বাংলাদেশে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে এ পর্যন্ত তিনজন রোহিঙ্গার মধ্যে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ায়, আশঙ্কা করা হচ্ছে যে শিবিরের ঘিঞ্জি পরিবেশে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে। ক্যাম্পগুলোয় করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে সেইসঙ্গে আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণের কথা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
গত ২৬শে মার্চ থেকে বাংলাদেশে অঘোষিত লকডাউনের পর থেকেই ক্যাম্পগুলোয় জরুরি খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবা ছাড়া আর কোন প্রয়োজনে কাউকে ঢুকতে বা বের হতে দেয়া হচ্ছে না বলে জানায় বাংলাদেশ সরকারের শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন – আরআরআরসি।
তবে যে দুটি ব্লকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে সেখানে আগের চাইতে নিরাপত্তা বাড়ানোর কথা জানান আরআরআরসি এর সহকারী সচিব বিমল চাকমা।
তিনি বলেন, ‘যে ব্লকগুলোয় আক্রান্তরা থাকতেন সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। ওইসব এলাকার মাঝি এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তারা এই লকডাউন নজরদারি করছে। আর ক্যাম্প সব সময় লকডাউনই থাকে। যদি সংক্রমণ হয় বাইরে থেকেই হবে। তাই নিয়ন্ত্রণ সেভাবেই করা দরকার।’
শিবিরগুলোয় যেসব এনজিও কর্মী জরুরি খাদ্য সহায়তা ও স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকেন, আরআরআরসি-এর নির্দেশে এই মাঠকর্মীদের সংখ্যা কমিয়ে ২০% শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে বলেও জানা গেছে।
অর্থাৎ আগে যেখানে ১৫০০-২০০০ জন কর্মী নিয়োজিত ছিলেন – সেখানে এখন পালাক্রমে ৩০০ জন কাজ করেন।
ক্যাম্পে প্রবেশের ক্ষেত্রে এনজিও’র প্রতিটি গাড়ির বারকোড স্ক্যান করা হয় বলেও জানান ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক হাসিনা আক্তার। এই বারকোড সংগ্রহ করতে হয় সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে অনলাইনে আবেদনের মাধ্যমে। এছাড়া মাঠে কাজ স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) এবং অন্যান্যদের জন্য মাস্ক ও গ্লাভস পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
আক্তার জানান, তারা তাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের দুটি দলে ভাগ করে পালাক্রমে সেবা দিয়ে থাকেন। একটি দল টানা ১৪ দিন মাঠে সেবা দেয়ার পর, পরের ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকেন। ওই ১৪ দিন দ্বিতীয় টিম কাজ করে।
লকডাউনের আগে এই ক্যাম্পগুলোয় মাসে দুইবার ত্রাণ পৌঁছে দেয়া হলেও। এখন মাসে একবার সহায়তা দেয়া হচ্ছে যেন মাঠকর্মী ও রোহিঙ্গারা উভয়ে নিরাপদে থাকে।
আক্তার বলেন, ‘এখন যেহেতু ক্যাম্পে করোনাভাইরাস ধরা পড়েছে, এতে উদ্বেগ তো অবশ্যই বেড়েছে, কিন্তু কাজ তো বন্ধ রাখা যাবে না। এখন আমরা রেস্ট্রিকশনগুলো আরেকটু বাড়িয়েছি।’
এদিকে, যে তিন জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন তাদেরকে ফরাসী দাতব্য সংস্থা-এমএসএফ এর আইসোলেশনের ট্রিটমেন্ট সেন্টারে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের সেবায়, সেটা রোহিঙ্গা হোক বা বাঙালি, সবার জন্যই ক্যাম্পের ভেতরে ও বাইরে মোট ৬০টি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে ১১০০টি শয্যা প্রস্তুত আছে বলে জানান বিমল চাকমা। সামনে এই শয্যা সংখ্যা আরও ৮০০টি বাড়ানো হবে বলে তিনি জানান।
গুরুতর রোগীদের চিকিৎসার জন্য কক্সবাজারের ৪টি সরকারি হাসপাতালে জাতিসংঘের সহায়তায় সেবার পরিধি বাড়ানো হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। বিশেষ করে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে শুধুমাত্র কোভিড ১৯ রোগীদের জন্য অতিরিক্ত ১০টি শয্যা স্থাপন করা হয়েছে।
যদি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কারও ভেন্টিলেটরের প্রয়োজন হয় তাহলে তাকে সরকারি হাসপাতালগুলোয় স্থানান্তর করা হবে। এই স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোয় করোনাভাইরাসের টেস্টের সুবিধা রাখা হয়েছে বলেও জানান বিমল চাকমা।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা- ইউএনএইচসিআর এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মীরা করোনাভাইরাস টেস্টের কাজ করছেন। বিমল চাকমা বলেন, ‘কারো সর্দি কাশি হলেই টেস্ট করানো হচ্ছে। আমরা কোন রিস্ক নিচ্ছি না।’
ক্যাম্পে বহিরাগতদের চলাচল নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের সচেতন করতে প্রচারণা চালানো হচ্ছে বলেও তিনি জানান।
যদি আক্রান্তের সংখ্যা ১০জন ছাড়িয়ে যায় তাহলে আনুষ্ঠানিকভাবে জরুরি পরিস্থিতি ঘোষণা করে ক্যাম্পের ভেতরে চলাচল আরও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে বলে আরআরআরসি এর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
ওই সময় শুধুমাত্র স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রবেশ করতে দেয়া হবে।
এবং আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকলে ক্যাম্পের ভেতরে থাকা লার্নিং সেন্টারগুলোকে অস্থায়ী স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে বলেও জানান বিমল চাকমা।
করোনাভাইরাসের মূল শর্ত হল সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা।
এখন শিবিরগুলোর ভেতরে সারিবাঁধা ঝুপড়িতে রোহিঙ্গারা যেভাবে গাদাগাদি করে বসবাস করে, এরকম একটি পরিবেশে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে কতোটা সম্ভব সেটা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় সাংবাদিক ইসমত আরা ইসু।
তিনি জানান, রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য সচেতনতার সাধারণ বিষয়গুলো শেখানোই যেখানে কঠিন হয়ে যায় সেখানে করোনাভাইরাসের মতো সংক্রামক রোগ ঠেকাতে যে কাজগুলো করতে হয়, সেগুলো রপ্ত করানো সম্ভব হবে বলে তার মনে হয় না। যদিও করোনাভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া নিয়ে উদ্বিগ্ন নন ক্যাম্পের ভেতরে থাকা বেশিরভাগ রোহিঙ্গা।
কুতুপালং ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদ নূর জানান, কিভাবে করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে হবে সেই তথ্য তারা এনজিও কর্মীদের মাধ্যমে জানতে পেরেছেন। তারা সেগুলো মেনে চলছেন।
তারা মনে করেন যদি আইনশৃঙ্খলাবাহিনী লকডাউন ঠিকঠাক তদারকি করে, তাহলে তাদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
নূর বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাদের লোকজনের মধ্যে কোন টেনশন দেখি নাই। এটা বুঝওয়ালা মানুষ সব জানে। ছোট মাইয়া পোলা গুড়া তারা জানেনা আর কি। মজলুম জাতিরে তো আল্লাহ দেখে রাখে। টেনশন নাই।’
সূত্র : বিবিসি