প্রেম-ভালোবাসা, মায়া-মমতা ও ভক্তি-শ্রদ্ধা মানুষের স্বভাবজাত বিষয়। ভালোবাসা মানেই অবৈধ নয়। কিছু কিছু ভালোবাসা ইসলামে কাম্য। সেটির প্রতি ইসলাম উৎসাহ দিয়েছে। ইসলাম বৈধ সম্পর্ক ও বৈধ সম্পর্কের গণ্ডিতে থেকে ভালোবাসার অনুমতি দেয়। নিজের যাপিত জীবনে ক্ষতি হয় এমন ভালোবাসা আর ভক্তি-শ্রদ্ধার প্রতি ইসলাম নিরুৎসাহিত করেছে। ঘোষণা করেছে তাকে হারাম বলে। অপরদিকে বৈধ ভালোবাসার প্রতি স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাই উৎসাহিত করেছেন । কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘আল্লাহর কুদরতের মধ্যে অন্যতম একটি নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকে তোমাদের স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন। যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাকো এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও অনুগ্রহ সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে’ (সূরা রুম, আয়াত : ২১)।
অপর এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন , ‘হে নবী আপনি বলুন, আমি তোমাদেরকে ওই সব বিষয় পাঠ করে শুনাই, যেগুলো তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য হারাম করেছেন। তা এই যে, আল্লাহর সাথে কোনো কিছুকে অংশীদার করো না, পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ করো, স্বীয় সন্তানদের দারিদ্র্যের কারণে হত্যা করো না, আমি তোমাদের ও তাদের আহার দিই, নির্লজ্জতার কাছেও যেয়ো না, প্রকাশ্য হোক কিংবা অপ্রকাশ্য। যাকে হত্যা করা আল্লাহ হারাম করেছেন, ন্যায়ভাবে ছাড়া তাকে হত্যা করো না; তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন যেন তোমরা বোঝো’ (সূরা আনআম, আয়াত : ১৫১)।
আমরা কুরআন ও হাদিসের এমন কিছু ভালোবাসার কথা বর্ণিত হয়েছে , যেসব মানুষকে আল্লাহর কাছে প্রিয় করে তোলে। ইহ-পরকালীন সম্মানে ভূষিত করে। পার্থিব জীবনেও দেয় শান্তি-স্বস্তি।
এমন কিছু ভালোবাসার বিবরণ নিম্নে তুলে ধরা হলো-
এক. আল্লাহ ও রাসূলের জন্য ভালোবাসা :
জীবনে সর্বপ্রথম এবং সবার আগে যাদেরকে ভালোবাসতে হবে , তারা হলো আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাদেরকে নিজের জীবনে চেয়েও বেশি ভালোবাসতে হবে। এ ভালোবাসা হলো ঈমানের ভালোবাসা। আনুগত্যের ভালোবাসা ।
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বলো, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস, তাহলে আমার অনুসরণ করো, আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপগুলো ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ৩১)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যার মধ্যে তিনটি গুণ থাকে সে ঈমানের স্বাদ ও মিষ্টতা পেয়ে যায়; (১) যার কাছে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল অন্য সব কিছু অপেক্ষা বেশি প্রিয়; (২) যে আল্লাহর জন্য ভালোবাসা রাখে এবং আল্লাহর জন্য শত্রুতা পোষণ করে; (৩) আর যদি ভয়াবহ আগুন প্রজ্বলিত করা হয়, তবে তাতে প্রবেশ করা তার কাছে আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা অপেক্ষা বেশি পছন্দনীয় হয়’ (সুনানে নাসায়ী, হাদিস ৪৯৮৭)।
দুই. মা-বাবার প্রতি ভালোবাসা:
মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে মা-বাবার সাথে সদাচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাদেরকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করতে বলেছেন। আল্লাহর ইবাদতের পরেই মা-বাবার সাথে ভালো আচরণ ও ভক্তি-শ্রদ্ধার কথা বলা হয়েছে । ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমার রব আদেশ দিয়েছেন যে , তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে না এবং মা-বাবার সাথে সদাচরণ করবে। তাদের একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার নিকট বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদের ‘উফ’ বলো না এবং তাদের ধমক দিয়ো না। আর তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বলো’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ২৩)।
তিন . স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা :
প্রতিটি মানুষেরই পৃথিবীতে অন্তত একজন একান্ত ভালোবাসার মানুষের প্রয়োজন হয়, যে একান্ত তারই হবে। সুখে-দুঃখে তার সঙ্গ দেবে। যার কাছে তার যৌন কামনা বাসনা পূরণ করবে। যার চোখে তাকিয়ে হতাশা ও কষ্ট ভুলবে। তার উপস্থিতি তাকে প্রশান্তি দেবে। মানুষের এই চাহিদা মেটাতে মহান আল্লাহ এক পবিত্র সম্পর্কের সৃষ্টি করেছেন, তা হলো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক।
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে যে তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই এর মধ্যে নিদর্শনাবলি রয়েছে সে কওমের জন্য, যারা চিন্তা করে (সূরা রুম, আয়াত : ২১)।
চার . সন্তান-সন্ততির প্রতি ভালোবাসা:
সন্তানের প্রতি স্নেহ, মমতা ও ভালোবাসা মানুষের সহজাত এক বিষয়। ভালোবাসার শক্ত এ ভিতের ওপরই টিকে আছে মানবজাতি। দাঁড়িয়ে আছে মানবসভ্যতা। সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার ভালোবাসার প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘জেনে রেখো! নিশ্চয় সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি (এর মোহ ও মমতা) তোমাদের জন্য এক পরীক্ষা (সূরা আনফাল , আয়াত: ২৮)।
অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য ’ (সূরা কাহাফ , আয়াত : ৪৬)।
আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও ছিলেন তার সন্তান-সন্ততি ও পরিবারের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল। তিনি তার সন্তানদের অত্যন্ত ভালোবাসতেন। এ প্রসঙ্গে হজরত আনাস রা: বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তুলনায় পরিবার-পরিজনের প্রতি অধিক স্নেহ-মমতা পোষণকারী আর কাউকে দেখিনি ’ (আল আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ৩৭৬)।
এ ছাড়া সব ধরনের বৈধ ভালোবাসার প্রতি ইসলাম উৎসাহিত করেছে ।
আজ আমাদের সমাজে যুবক-যুবতীদের মাঝে বিয়েপূর্ব যে অনৈতিক সম্পর্ক সৃষ্টি হচ্ছে এবং ভালোবাসা তৈরি হচ্ছে , ইসলামের দৃষ্টিতে তা সম্পূর্ণ হারাম। ইসলাম কখনো এ ধরনের ভালোবাসা সমর্থন করে না। এটি মূলত যৌন তাড়নাপ্রসূত একটি বিষয়। বিবাহবহির্ভূত ছেলেমেয়ের কোনো সম্পর্ককে ইসলাম সমর্থন করে না। বর্তমানে আমাদের সমাজে ছেলেমেয়েদের যেই অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও নগ্নতার উন্মুক্ত প্রদর্শন চলে তা একজন সুস্থ বিবেকসম্পন্ন, সভ্য রুচিশীল মানুষের জন্য পালন করা শোভা পায় না।
মনে রাখতে হবে, এসব অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, অবাধ ঘোরাফেরা ও পার্কসহ সব জায়গায় অশ্লীলতা প্রদর্শনের জন্যই পৃথিবীতে বালা-মুসিবত আসে। মানুষ আল্লাহ তায়ালার কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হয় ।
লেখক:
শিক্ষক মাদরাসা আশরাফুল মাদারিস , তেজগাঁও ঢাকা