আজ থেকে প্রায় সাড়ে চৌদ্দ শ’ বছর আগে পৃথিবী তখন জাহিলিয়াতের অতল গহ্বরে ডুবে গিয়েছিল। আদর্শহীন সমাজ ডুবেছিল ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। কোথাও ছিল না সামান্য স্বস্তি, পথ চলার মতো যৎসামান্য জ্যোতি। সর্বোপরি চতুর্দিকে শুধু অতৃপ্তির হাহাকার আর সীমাহীন হতাশা। বর্বরতার চরম সীমায় উপনীত এই বিপর্যস্ত সমাজব্যবস্থা থেকে মুক্তির প্রত্যাশায় প্রহর গুণছিল পৃথিবী। এমনি এক যুগসন্ধীক্ষণে ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২০ এপ্রিল ৮ কিংবা ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার সুবেহ সাদিকের শুভ মুহূর্তে মক্কার কুরাইশ বংশে আব্দুল্লাহর ঔরসে মা আমেনার কোল আলো করে আবির্ভূত হলেন মানবজাতির পরম ও চরম আদর্শ, স্রষ্টার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, শান্তির প্রতীক, সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ সা:।
মানবসমাজের সর্বাঙ্গীন কল্যাণের লক্ষ্যে আল্লাহ তায়ালা শান্তির বাণীবাহক ও দূতস্বরূপ রাসূলুল্লাহ সা:-কে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। তিনি মানবগোষ্ঠীর প্রতি সত্য প্রচারে নিবিষ্ট হন এবং তাদের সরল, সঠিক ও শান্তির পথে পরিচালিত করেন। যাতে তারা জীবনে সফলতা অর্জন করতে পারে আর ইহকালীন শান্তি ও পারলৌকিক সৌভাগ্য লাভ করতে সক্ষম হয়। নবী করিম সা:-কে শান্তি, মুক্তি, প্রগতি ও সামগ্রিক কল্যাণের জন্য বিশ্ববাসীর রহমত হিসেবে আখ্যায়িত করে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- ‘আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য রহমতরূপে প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত-১০৭)
মহানবী সা:-এর শান্তি প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ ও পদ্ধতি ছিল অনন্য। দল-মত-গোত্র নির্বিশেষে আরবের জাতি-ধর্ম-বর্ণ সবার মধ্যে শান্তিচুক্তি ও সন্ধি স্থাপনের মধ্য দিয়ে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে তিনি সন্ত্রাসমুক্ত শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর অনুপম চরিত্র-মাধুর্য ও সত্যনিষ্ঠার কথা বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি যুদ্ধবাজ আরবদের শান্তির পতাকাতলে সমবেত করেন এবং বিবদমান গোত্রগুলো একটি সুসংহত জাতিতে রূপান্তরিত হয়।
তিনি ‘হিলফুল ফুজুল’ নামে শান্তিসঙ্ঘ গঠন করে অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। আর্তের সেবা করা, অত্যাচারীকে প্রতিরোধ করা, অত্যাচারিতকে সহযোগিতা করা, শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা এবং গোত্রীয় সম্প্রীতি বজায় রাখা ছিল শান্তিসঙ্ঘের অঙ্গীকার বাণী। মানুষের কল্যাণে তাঁর গড়া স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানটি পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম সাংগঠনিক রীতিতে প্রতিষ্ঠিত সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এভাবে প্রাক-নবুয়তি জীবনে মক্কায় অবস্থানকালে তিনি একটি সুস্থ সমাজ অবকাঠামোর প্রধান দিকগুলো তুলে ধরেছেন। যার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল প্রচলিত দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়ে সমাজজীবনে শৃঙ্খলা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। মহানবী সা: হিলফুল ফুজুল বা শান্তিসঙ্ঘ গঠনের মাধ্যমে মক্কা থেকে যাবতীয় অন্যায়-অত্যাচার ও সন্ত্রাসবাদ উচ্ছেদ করে আদর্শ সমাজ গঠনে সচেষ্ট হন।
মদিনায় হিজরতের পর তিনি সেখানে শান্তিপূর্ণ ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। মদিনায় বসবাসরত মুসলমান, ইহুদি, খ্রিষ্টান, পৌত্তলিক প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরাজমান কলহ-বিবাদ, হিংসা-বিদ্বেষপূর্ণ অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে তিনি একটি ইসলামী সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার সঙ্কল্প করেন। তিনি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতাদের আহ্বান করে একটি বৈঠকে বসে তাদের বিশ্বমানবতার ঐক্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আবশ্যকতা বুঝিয়ে একটি সনদ প্রস্তুত করেন। মদিনায় বসবাসকারী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সবাই এ সনদ মেনে শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। বিশ্বশান্তির অগ্রনায়ক রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, নাগরিকদের মধ্যে শান্তি-সম্প্রীতি বজায় রাখাসহ নানা দিক বিবেচনা করে মদিনার সনদ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেন মানবেতিহাসের প্রথম প্রশাসনিক সংবিধান ‘মদিনা সনদ’। মদিনায় স্থায়ীভাবে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং মদিনায় বসবাসকারী অন্যান্য ধর্মাবলম্বী, বিশেষ করে ইহুদিদের সাথে তিনি এক শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেন। এভাবে তিনি মদিনার জীবনে সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করে শান্তি স্থাপনের বলিষ্ঠ উদ্যোগ নেন।
বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় মহানবী সা:-এর অনবদ্য ভূমিকার অনন্য স্মারক হুদায়বিয়ার সন্ধি। বাহ্যিক পরাজয়মূলক হওয়া সত্ত্বেও কেবল শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে তিনি এ সন্ধিতে স্বাক্ষর করেন। বিশ্বশান্তির অগ্রদূতের সাহস, ধৈর্য ও বিচক্ষণতা তখনকার মানুষকে যেমন বিমুগ্ধ করে, তেমনি অনাগত মানুষদের জন্যও শান্তি প্রতিষ্ঠার আদর্শ ও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকে। মহানবী সা:-এর শান্তিপূর্ণ ‘মক্কা বিজয়’ মানবেতিহাসের এক চমকপ্রদ অধ্যায়। কার্যত তিনি বিনা যুদ্ধে, বিনা রক্তপাতে, বিনা ধ্বংসে মক্কা জয় করেন। শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে কি মক্কার জীবনে, কি মদিনার জীবনে- সর্বত্রই ষড়যন্ত্র, সঙ্ঘাত, যুদ্ধ ও মুনাফেকি মোকাবিলা করতে হয়েছে তাঁকে। শত অত্যাচার-নির্যাতন ও যুদ্ধ করে আজীবন যে জাতি নবী করিম সা:-কে সীমাহীন কষ্ট দিয়েছে, সেসব জাতি ও গোত্রকে মক্কা বিজয়ের দিন অতুলনীয় ক্ষমা প্রদর্শন করে এবং তাদের সাথে উদার মনোভাব দেখিয়ে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন। ক্ষমা ও মহত্ত্বের দ্বারা মানুষের মন জয় করে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার এমন নজির বিশ্বে দুর্লভ।
৬৩ বছরের মাক্কি ও মাদানি জীবনে তিনি সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহ-প্রদত্ত দায়িত্ব সূচারুভাবে সমাপন করে গিয়েছিলেন। তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচার করেছেন যেমন শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য, তেমনি প্রতিরোধমূলক যুদ্ধ করেছেন শান্তি রক্ষার জন্য। জীবনে অনেক যুদ্ধের মোকাবেলা করতে হয়েছে তাঁকে, অথচ এর কোনোটিই আক্রমণাত্মক যুদ্ধ ছিল না। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সা: ২৭টি প্রতিরোধমূলক যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন এবং দেশের শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য সাহাবিদের নেতৃত্বে ৫৭টি অভিযান পরিচালনা করেন। ইসলামের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের পর মহানবী সা: বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানের সাথে সংলাপ, সমঝোতা করে অসংখ্য চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করেন। এগুলো বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বিরাট অবদান রাখে।
সমস্যাসঙ্কুল বিশ্বে যেখানে মানুষ মৌলিক মানবিক অধিকারবঞ্চিত, দেশে দেশে হানাহানি ও যুদ্ধবিগ্রহ, ঝরছে নিরীহ মানুষের রক্ত, যেখানে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্ট, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মতপার্থক্য সহ্য করা হচ্ছে না, সেখানে রাসূলুল্লাহ সা:-এর অনুপম জীবনাদর্শ ও সর্বজনীন শিক্ষা অনুসরণই বহুপ্রত্যাশিত শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
মোট কথা, বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর শুভ আগমনে পৃথিবীর ব্যাকুল প্রতীক্ষার অবসান ঘটল। মানবতার চূড়ান্ত বিপ্লব সাধিত হলো। একটি সোনালি সমাজ ও শান্তিময় পৃথিবীর গোড়াপত্তন হলো। জুলুম-অত্যাচারে জর্জরিত সমাজে ফিরে এলো ন্যায় ইনসাফ। নারী সমাজ পেলো নিজ অধিকার ও সম্মান। এমনিভাবে গোটা সমাজে বইতে লাগল শান্তির সুবাতাস ও রহমতের বারিধারা। তাই তো পবিত্র কুরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে- ‘আমি আপনাকে বিশ্বজগতের রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত-১০৭)
লেখক :
ইসলামী কলামিস্ট, মজলিশপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া