শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভারতে জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় দেশটির সরকারকে ভবিষ্যৎ বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশের জনগণের সেন্টিমেন্টকেই অধিক গুরুত্ব দিতে বলা হচ্ছে। ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের দেশটির বিশ্লেষকরা সাবধান করে বলেছেন, বহুল আলোচিত সংখ্যালঘু কার্ড খেলে এ যাত্রায় ভালো ফল পাওয়া যাবে না; যা করতে হবে তা হচ্ছে বাংলাদেশীদের সেন্টিমেন্টকে গুরুত্ব দেয়া।
ভারতের অনলাইন দ্য মিন্টে দেশটির সাংবাদিক শ্বেতা সিং লিখেছেন, বাংলাদেশের তৃণমূল পর্যন্ত মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি হলো- বাংলাদেশ নয়, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের শক্তিশালী মিত্র ভারত। এ অঞ্চলে এই দল এবং সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিকেন্দ্রিক পরিচয় ভারতের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর। বাংলাদেশ থেকে নাটকীয়ভাবে দেশত্যাগ করে শেখ হাসিনা নয়াদিল্লিতে আশ্রয় নেয়ায় ভারতের জন্য কৌশলগত বড় জটিলতা সৃষ্টি করেছে। এর ফলে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে। যদি শেখ হাসিনাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফেরত চায় বাংলাদেশ তখন কী ঘটবে? দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত প্রত্যর্পণ চুক্তির ব্যতিক্রমী ধারা যদি ভারত ব্যবহার করে তাহলে তাতে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কী প্রভাব পড়বে? বাংলাদেশে কৌশলগত দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের কথা মাথায় রেখে ভারত কিভাবে এই কৌশলগত জটিলতার সমাধান করতে পারে?
শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভারতের সামনে বিকল্প কী সে সম্পর্কে শ্বেতা সিং তার নিবন্ধে স্পষ্ট করে বলেছেন, যদিও দীর্ঘদিনের বন্ধু শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়াতে চায় ভারত, কিন্তু রাজনীতি আবেগ দিয়ে পরিচালিত হয় না। রাজনীতি পরিচালিত হয় বাস্তবতা ও বিচক্ষণতা দিয়ে। বাস্তবিক রাজনীতিতে ব্যক্তিভিত্তিক রাজনীতির ঊর্ধ্বে জাতীয় স্বার্থ। ভারতের প্রতিক্রিয়া বা জবাব কী হয়, তা এখনো অনেকটা দেখার বাকি। যদি তারা প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে প্রত্যর্পণ চুক্তির ব্যতিক্রমী ধারাগুলো ব্যবহার করে তার ওপর ভিত্তি করে সেটা করতে হবে। এই ধারা নিয়ে এখনো বিতর্ক আছে। ভারত চুক্তির অনুচ্ছেদ ৬ ও অনুচ্ছেদ ৮ ব্যবহার করে তার বৈধতার ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। অনুচ্ছেদ ৬ ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র হিসেবে ‘পলিটিক্যাল ক্যারেকটার অব অফেন্স’ ব্যবহার করা যায়। এই অনুচ্ছেদ রাজনৈতিক অপরাধের ব্যতিক্রমকে অনুমোদন করে। অন্য দিকে অনুচ্ছেদ ৮-এর ১.৩’তে বলা হয়েছে- একজন ব্যক্তিকে প্রত্যর্পণ করা যাবে না, যদি তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগটি ন্যায়বিচারের স্বার্থে সরল বিশ্বাসে করা না হয়। এই দু’টি ধারা বা উপধারাই ভারত টেকনিক্যালি ব্যবহার করতে পারে, যা আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে প্রত্যর্পণে অস্বীকৃতি জানানোর পরিমাপকের মধ্যে পড়ে। তা সত্ত্বেও এটা করা হলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ওপর এর (ক্ষতিকর) পরিণতি বয়ে আনবে।
নিবন্ধে বলা হয়েছে, অনেক বছর ধরে অন্য প্রতিবেশীদের মতোই বাংলাদেশকে দেখে এসেছে ভারতের নীতিনির্ধারকরা। এখন সময় এসেছে বাংলাদেশের ভেতরে ভারতকে কী দৃষ্টিতে দেখা হয়, সে দিকে মনোযোগ দেয়ার এবং সেখানকার সেন্টিমেন্টকে স্বীকৃতি দেয়ার। সেটি করতে হবে রাজনৈতিক ও গ্রাউন্ড পর্যায় উভয় উপায়ে। তৃণমূল পর্যায়ে বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি হলো বাংলাদেশের চেয়ে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ হলো ভারতের শক্তিশালী মিত্র। এই দল ও সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিকেন্দ্রিক এই সম্পর্কের পরিচয় এ অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদে ভারতের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর। বিশেষ করে যখন চীনের সাথে স্বার্থের প্রতিযোগিতা চলছে। ভারতের নেইবারহুড ফার্স্ট পলিসি, সাগর ডকট্রিন ও অ্যাক্ট ইস্ট পলিসির জন্য বাংলাদেশ হলো কৌশলগত আঠার মতো। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিসহ বাংলাদেশের সব মূল বিরোধী দলের সাথে সব চ্যানেল ভারতের উন্মুক্ত রাখা গুরুত্বপূর্ণ নিজেদের জন্য। এই পথেই ভারতের পলিসি এস্টাবলিশমেন্ট প্রথমে সচল হয়েছে।
ওই নিবন্ধে আরো বলা হয়েছে, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশের সাথে প্রত্যর্পণ চুক্তি আছে ভারতের। আর শ্রীলঙ্কার সাথে আছে একটি প্রত্যর্পণবিষয়ক ‘অ্যারেঞ্জমেন্ট’। ২০১৩ সালে স্বাক্ষরিত হয় ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তি। তা সংশোধিত হয় ২০১৬ সালে। এ থেকে সুবিধা পেয়েছে দুই দেশই।
জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) মতো সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো চ্যালেঞ্জ ছিল বাংলাদেশের জন্য। তাদের নেতাকর্মীদেরকে পশ্চিমবঙ্গে ও আসামে লুকিয়ে থাকতে দেখা গেছে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসামের (উলফা) শীর্ষ নেতা অনুপ চেটিয়াকে ভারতের হাতে তুলে দেয় বাংলাদেশ। এই চুক্তির অধীনে বেশ কিছু বাংলাদেশী পলাতককে হস্তান্তর করা হয়। তবে এখন ভারতের নির্ভরযোগ্য কৌশলগত মিত্র শেখ হাসিনাকে ফেরতের ক্ষেত্রে পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। বাংলাদেশ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে ফেরত চায়নি। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখনো এ বিষয়টিকে অনুমাননির্ভর বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। বিষয়টি এখন কূটনৈতিক ও পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক এস্টাবলিশমেন্টের কৌশলগত চিন্তাভাবনার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে শ্বেতা সিং মনে করেন, বহুল আলোচিত সংখ্যালঘু কার্ড বাংলাদেশে ভারতের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের পক্ষে যাবে না। কারণ বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস পরিষ্কার করে বলেছেন, আওয়ামী লীগ ছাড়া বাংলাদেশের অন্য সব রাজনৈতিক দলকে ইসলামপন্থী হিসেবে বিবৃত করা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে নয়াদিল্লিকে।
তাহলে ভারত ভিন্ন কি করতে পারে? তারা কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক আইনকে একসাথে নিয়ে একটি বহুমুখী উদ্যোগ নিতে পারে। ভারতকে দেশের ভেতরে সংখ্যালঘু কার্ড খেলা থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ ভারতে স্বল্প মেয়াদে রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ বাংলাদেশে সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়টি যদি ভারত সর্বোচ্চ কূটনৈতিক চ্যানেল ব্যবহার করে তুলে ধরে তাতে ভারতের উদ্যোগ কোনোভাবেই হেয় করে না। সংক্ষেপে এ সময়ের প্রয়োজন কৌশলগত বাস্তবতা।