বৃহস্পতিবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ০২:১৬ অপরাহ্ন

ফ্যাসাদ তৈরির ‘প্ল্যান বি’ রোখা যাবে কীভাবে

আলতাফ পারভেজ
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ৩ অক্টোবর, ২০২৪
  • ৬ বার

রাজনীতি তাঁদের পেশা নয়। তাই স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র-জনতা সেপ্টেম্বর থেকেই লেখাপড়ায়, নিজ পেশায় ফিরতে চাইছেন। আগস্টে থেমে যাওয়া নিত্যদিনের রুটিনে আবার সচল হতে চাইছে সমাজ। মন বসাতে চাইছে যার যার জীবনধারায়। সময় পেলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢুকে একপলক দেশের হালহকিকতও বুঝতে চাইছে। তবে সেখানে শান্তি ও স্বস্তির বার্তা কম। উল্টো মনে হয় গণ–অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মাঝে দূরত্ব তৈরির পরিকল্পিত চেষ্টা চলছে সেখানে। ব্যাপারগুলো অবজ্ঞা করার মতোও নয়।

‘৩৭ জুলাই’ থেকে এ রকম অপচেষ্টার শুরু। একের পর এক জ্বালানি জোগানো হচ্ছে গণ–অভ্যুত্থানপরবর্তী সমাজে কোলাহল ও কলহ বাড়াতে।

প্রথমে দাবিদাওয়া তুলে ধরতে আসা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষদের হরেদরে ‘লীগ’ বলে আখ্যায়িত করা শুরু হয়। ফলে অনেক পেশার মানুষ নিজেদের দাবি নিয়ে চুপ হয়ে যেতে বাধ্য হন। দেখা গেল শ্রমিকদের ‘শিল্পবিরোধী’ জনগোষ্ঠী হিসেবে দেখানোর অপচেষ্টাও। অথচ তাদের কিছু ন্যায্য দাবি পরে ঠিকই মানা হলো। অন্য পেশাজীবীরা অতটা মরিয়া না বলে চুপচাপ বিষণ্ন হয়ে থাকছেন।

তারপর, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব তৈরির একটি চেষ্টা হলো। একটি বিশেষ দলের সেই চেষ্টা বিএনপি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এড়িয়ে গেল। কিন্তু স্বৈরাচারবিরোধী কাফেলায় ফাটল একটু থেকেই গেল।

তৃতীয় পর্যায়ে কিছু কিছু জায়গায় ‘লীগ’ তাড়ানোর নামে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের গণ–অভ্যুত্থানের পরিসর থেকে দূরে ঠেলার চেষ্টা হলো। অনলাইনে ঘোষণা দিয়ে মাজার ভাঙা শুরু হলো। প্রশ্ন ওঠানো হলো পূজার জায়গা নিয়েও। যদিও বাস্তবে এসব কয়েক শ বা হাজার মানুষের কারবার মাত্র, কিন্তু দেশে-বিদেশে এতে গণ–অভ্যুত্থানের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলো। বিদেশে দূতাবাসগুলোতে কর্মকর্তাদের সেসব নিয়ে জবাবদিহি করায় ব্যস্ত হতে হলো। অথচ মাজার, পূজা, নামাজ কিছু নিয়ে গণ–অভ্যুত্থানের দিনগুলোতে কোনো তরফে কোনো আপত্তি ছিল না। সব ধর্ম-সংস্কৃতির অনুসারীদের একসঙ্গে নিয়েই সফল হয়েছিল গণ–অভ্যুত্থান।

এর মাঝেই চতুর্থ পর্যায়ে কয়েকজন পাহাড়িকে মেরে জাতিগত দূরত্ব বাড়ানোর অপচেষ্টা হলো। পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে অনেক অসত্য ভুয়া সংবাদের ফটোকার্ডে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভরে গেল। এতেও দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের নবীন সরকার নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থায় বিস্তর প্রশ্ন উঠতে শুরু করল।

পঞ্চম পর্যায়ে খামাখাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাক্তন শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মীদের আসা-যাওয়াকে ঘিরে ‘বহিরাগত’ ইস্যু তৈরির একটা হাস্যকর চেষ্টা দেখা গেল। মনে হচ্ছে, ঢাবির ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক চরিত্র থেকে একে বিচ্ছিন্ন না করে কারও ঘুম হচ্ছে না। যেন কথিত এই ‘বহিরাগত’দের জন্য সেখানকার শিক্ষা-গবেষণা সব আটকে আছে।

ষষ্ঠত, ছাত্ররাজনীতি বন্ধের বিষয়টিতে বিতর্ক হবে জেনেও এর বাস্তবায়নে বাড়তি আগ্রহ দেখা যেতে থাকল বিশেষ মহলে। এতে শিক্ষাঙ্গনে এতদিনকার ঐক্যের পরিবেশটি অপ্রয়োজনীয়ভাবে বিধ্বস্ত হলো। একই সঙ্গে কয়েকটি মহল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘সাংস্কৃতিক যুদ্ধে’র জ্বালানি জোগানো হতে থাকল নিয়মিত। সবই হলো বা হচ্ছে ‘শহীদ’দের দোহাই দিয়ে।

জাতীয় সংগীত গেয়ে অভ্যুত্থানের পথে বহু সমাবেশ হয়েছে। কিন্তু ‘৩৭ জুলাই’ পার হতেই সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ‘ভাগ করো’ নীতির ঢেউ তোলা হলো।

জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের চরিত্র অন্তর্ভুক্তিমূলক। এ রকম সব প্রয়াসের মিলিত ফল, উদ্দেশ্য হতে পারে সেই অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্র নষ্ট করা। আরও সহজ করে বললে, প্রশাসনিক-রাজনৈতিক-সংস্কারমূলক লক্ষ্যগুলোতে বাধা তৈরি। পাশাপাশি দেশে-বিদেশে আন্দোলনের চরিত্রহনন এবং ঐক্যের জায়গাটা নষ্ট করা। এর ভিন্ন একটা ‘প্রাপ্তি’ও আছে অনেকের জন্য। এতে করে গত দেড় দশকের আমলাতন্ত্রকে মোটামুটি অক্ষত রাখা যাচ্ছে। বিশেষভাবে শত শত শহীদের ন্যায়ভিত্তিক বাজারব্যবস্থার প্রত্যাশাও পুরোপুরি আড়ালে থাকছে।

এরপর দেখছি, সুপরিচিত শিক্ষক, শিল্পী প্রমুখকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আক্রমণ। সরকার যখন এ রকম কাউকে কোনো কাজে নিয়োগ দিচ্ছে, তখন আদর্শিকভাবে পছন্দ না হলেই নিয়োগপ্রাপ্তদের কাউকে কাউকে বিতর্কিত করার পরিকল্পিত প্রচেষ্টা শুরু হলো। কোনো বিষয়ে আপত্তি তোলার জন্যও যে যোগ্যতা দরকার তার তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। প্রতিক্রিয়াশীল জমায়েত ক্ষমতার এ রকম জীবন্ত হুমকি দেখে সম্ভাব্য যোগ্যরাও সরকারের প্রয়োজনে সাড়া দিতে ইতস্তত করেন এখন। অথচ দেশ-বিদেশে বহু স্কলার এই সময় দেশ গঠনে বিনা পারিশ্রমিকে যুক্ত হতে আগ্রহী ছিলেন। আমরা দেখছি ‘মবের’ দাবির মুখে পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনের জন্য গঠিত সমন্বয় কমিটি বাতিল করে দিল। এর মানে সংস্কারের একটি উদ্যোগ শুরুতেই হোঁচট খেলো।

এই তালিকার অষ্টম প্রচেষ্টাটি বোধ হয় সবচেয়ে আত্মঘাতী। গণ–অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণের কর্তৃত্ব দাবি করে গুটিকয়েক দাবিদার সক্রিয় হয়ে গেলেন। তাদের ‘দাবি’তে মোহর দেওয়ার লোকেরও অভাব হলো না। রাজধানী থেকে জেলা শহর পর্যন্ত জুলাই-আগস্টে যে লাখ লাখ সাধারণ মানুষ আন্দোলন করেছেন, মিছিলে ছিলেন। তাঁরা অবাক হয়ে বিচ্ছিন্নতার বোধে আক্রান্ত হলেন। মনে হলো কোনো এক অদৃশ্য হাত গণ–অভ্যুত্থানের মালিকানা থেকে তাদের সরাতে নেমেছে। অথচ জনপদ থেকে জনপদে এখনো রক্তের দাগ শুকায়নি। শোকের মাতমও থামেনি।

জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের চরিত্র অন্তর্ভুক্তিমূলক। এ রকম সব প্রয়াসের মিলিত ফল, উদ্দেশ্য হতে পারে সেই অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্র নষ্ট করা। আরও সহজ করে বললে, প্রশাসনিক-রাজনৈতিক-সংস্কারমূলক লক্ষ্যগুলোতে বাধা তৈরি। পাশাপাশি দেশে-বিদেশে আন্দোলনের চরিত্রহনন এবং ঐক্যের জায়গাটা নষ্ট করা। এর ভিন্ন একটা ‘প্রাপ্তি’ও আছে অনেকের জন্য। এতে করে গত দেড় দশকের আমলাতন্ত্রকে মোটামুটি অক্ষত রাখা যাচ্ছে। বিশেষভাবে শত শত শহীদের ন্যায়ভিত্তিক বাজারব্যবস্থার প্রত্যাশাও পুরোপুরি আড়ালে থাকছে।

এ রকম সব ‘প্রকল্পে’র পার্শ্বফলও আছে। আন্দোলনের প্রতিপক্ষ শক্তি অল্প সময়ের ভেতর গণ–অভ্যুত্থানের ভবিষ্যৎকে আক্রমণ করতে পারবে বলে আশা করতেই পারে এখন। সন্দেহ করা যায় যে সমাজে ফ্যাসাদ তৈরির এই কাজগুলো হচ্ছে পুরোনো ফ্যাসিবাদী শক্তিরই নানা ভ্রাতৃপ্রতিম উপদলের। যদিও আপাতদৃষ্টিতে তা কার্যকর হচ্ছে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় নানা আদলে। সম্ভবত এটা তাদের অসামরিক প্ল্যান বি।

এ রকম বিপজ্জনক প্রবণতাগুলো রুখতে রাজনৈতিক-প্রশাসনিক শক্ত উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। ফলে জনতার মাঝে গণ–অভ্যুত্থানের অন্তর্গত শক্তি-সামর্থ্য নিয়ে সন্দেহ-অবিশ্বাস বাড়ছে। গাজীপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় ছাত্র-শ্রমিক-জনতার পুরোনো ঐক্য ধরে রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু এ–ও বেশ স্পষ্ট যে অন্তর্বর্তী সরকার নয়, বাইরের কিছু দল-গোষ্ঠী-ব্যক্তি সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করেই সব সিদ্ধান্ত দিতে চাইছে। ‘মব জাস্টিস’কেই আইন বলতে চাইছে তারা। নিজেরাই তারা ‘গণপরিষদ’ হয়ে উঠতে চাইছে। মাঠপর্যায়ে জনপ্রতিনিধি না থাকায় এক শ–দুই শ অনুসারীকে একত্র করেই অনেকে জাতীয় বিভেদ রেখা বাড়িয়ে ঘটিয়ে ফেলছেন আন্তর্জাতিক মনোযোগে আসার মতো অঘটন। হতবিহ্বল পুলিশ এসব থামানোর জায়গায় নেই আর।

এই অবস্থা রুখে নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠকে আবার সক্রিয় করতে পারে নির্দলীয় ধাঁচের স্থানীয় সরকার নির্বাচন। বিভিন্ন দলের মার্কা বাদ দিয়ে স্থানীয় সরকারের এক–দুটি স্তরে এখনই নির্বাচন দরকার। কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় প্রশাসনে দলীয় চাপ না থাকলে এ রকম নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হতে বাস্তব কোনো বাধা নেই। জাতীয় নির্বাচনকে সম্ভাব্য সংস্কারের পরের করণীয় হিসেবে রেখে স্থানীয় সমাজকে বিভেদবাদীদের হাত থেকে বাঁচাতে এখনই দরকার স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাজ করতে দেওয়া। কেবল এই পথেই ‘জুলাই-আগস্টে’র ছাত্র-জনতা ‘সমাজে’ চালকের আসন ধরে রাখতে পারবে।

  • আলতাফ পারভেজ গবেষক ও লেখক

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com