সাহাবা আজমাইন রা: ছিলেন রাসূল্লাহ সা:-এর সংগ্রামমুখর জীবন সুখ-দুঃখের সাথী। সত্য অনুসরণ ও দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তারা ছিলেন এ উম্মতের সর্বোচ্চ ব্যক্তিত্ব। আল্লাহ ও রাসূল সা: প্রদত্ত সত্যের মানদণ্ডে তারা উত্তীর্ণ। রাসূলুল্লাহ সা:-এর মিশন প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তারা যে ত্যাগ ও কোরবানি করে গেছেন, তা ইতিহাসের পাতাকে বারবার কাঁপিয়ে তুলে। তারা ছিলেন দিনের বেলায় দিগি¦জয়ী ঘোড় সওয়ার আর রাতের বেলায় গভীর ইবাদতে নিমগ্ন আল্লাহর বান্দা। চারিত্রিক বিশেষ মানদণ্ডে তারা উত্তীর্ণ। ফলে দুনিয়াতেই তারা বেহেশতের সুসংবাদ পেয়েছেন।
আল কুরআনের বেশ কিছু জায়গায় তাঁদের মর্যাদা ও ইসলামী অনুশাসনের প্রতি তাদের একনিষ্ঠতার বর্ণনা এসেছে। যেমন, আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আমার আয়াতের প্রতি তো তারাই ঈমান আনে যাদেরকে এ আয়াত শুনিয়ে যখন উপদেশ দেয়া হয় তখন তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং নিজেদের রবের প্রশংসা সহকারে তার মহিমা ঘোষণা করে এবং অহঙ্কার করে না। তাদের পিঠ থাকে বিছানা থেকে আলাদা, নিজেদের রবকে ডাকে আশঙ্কা ও আকাক্সক্ষাসহকারে এবং যা কিছু রিজিক আমি তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে।’ (সূরা আস সাজদা : ১৫-১৬)
এ আয়াতটিতে সাহাবাদের রা: তিনটি গুণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমত, আগে থেকে তাদের মনে যেই চিন্তাচেতনা পোষণ বা লালনই করুন না কেন, আল্লাহর আদেশ শোনার পর সেই চিন্তাচেতনা পরিহার করে আল্লাহর কথা মেনে নেয় এবং আল্লাহর বন্দেগির পথ অবলম্বন করে, আত্মম্ভরিতা তাদেরকে সত্যগ্রহণ ও রবের আনুগত্য করার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না। দ্বিতীয়ত, আরাম-আয়েশ করে রাত কাটানোর পরিবর্তে তারা নিজেদের রবের ইবাদত করে। তাদের অবস্থা হচ্ছে এই যে, সারা দিন নিজেদের দায়িত্ব পালন করে, কাজ শেষে এসে তারা দাঁড়ায় নিজেদের রবের সামনে। তাঁকে স্মরণ করে রাত কাটিয়ে দেয়। তাঁর ভয়ে কাঁপতে থাকে এবং তাঁর কাছেই নিজেদের সব আশা-আকাক্সক্ষা সমর্পণ করে। বিছানা থেকে পিঠ আলাদা রাখার মানে এ নয় যে, তারা রাতে শয়ন করে না। বরং এর অর্থ হচ্ছে- তারা রাতের একটি অংশ কাটায় আল্লাহর ইবাদতে। তৃতীয়ত, আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদ থেকে ব্যয় করে। আল্লাহ পবিত্র রিজিক যা দিয়েছেন তা থেকেই খরচ করে। তার সীমা অতিক্রম করে নিজের খরচপাতি পুরা করার জন্য হারাম সম্পদে হাত দেয় না।
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। আর যারা তাঁর সাথে আছে তারা কাফেরদের বিরুদ্ধে আপসহীন এবং নিজেরা পরস্পর দয়াপরবশ। তোমরা যখনই দেখবে তখন তাদের চেহারায় সিজদার চিহ্ন যা তাদেরকে আলাদা করে ফেলে। তাদের এ পরিচয় তাওরাতে দেয়া হয়েছে। আর ইনজিলে তাদের উপমা পেশ করা হয়েছে এই বলে যে, একটি শস্যক্ষেত যা প্রথমে অঙ্কুরোদগম ঘটল পরে তাকে শক্তি জোগাল তারপর তা শক্ত ও মজবুত হয়ে স্বীয় কাণ্ডে ভর করে দাঁড়াল। যা কৃষককে খুশি করে কিন্তু কাফের তার পরিপুষ্টি লাভ দেখে মনোকষ্ট পায়। এ শ্রেণীর লোক যারা ঈমান আনয়ন করেছে এবং সৎকাজ করেছে আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা ও পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।’ (সূরা আল ফাতহ-২৯) এ আয়াতে সাহাবায়ে কেরামদের কয়েকটি গুণের বর্ণনা করা হয়েছে। কাফেরদের প্রতি সাহাবিদের কঠোর হওয়ার অর্থ এ নয় যে, তারা কাফেরদের সাথে রূঢ় এবং ক্রুদ্ধ আচরণ করেন বরং এর অর্থ হচ্ছে, তারা তাদের ঈমানের পরিপক্বতা, নীতির দৃঢ়তার চারিত্রিক শক্তি এবং ঈমানি দূরদর্শিতার কারণে কাফেরদের মোকাবেলায় মজবুত পাথরের মতো অনমনীয় ও আপসহীন। তারা চপল বা অস্থিরমনা নন যে, কাফেররা তাদেরকে যেদিকে ইচ্ছা ঘুরিয়ে দেবে। তারা নরম ঘাস নন যে, কাফেররা অতি সহজেই তাদেরকে চিবিয়ে পিষে ফেলবে। কোনো প্রকার ভয় দেখিয়ে তাদেরকে স্তব্ধ করা যায় না। কোনো লোভ দেখিয়ে তাদের কেনা যায় না। যে মহৎ উদ্দেশ্যে তারা জীবন বাজি রেখে মুহাম্মদ সা:-কে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত হয়েছেন তা থেকে তাদের বিচ্যুত করার ক্ষমতা কাফেরদের নেই। তারা তাদের উদ্দেশ্যে ফাটল সৃষ্টি করতে পারে না। উদ্দেশ্য হাসিলে তারা বজ্রকঠোর।
# ঈমানদারদের কাছে তারা বিনম্র, দয়াপরবশ, স্নেহশীল, সমব্যথী ও দুঃখের সাথী। নীতি ও উদ্দেশ্যের ঐক্য তাদের মধ্যে পরস্পরের জন্য ভালোবাসা, সাযুজ্য ও গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করে দিয়েছে। তারা, নিজের প্রয়োজন পূরণের পরিবর্তে অন্যের প্রয়োজন পূরণে অগ্রাধিকার দানকারী। প্রতিবেশীকে ভুখা রেখে তারা নিজেদের উদরপূর্তি করেন না। যেমন, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘এবং মুমিনদের অন্তর পরস্পরের সাথে জুড়ে দিয়েছেন। তুমি সারা দুনিয়ার সব সম্পদ ব্যয় করলেও এদের অন্তর জোড়া দিতে পারতে না। কিন্তু আল্লাহ তাদের অন্তর জুড়ে দিয়েছেন। অবশ্যই তিনি বড়ই পরাক্রমশালী ও জ্ঞানী।’ (সূরা আনফাল-৬৩) আরববাসীদের মধ্য থেকে যারা ঈমান এনে রাসূল সা:-এর সাথী হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে যে ভ্রাতৃত্ব, স্নেহ, প্রীতি, ভালোবাসা সৃষ্টি করে মহান আল্লাহ তাদেরকে একটি শক্তিশালী দলে পরিণত করেছিলেন, এখানে সে দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। অথচ রাসূল সা:-এর এ সব সাথী বিভিন্ন গোত্র থেকে এসেছিলেন, তাদের মধ্যে জাহেলিয়াতের শত শত বছরের শত্রুতা চলে আসছিল। তাদের অনেকে পরস্পরের রক্তপিয়াসু ছিলেন। এই কঠিন পরিস্থিতিতে মাত্র দুই-তিন বছরের মধ্যে ইসলাম ও ঈমানের বদৌলতে তাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি হলো। ব্যাপারটি খুব সহজসাধ্য ছিল না। কিন্তু আল্লাহ তাদের হৃদয়গুলো এমনভাবে জুড়ে দিয়ে সিসাঢালা প্রাচীরে পরিণত করলেন। এ কথাটিই আল্লাহ তায়ালা সূরা আলে ইমরানে উল্লেখ করেছেন- ‘আল্লাহর তোমাদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন সে কথা স্মরণ রেখো। তোমরা ছিলে পরস্পরের শত্রু। তিনি তোমাদের হৃদয়গুলো জুড়ে দিয়েছেন। ফলে তার অনুগ্রহ ও মেহেরবানিতে তোমরা ভাই ভাই হয়ে গেছ।’ (সূরা আলে ইমরান-১০৩)
এই আয়াতে সিজদা করতে করতে কোনো কোনো সালাত আদায়কারীর কপালে যে দাগ পড়ে যায় এখানে তা বুঝানো হয়নি। এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে আল্লাহভীরুতা, হৃদয়ের বিশালতা, মর্যাদা এবং মহৎ নৈতিক চরিত্রের প্রভাব যা আল্লাহর সামনে মাথা নত করার কারণে বা আল্লাহর আনুগত্যশীলতা স্বাভাবিকভাবেই কোনো মানুষের চেহারায় ফুটে ওঠে। মানুষের চেহারা একখানা খোলা গ্রন্থের মতো যার পাতায় পাতায় মানুষের মনোজগতের অবস্থা সহজেই অবলোকন করা যেতে পারে। একজন অহঙ্কারী মানুষের চেহারা একজন বিনম্র ও কোমল স্বভাব মানুষের চেহারা ভিন্ন হয়ে থাকে। একজন দুশ্চরিত্র মানুষের চেহারা একজন সচ্চরিত্র ও সৎমনা মানুষের চেহারা থেকে আলাদা করে সহজে চেনা যায়।
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘এ কারণেই যখন ওইসব কাফেররা তাদের মনে জাহেলি সঙ্কীর্ণতার স্থান দিলো তখন আল্লাহ তাঁর রাসূল ও ঈমানদারদের ওপর প্রশান্তি নাজিল করলেন এবং তাদেরকে তাকওয়ার নীতির ওপর সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত রাখলেন। তারাই এ জন্য বেশি উপযুক্ত ও হকদার ছিল। আল্লাহ জিনিস সম্পর্কেই পরিজ্ঞাত।’ (সূরা ফাতাহ-২৬) এ আয়াতে নবী সা:-এর সব সঙ্গী-সাথীকে মুমিনিন বলা হয়েছে। তাদের প্রতি আল্লাহ তায়ালার প্রশান্তি নাজিলের খবর দেয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, এসব লোক তাকওয়ার নীতি অনুসরণের অধিক যোগ্য ও অধিকারী।
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘মুহাজির ও আনসারদের মধ্য থেকে যারা সবার আগে ঈমানের দাওয়াত গ্রহণ করার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছে এবং যারা পরে নিষ্ঠাসহকারে তাদের অনুসরণ করেছে আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আল্লাহ তাদের জন্য এমন বাগান তৈরি করে রেখেছেন যার নি¤œদেশে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হবে এবং তারা তার মধ্যে থাকবে চিরকাল। এটিই মহা সাফল্য।’ (সূরা তাওবা-১০০)
লেখক :
প্রবন্ধকার ও গবেষক