অনেক কারণে নামাজ অজু রোজা ইত্যাদি ভেঙে যেতে পারে। একইভাবে ভাঙতে পারে মুসলিমদের ঈমান বা বিশ্বাসও। যেসব কারণে একজন মানুষের চিরন্তন সাফল্যের প্রধান ভিত্তিটি ভেঙে যেতে পারে তার ১০টি প্রধান কারণ উল্লেখ করেছেন ইসলামী স্কলাররা। এই কারণগুলো তারা অনুসন্ধান করে বের করেছেন পবিত্র কুরআন ও হাদিস থেকে। এই ১০টি কারণ নিচে উল্লেখ করা হলো-
১. আল্লাহর ইবাদতে অংশীদার স্থাপন করা : বিভিন্নভাবে আল্লাহর ইবাদতে শরিক বা অংশীদার স্থাপন করা হয় যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি নিচে উল্লেখ করা হলো : ক. ইবাদত পাওয়ার একমাত্র উপযুক্ত সত্তা আল্লাহ তায়ালাকে না মেনে তাঁর সাথে আরো কাউকে যোগ্য বলে মনে করা। অথচ আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘আল্লাহর সাথে অন্য কোনো উপাস্য স্থির করো না। তাহলে নিন্দিত ও (আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে) বিতাড়িত অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।’ (সূরা বনি ইসরাইল-৩৯) আল্লাহ আরো বলেন- ‘আল্লাহর সাথে অন্য কোনো উপাস্য স্থির করো না। তাহলে তুমি নিন্দিত ও অসহায় হয়ে পড়বে।’ (সূরা বনি ইসরাইল-২২) নবীদেরও এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা সতর্ক করে দিয়ে বলেন- ‘(হে নবী!) আপনি আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্যকে ডাকবেন না। তাহলে আপনি শাস্তিতে নিপতিত হবেন।’ (সূরা শুআরা-২১৩) উল্লিখিত আয়াতে নবী করিম সা:-কে জাহান্নামের ভয় দেখানো হয়েছে। অথচ নবীদের জাহান্নামি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সুতরাং এ আয়াত থেকে বুঝা যায়, আল্লাহর পরিবর্তে যারা পীর, ওলি-আউলিয়া বা কোনো কবরবাসীকে ডাকে, তাদের ইবাদত করে, তারা ঈমান হারাবে।
মৃত ব্যক্তির কাছে কিছু চাওয়া বা অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য দোয়া করা শিরকে আকবার তথা বড় শিরক। কোনো মুমিন যদি এ কাজ করে তবে তার ঈমান বিনষ্ট হয়ে যাবে। কারণ ভালো-মন্দ দেয়া, না দেয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। তিনি বলেন- ‘(হে নবী!) আপনি বলে দিন, তোমরা কি আল্লাহ ব্যতীত এমন বস্তুর ইবাদত করো, যে তোমাদের অপকার ও উপকার করার ক্ষমতা রাখে না। অথচ আল্লাহ সব শুনেন ও জানেন।’ (সূরা মায়িদা-৭৬) আল্লাহর নবী সা: নিজেই নিজের উপকার-অপকার করতে পারতেন না বলে কুরআনে প্রমাণ মিলে। আল্লাহ বলেন- ‘বলুন, আল্লাহ যা ইচ্ছে করেন তা ছাড়া আমার নিজের ভালো-মন্দের উপরও আমার কোনো অধিকার নেই। আমি যদি গায়েবের খবর জানতাম তবে তো আমি অনেক কল্যাণই লাভ করতাম এবং কোনো অকল্যাণই আমাকে স্পর্শ করত না। ঈমানদার সম্প্রদায়ের জন্য সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা ছাড়া আমি তো আর কিছুই নই।’ (সূরা আরাফ-১৮৮) মহান আল্লাহ বলেন- ‘বলুন, তোমরা ভেবে দেখেছ কি যদি আল্লাহ আমার অনিষ্ট করার ইচ্ছা করেন, তবে তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে ডাকো, তারা কি সে অনিষ্ট দূর করতে পারবে? অথবা তিনি আমার প্রতি রহমত করার ইচ্ছা করলে তারা কি সে রহমত রোধ করতে পারবে? বলুন, আমার পক্ষে আল্লাহই যথেষ্ট। (প্রকৃত পক্ষে) নির্ভরকারীরা তাঁরই উপর নির্ভর করে।’ (সূরা জুমার-৩৮)
মৃত ব্যক্তির কাছে সাহায্য চাওয়া বা কাউকে বান্দা নেওয়াজ, গরিবে নেওয়াজ, গাউছুল আজম (সর্বোচ্চ সহযোগিতাকারী) মনে করাও বড় গুনাহের অন্তর্ভুক্ত, যা মানুষকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। মহান আল্লাহ বলেন- ‘তোমরা তো আল্লাহর পরিবর্তে কেবল প্রতিমারই পূঁজা করছ এবং মিথ্যা উদ্ভাবন করছ। তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ইবাদত করছ, তারা তোমাদের রিজিকের মালিক নয়। কাজেই আল্লাহর কাছে রিজিক তালাশ করো, তাঁর ইবাদত করো এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। তাঁরই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।’ (সূরা আনকাবুত-১৭) আল্লাহ পাক আরো বলেন- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর পরিবর্তে এমন বস্তুর পূঁজা করে, যে কিয়ামত পর্যন্তও তার ডাকে সাড়া দেবে না, তার চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে? তারা তো তাদের পূজা সম্পর্কেও বেখবর।’ (সূরা আহকাফ-৫) কোনো কিছু চাইতে হলে কেবল আল্লাহর কাছে চাইতে হবে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘যখন তুমি কোনো কিছু চাইবে তখন আল্লাহর কাছেই চাইবে। আর যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে তখন আল্লাহর কাছেই করবে’।
তিরমিজি-২৫১৬, সহিহুল জামে-৭৯৫৭) আল্লাহ ছাড়া মৃত বা জীবিত কারো নামে মানত করা শিরক। গায়রুল্লাহর নামে মানত করলে ওই মানত পূর্ণ করা যাবে না। আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্যের কাজে মানত করে, সে যেন তা পুরা করার মাধ্যমে তার আনুগত্য করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর নাফরমানিমূলক কাজে মানত করে, সে যেন তার নাফরমানি না করে। (অর্থাৎ মানত পুরা না করে)।’ (বুখারি-৬৬৯৬)
নজর বা মানত করা ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত হবে, যদি তা একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে হয়। আর আল্লাহর নামে মানত করলে তা আদায় করা ওয়াজিব। আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে মানত করলে তা শিরক হবে বিধায় তা পূর্ণ করা হারাম। এরূপ মানতের নিয়ত করে থাকলে তা ত্যাগ করতে হবে এবং তওবা করতে হবে। মৃত ব্যক্তির নামে কোনো কিছু জবাই করাও হারাম। মহান আল্লাহ বলেন- ‘তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃতপ্রাণী, রক্ত, শূকরের মাংস, যেসব জন্তু আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে উৎসর্গ করা হয়।’ একটু পরেই বলেন- ‘যে জন্তু যজ্ঞবেদিতে জবাই করা হয় এবং যা ভাগ্য নির্ধারক শর দিয়ে বণ্টন করা হয় (তাও হারাম)। এসব পাপ কাজ।’ (সূরা মায়িদা-৩) এ ব্যাপারে রাসূল সা: বলেন, ‘১. যে ব্যক্তি নিজ মা-বাবাকে অভিশাপ দেয় তার উপর আল্লাহর লানত; ২. যে ব্যক্তি গায়রুল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু-প্রাণী জবাই করে তার উপর আল্লাহর লানত; ৩. যে ব্যক্তি কোনো বিদয়াতিকে আশ্রয় দেয় তার উপর আল্লাহর লানত; ৪. যে ব্যক্তি জমির সীমানা পরিবর্তন করে, তার উপর আল্লাহর লানত।’ (মুসলিম-১৯৭৮, মিশকাত-৪০৭০) উল্লিখিত বিষয়গুলো সুস্পষ্টরূপে শিরকে আকবর, যা থেকে বিরত থাকা একান্ত প্রয়োজন। আল্লাহ তায়ালা শিরকের ব্যাপারে বলেন-‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা শিরকের গুনাহ ক্ষমা করবেন না। তবে অন্যান্য গুনাহ ক্ষমা করতে পারেন। আর যে আল্লাহর সাথে শরিক করে সে সুদূর ভ্রান্তিতে পতিত হয়।’ (সূরা নিসা-১১৬)
ইবনে মাসউদ রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’ (বুখারি-৪৪৯৭)
২. যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং বান্দার মধ্যে কাউকে মাধ্যম তৈরি করে তাদেরকে ডাকে এবং তাদের কাছে শাফায়াত কামনা করে তিনি ঈমানহারা হতে পারেন। শাফায়াতের একমাত্র মালিক আল্লাহ। তিনি বলেন-‘বলুন, সমস্ত সুপারিশ আল্লাহরই আয়ত্তাধীন, আসমান ও জমিনে তাঁরই সাম্রাজ্য।’ (সূরা জুমার-৪৪) একশ্রেণীর মানুষ আল্লাহকে ছেড়ে অন্যের ইবাদত করে এবং তাদেরকে সুপারিশকারী হিসেবে মনে করে। অথচ তাদের সুপারিশ করার কোনো ক্ষমতা নেই। আল্লাহ বলেন- ‘তারা উপাসনা করে আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমন বস্তুর, যা না তাদের কোনো ক্ষতিসাধন করতে পারে, না পারে উপকার করতে এবং তারা বলে- এরা তো আল্লাহর কাছে আমাদের সুপারিশকারী। তুমি বলো, তোমরা কি আল্লাহকে এমন বিষয়ে অবহিত করছ, যে বিষয়ে তিনি অবহিত নন আসমান ও জমিনের মধ্যে।’ (সূরা ইউনুস-১৮)
৩. যদি কোনো মুসলিম ব্যক্তি মুশরিকদের কাফির মনে না করে অথবা তাদের কুফরির ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে অথবা তাদের মতবাদগুলো সঠিক মনে করে তার বিশ্বাস থাকে না। মহান আল্লাহ বলেন- ‘নিশ্চয়ই মুশরিকরা অপবিত্র’। (সূরা তওবা-২৮) মুশরিক সম্প্রদায় অপবিত্র হওয়ার পর কী করে তাদের মতবাদ গ্রহণীয় হতে পারে? তিনি আরো বলেন-‘আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সা: মুশরিকদের থেকে মুক্ত।’ (সূরা তওবা-৩) অর্থাৎ মুশরিকদের ব্যাপারে আল্লাহর কোনো দায়দায়িত্ব নেই। মহান আল্লাহ বলেন- ‘নিশ্চয়ই আহলে কিতাবের মধ্যে যারা কুফরি করেছে এবং শিরক করে তারা চিরস্থায়ী জাহান্নামি এবং এরাই সৃষ্টির মধ্যে নিকৃষ্ট সৃষ্টি।’ (সূরা বায়িনাহ-৬) যার কারণেই আল্লাহ এদের সাথে বিয়ে পর্যন্ত হারাম ঘোষণা করেছেন।
৪. যদি কোনো মুসলিম নবী করিম সা:-এর দেখানো পথ ব্যতীত অন্য কোনো পথ পরিপূর্ণ অথবা ইসলামী হুকুমাত বা বিধান ব্যতীত অন্য কারো তৈরি হুকুমাত উত্তম মনে করে, তবে সে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি এই বিশ্বাস করে যে, মানুষের তৈরি আইন ও বিধান ইসলামী শরিয়ত থেকে উত্তম বা ইসলামের সমান, মানবসৃষ্ট বিধান দিয়ে বিচার-ফয়সালা জায়েজ, ইসলামী হুকুমাত বিংশ শতাব্দীর জন্য প্রযোজ্য নয়, ইসলামই মুসলমানদের পিছিয়ে পড়ার কারণ, ইসলামের সাথে পরকালীন সম্পর্ক, দুনিয়াবি কোনো সম্পর্ক নেই- ওলামায়ে কেরামের ঐকমত্যে ওই বিষয়গুলো কুফরি বা অস্বীকারের শামিল। কারণ এটি হালালকে হারাম ও হারামকে হালাল করার হীন প্রচেষ্টা মাত্র। (ফাতাওয়া আল-মারআতুল মুসলিমা ১/১৩৭ পৃষ্ঠা) আল্লাহ বলেন- ‘তারা (ইহুদি-খ্রিষ্টানরা) আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের পণ্ডিত ও সংসার-বিরাগীদেরকে তাদের প্রভুরূপে গ্রহণ করেছে।’ (সূরা তওবা-৩১) ইহুদি-খ্রিষ্টান পণ্ডিত ও ধর্ম যাজকদের মাবুদ (প্রভু) সাব্যস্ত করা অর্থ তাদেরকে প্রভু হিসেবে গ্রহণ করা নয়; বরং তারা সর্বাবস্থায় যাজক শ্রেণীর আনুগত্য করে থাকে। যদিও তারা আল্লাহপ্রদত্ত হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল করে দেয়। এ ধরনের আনুগত্য তাদেরকে প্রভু সাব্যস্ত করারই নামান্তর। আর এটি হলো প্রকাশ্য কুফরি। (তাফসিরে মারেফুল কুরআন-৫৬৭ পৃষ্ঠা)
৫. যদি কোনো মুসলমান আল্লাহর নবী সা:-এর আনীত বিধানের কোনো অংশকে অপছন্দ করে তবে সে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবে, যদিও সে ওই বিষয়ে আমল করে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আর যারা কাফির তাদের জন্য রয়েছে দুর্গতি এবং তিনি তাদের কর্ম বিনষ্ট করে দেবেন। এটি এ জন্য যে, আল্লাহ যা নাজিল করেছেন, তারা তা পছন্দ করে না। অতএব তাদের কর্মসমূহ আল্লাহ ব্যর্থ করে দেবেন।’ (সূরা মুহাম্মাদ : ৮-৯) এ আয়াতে বুঝা যায়, আমলসমূহ বাতিল হওয়ার অন্যতম কারণ আল্লাহর নাজিলকৃত বিষয় অপছন্দ করা। ওই বিষয় আমল করলেও অপছন্দ করার কারণে ইসলাম থেকে বিদায় হয়ে যাবে।
শেষাংশ আগামী সংখ্যায়