাংলাদেশে কোনো রোহিঙ্গা বা বিছিন্নতাবাদী দল যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেদিকে বর্ডার গার্ড বিজিবি কাজ করে যাচ্ছে।’