বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর থেকেই তদন্তকারীরা এক সপ্তাহ ধরে লাশের সন্ধানে তল্লাশি চালাচ্ছে। সবশেষ মঙ্গলবার নিউ টাউনের সঞ্জিভা গার্ডেনের যে ফ্লাটে তাকে খুন করা হয়েছে সেখানকার সুয়ারেজ লাইন থেকে কিছু মাংস, চুল, চামড়া এবং হাড় উদ্ধার করা হয়েছে। তবে সেগুলো আজিমের কি না তা ফরেনসিক পরীক্ষার পরই কেবল নিশ্চিত হওয়া যাবে।
প্রশ্ন উঠেছে, আসামিদের জেরা করে এমপি আনারের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিশ্চিত হওয়া গেলেও কেন তার লাশ খুঁজে পাওয়া এত জরুরি? কেন লাশ বা দেহের যেকোনো খণ্ডিত অংশের জন্য মরিয়া হয়েছেন দুই দেশেরই তদন্ত কর্মকর্তারা?
আজিম একজন সংসদ সদস্য হওয়ায় তার লাশ না পেলে বেশ কিছু আইনি জটিলতা তৈরি হতে পারে। মামলা প্রমাণ করা, সংসদ সদস্য পদ এবং পারিবারিক ও ব্যবসায়িক সম্পত্তি সংক্রান্ত জটিলতা তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এমপি আজিম নিখোঁজের সংবাদ প্রকাশের পর ঢাকা ও কলকাতা দুই জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চারজন আসামিকে গ্রেফতার করেছে।
একইসাথে তদন্ত কর্মকর্তাদের জেরার মুখে আসামিদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী আজিমের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিশ্চিত করছে তারা। দুই দেশেই হয়েছে দু’টি মামলা।
তবে মৃত্যুর বিষয় নিশ্চিত করলেও এখনো পাওয়া যায়নি আজিমের লাশ। ফলে হত্যা মামলা প্রমাণ করা আদৌ সম্ভব কি না এমন প্রশ্নে ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লাশ পাওয়া না গেলেও মামলা প্রমাণ করা সম্ভব। তবে সেটি বেশ কঠিন।
এক্ষেত্রে মামলা প্রমাণের দায়িত্ব যেহেতু রাষ্ট্রপক্ষের থাকে, তাই যে কয়েকটি বিষয় মামলা প্রমাণে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় সেগুলোতে বেশি গুরুত্বারোপ করতে হয়।
ফৌজদারি আইন অনুযায়ী, হত্যা মামলায় আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ লাশ না পেলে এই স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে হত্যা মামলাকে প্রমাণ করা যায়। একইসাথে পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণও মামলাটি প্রমাণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লাশ না পেলেও হত্যা মামলা প্রমাণের অনেক নজির দেশে ও বিদেশে রয়েছে। এমনকি বাংলাদেশেও এ ধরনের মামলায় আসামিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ঘটনাও রয়েছে।
আইন বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থাকলে পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণে মামলা প্রমাণ করা যাবে। তবে, যদি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি না থাকে তবে মামলা প্রমাণ কঠিন হয়ে পড়বে।’
সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী তাপস কান্তি বল বিবিসি বাংলাকে ‘তদন্তকারী কর্মকর্তারা যেসব ক্লু-র ভিত্তিতে খুনের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে, সেসবসহ আসামিদের জবানবন্দি রয়েছে। ব্লাডস্টেইন, চুল এসবের ভিত্তিতে ডিএনএ টেস্টে তারা প্রমাণ করতে পারবে।’
‘বাংলাদেশেই এরশাদ শাসনামলের সময়ে একটি হত্যা মামলায় লাশ পাওয়া না গেলেও মামলা প্রমাণের পর আসামিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। আসামিদের ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও পারিপার্শ্বিক অন্যান্য সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে প্রমাণ করা গিয়েছিল।’
জাতীয় সংসদের সদস্য পদের কি হবে?
এমপি আজিম ২০০৯ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হন তিনি। ঝিনাইদহ -৪ আসনে সে সময় থেকে পরপর তিনবার সংসদ সদস্য হয়েছেন আজিম।
সংবিধানে সংসদ সদস্যদের আসন শূন্য হওয়ার অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, অনুমতি ছাড়া ৯০ কার্যদিবস সংসদের বৈঠকে অনুপস্থিত থাকলে সেই আসনটি শূন্য ঘোষণা করা হয়।
একইসাথে গেজেট প্রকাশ করে সংসদ সচিবালয় তা নির্বাচন কমিশনকে জানায়।
নির্বাচন কমিশনের ৯০ দিনের মধ্যে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতাও রয়েছে।
সাধারণত কোনো সংসদ সদস্যের মৃত্যুর পর দ্রুতই সেই আসন শূন্য ঘোষণা করা হয়। সংসদ সদস্য মারা গেলে স্পিকার শোক প্রস্তাব গ্রহণ করেন। এছাড়া অধিবেশন চলাকালে কেউ মারা গেলে ওই দিনের জন্য সংসদ অধিবেশন মুলতবি করার রেওয়াজও রয়েছে।
তবে, এখন পর্যন্ত যে সংসদ সদস্যরা মারা গেছেন, কারো ক্ষেত্রেই লাশ না পাওয়া সংক্রান্ত জটিলতা ছিল না, যেটি ঘটেছে আজিমের ক্ষেত্রে।
এ বিষয়ে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘যে দিন থেকে তার মৃত্যু নিশ্চিত হবে, সেদিন থেকে সংবিধান এবং কার্যপ্রণালী অনুযায়ী ওই আসনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। অন্যান্য সংসদ সদস্য মৃত্যুবরণ করলে যেটা হয় সেটাই হবে।’
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যাপার। অপরাধের তদন্ত হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেই সিদ্ধান্তে আসতে হবে। তারা যদি মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত নয় জানায় এরপর অনুপস্থিতির বিষয়টি বিবেচনা করে সংসদ সদস্য পদ খারিজ করতে পারবে।’
স্থাবর–অস্থাবর সম্পদের কী হবে?
নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়া হলফনামায় আজিম পেশা হিসেবে ব্যবসা ও কৃষিকে উল্লেখ করেছেন। একইসাথে হলফ-নামায় নিজের একটি গাড়ি এবং স্ত্রীর চারটি ট্রাকের তথ্য দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সহসভাপতি এমপি আনোয়ারুল আজিম। যদিও হলফনামায় নিজের বা পরিবারের কারো বাসের মালিকানার তথ্য উল্লেখ করেননি।
আজিম এবং তার স্ত্রীর এক কোটি ৬০ লাখ নগদ টাকা রয়েছে বলে হলফনামায় তথ্য দেয়া হয়েছে। প্রায় এক কোটি ২৮ লাখ টাকা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা রয়েছে।
আজিমের ৩৩ বিঘা কৃষি জমি রয়েছে। স্ত্রীর সাড়ে ২৪ শতাংশ কৃষি জমি আছে বলে হলফনামায় তথ্য দেয়া হয়েছে। এছাড়া নিজের অকৃষি জমি ১২৯ শতাংশ এবং স্ত্রীর ১৭৯ শতাংশ রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন।
এসব অকৃষি জমির মূল্য দেখানো হয়েছে ৮২ লাখ টাকার বেশি। এছাড়াও কালীগঞ্জ পৌর এলাকায় তার একটি চারতলা বাড়ির কথা হলফনামায় বলা হয়েছে।
কৃষি থেকে বছরে দুই লাখ টাকার মতো আয় আজিমের। বছরে প্রায় ৩৮ লাখ টাকা ব্যবসা থেকে আয় করেন বলে এমপি আজিম হলফনামায় উল্লেখ করেছেন। এছাড়া সংসদ সদস্য হিসেবে বেতন ও ভাতা পান বছরে প্রায় ২৪ লাখ টাকা।
ফলে আইনগতভাবে মৃত্যু নিশ্চিত না হলে এসব স্থাবর–অস্থাবর সম্পদের উত্তরাধিকার নিয়েও জটিলতা তৈরি হতে পারে।
বাংলাদেশের সাক্ষ্য আইনে বলা হয়েছে, সাত বছর কোনো ব্যক্তির কারো সাথে যোগাযোগ না থাকলে বা নিখোঁজ থাকলে তাকে মৃত বলে বিবেচনা করা হবে।
আর ব্যাংক কোম্পানি আইনে বলা হয়েছে, ব্যাংকে থাকা অর্থের উত্তরাধিকার হবেন নমিনি। মারা গেলে ডেথ সার্টিফিকেট, সাকসেশন সার্টিফিকেটের মাধ্যমে তা প্রমাণ করার পরই তাকে তা দেয়া হবে।
তবে একটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের একটি রায়ে বলা হয়েছে, নমিনি অর্থ তুলতে পারলেও তা ভাগ বা বণ্টন হবে ইসলামি শরীয়াহ আইন অনুযায়ী উত্তরাধিকারদের মধ্যে।
সাবেক একজন ব্যাংকার নুরুল আমিন বিবিসি বাংলাকে বলেন, আজিমের ঘটনা অতি পরিচিত ও আলোচিত হওয়ার কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো বিবেচনা করবে। কারণ তদন্তের বিষয়ে তারা জানতে পারছে। ফলে এতে তার পরিবারকে আইন অনুযায়ী উত্তরাধিকারকে অর্থ দিতে ব্যাংকের আপত্তি থাকার কথা নয়। সাকসেশন সার্টিফিকেট দিতে হবে তাদের। এটা দিলে তিনি মারা গেছেন এটা ব্যাংকের প্রমাণ করতে হবে না।’
সূত্র : বিবিসি