দেশে করোনা প্রতিরোধে লকডাউন নীতি কি আদৌ কোনো কাজে আসছে? নাগরিকরা কি মানছেন সামাজিক দূরত্বের নীতি? লকডাউন কার্যকর না হওয়ার পরিণতিই বা কি হতে পারে?
বাংলাদেশে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইলে খেলাফত মজলিস নেতা ও ইসলামি বক্তা মাওলানা জোবায়ের আহমেদ আনসারীর জানাজায় শনিবার হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি লকডাউনকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এত লোকের জমায়েত ঠেকাতে পুলিশ প্রশাসন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। ঘটনার পর এখন এএসপি, ওসি এবং ইন্সপেক্টরকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
প্রশ্ন উঠেছে পুলিশ প্রশাসন আগে ব্যবস্থা নিতে কেন ব্যর্থ হলো এবং যারা এত লোকের সমাগম ঘটিয়ে জানাজার আয়োজন করল তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে?
পুলিশ জানিয়েছে, তারা এখন ঘটনার সরেজমিন তদন্ত করে দেখছেন যে জানাজায় লোক সমাগমের পিছনে কাদের হাত ছিল। এজন্য তিন সদস্যের একটি কমিটিও করা হয়েছে। পাশাপাশি যেসব জায়গা থেকে জানাজায় লোক এসেছে সেসব এলাকা লকডাউন করা হচ্ছে।
ওই জানাজার ব্যাপারে মাওলানা জোবায়ের আহমেদ আনসারীর নামে পরিচালিত ফেসবুক পেইজ থেকে সময় এবং স্থান জানিয়ে আগেই পোস্ট দেয়া হয়েছিল। তার ছেলের পরিচয়ে ওই পোস্ট দেয়া হয়। কিন্তু ওই ফেসবুক আইডিটি ভেরিফায়েড নয়। এই বিষয়ে জানতে তার নাম্বারে ফোন দেয়া হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
পুলিশের অ্যাডিশনাল এসপি আলমগীর হোসেন জানান,‘তদন্ত শেষ হওয়ার পর জানা যাবে কার দায়দায়িত্ব কতটুকু। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে৷ তার আগে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে আমরা যেসব গ্রাম থেকে জানাজায় লোক এসেছে ঐ গ্রামগুলো লকডাউন করে পুলিশ মোতায়েন করেছি।’
রোববার করোনা পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত অনলাইন ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন,‘লকডাউন কার্যকর রাখতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে।’
এ পর্যন্ত দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৫৫ জেলায় করোনা সংক্রমণের তথ্য পাওয়া গেছে। জেলাগুলো লকডডাউন করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকায় এখন পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে শতাধিক এলাকা লকডাউন করা হয়েছে। কিন্তু লকডাউন কোনো কাজেই আসছে না। রাজধানীর কারওয়ান বাজারসহ জনসমাগমের বিভিন্ন স্থানগুলোতে কোন কড়াকড়ি নেই। এসব জায়গায় সামাজিক দূরত্বের কোন বিধিনিষেধ মানা হচ্ছে না।
প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী মনে করেন সরকার আসলে লকডউন কার্যকর করতে পারছে না আইন প্রয়োগে দ্বৈত নীতির কারণে। তিনি বলেন,‘খালেদা জিয়ার মুক্তি, গণপরিবহণ চালু রেখে সাধারণ ছুটি, পোশাক শ্রমিকদের ঢাকায় আনা, ফেনীতে দোয়া মাহফিল এবং সর্বশেষ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমরা সেই দ্বৈত নীতিই দেখলাম। হাজার হাজার থেকে লাখ লাখ লোকের সমাগম ঘটল। তাহলে এই লকডাউনের কোনো মানে আছে? আমাদের অর্থনীতির এত বিরাট ক্ষতি করে আমরা লকডাউন করছি কেন? উদ্দেশ্যতো সফল হচ্ছে না। সরকারতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে লকডাউনে ছাড় দিচ্ছে। আর সাধারণ মানুষকে ঘরে থাকতে বলছে।’
তিনি বলেন,‘সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও লকডাউনের মাধ্যমে করোনা প্রতিরোধ আমাদের এখানে হবে না। আমরা এখন চতুর্থ পর্যায়ে আছি। ভাইরাসের একটা বৈশিষ্ট্য হলে সে জেনারেশন পরিবর্তনের সাথে সাথে দুর্বল হয়ে পড়ে। আর ৬০ ভাগ মানুষ যখন আক্রান্ত হয় তখন প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। আমাদের মনে হয় এখন করোনা ভাইরাসের চরিত্রের ওপরই ভরসা করতে হবে। আর কোনো উপায় নেই। আর সেটা যদি না হয় তাহলে আমাদের চরম মূল্য দিতে হবে।’
জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মানুষকে ঘর থেকে বের না হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল সরকার। এছাড়া সন্ধ্যা ছয়টা থেকে ভোর ছয়টা পর্যন্ত চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সাধারণভাবে সকাল ছয়টা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত গলির দোকানপাট এবং বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত সুপারশপ ও স্বীকৃত কাঁচাবাজার খোলা রাখা যাবে। কিন্তু সেখানে যারা যাবেন তাদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। সারাদেশে যানবাহন চলাচলও বন্ধ আছে। কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় হরহামেশাই এইসব নিয়মের বরখেলাপ ঘটছে। যদিও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং ভ্রাম্যমান আদালত দায়িত্ব পালন করছে।
নিয়ম না মানায় ঢাকায় ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত তিন হাজার ৪৪৫টি মামলা হয়েছে। জরিমানা আদায় করা হয়েছে ৬৩ লাখ ৪১ হাজার টাকা। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন,‘আমরা চেষ্টা করছি সবাই যাতে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের না হন তা মানাতে। কিন্তু এখানে সাধারণ মানুষেরও দায়িত্ব আছে। তাদেরও সচেতন হতে হবে৷ আমরা শাস্তিও দিচ্ছি। কিন্তু শুধু শাস্তি দিয়ে এই ধরনের পরিস্থিতি মেকাবিলা করা যায় না।’
তিনি বলেন,‘জনসমাগম ঠেকানো না গেলে করোনা বেশি ছড়াবে। এটা যদি মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বুঝতে হয় তাহলে অনেক কঠিন।’ সূত্র : ডয়চে ভেলে