করোনা সংকটকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বলে মনে করছেন অনেকে। আর এ যুদ্ধে খাদ্য সঙ্কট এবং দুর্ভিক্ষের মোকাবিলা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সেক্ষেত্রে কৃষিই একমাত্র ভরসা। সম্ভব্য সঙ্কট থেকে রক্ষা পেতে সরকার ইতোমধ্যে দেশের এক খন্ড জমিও অনাবাদী না রাখার বিষয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে।
কিন্তু রোপা-আমন মওসুম সামনে রেখে একশ্রেণির মুনাফাখোর বীজ ব্যবসায়ী বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। তারা কৃষকদের কাছে জনপ্রিয় র্স্বণা জাতের ভারতীয় একটি ধান বীজের নামে লোকাল বিভিন্ন ধান বীজ বিক্রি করে প্রতারণা শুরু করেছে। অথচ স্বর্ণা নামে বাংলাদেশে কোনো ধান নেই। ওই মুনাফাখোর বীজ ব্যবসায়ীরা ভারতীয় ধান বীজ প্যাকেটের আদলে নকল প্যাকেট তৈরি করে বাজার থেকে ধান ক্রয় করে প্যাকেটজাত করছে। পরে তা স্বর্ণা ধানের বীজ হিসেবে বাজারে বিক্রি করছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বিভিন্ন নামকরা কোম্পানির মোড়কে নিম্নমানের ধান বীজ প্যাকেটজাত করে স্থানীয় হাট-বাজারে বিক্রি হচ্ছে। ফলে কৃষক না জেনে এসব নকল বীজ কিনে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। এতে ধানের ফলনে ধ্বস নামবে এবং কাঙ্খিত খাদ্য উৎপাদন হবে না। ফলে খাদ্য সংকট থেকেই যাবে।
এদিকে মানসম্মত বীজ না পেয়ে কৃষক দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। সরকারের কৃষি বিভাগ বিষয়টি জেনেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তেমন একটা উদ্যোগী হচ্ছে না বলে জোর অভিযোগ উঠেছে।
০৬ জুন শনিবার, সদর উপজেলার রুহিয়া থানাধীন ১৪ নং রাজাগাঁও ইউনিয়নের পাটিয়াডাঙ্গী বাজারে শতাধিক কৃষক “কৃষক বন্ধু ট্রেডার্স” নামে এক বীজ বিক্রেতার দোকান ঘেরাও করে, ঘেরাওকারি কৃষকদের অভিযোগ, লাল র্স্বণা জাতের ভারতীয় বীজের প্যাকেটে লোকাল সাদা র্স্বণা ধানের বীজ দিয়ে তাদের প্রতারিত করা হয়েছে।
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, টাইগার ব্রান্ডের র্স্বণা ধানের বীজ ও ভারত সীড নামে ধানের বীজের প্যাকেটের গায়ে উৎপাদনের তারিখ নেই, মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ নেই। এছাড়া বিএসটিআই-এর অনুমোদনও নেই৷ প্যাকেট খুলে দেখা যায়, ধান বীজের সাথে মৃত ধান, পাতলা, মাটি, ধানের খড়। এক পর্যায়ে কৃষকেরা ক্ষীপ্ত হয়ে উঠলে, অবস্থা বেগতিক বুঝে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের আশ্বাস দিয়ে “কৃষক বন্ধু ট্রেডার্সের” মালিক, আবু হোসেন দোকান বন্ধ করে শটকে পরে। ০৬ জুন, শনিবার সন্ধ্যায় স্থানীয় ইউপি মেম্বার ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা নকল বীজ পরিবর্তন করে ভাল বীজ দেয়ার সিদ্ধান্তদেয়। কিন্তু আবু হোসেন বীজ পরিবর্তন করে দেয়নি। পরে রাজাগাঁও ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ দিয়েছেন।
রুহিয়া থানার রাজাগাঁও ইউনিয়নের দিলদার সরকার ও সাদ্দাম হোসেনসহ একাধিক ভুক্তভোগী কৃষক জানান, গেল মওসুমেও আমন ধানের বীজে ভেজাল ছিল। ভাল ভেবে বীজ কেনা হলেও পরবর্তীতে ওইসব বীজ নিয়ে নানা সমস্যায় পড়তে হয়েছে। এছাড়া ফলনও হয়েছে অনেক কম। এবারও সেইসব ভেজাল বীজেই পাওয়া যাচ্ছে।
কৃষকরা জানান, সরকার স্বল্প মূল্যে সার-বীজ দেয়ার পাশাপাশি কৃষি প্রণোদনা দিচ্ছেন। কিন্তু বাজারে ভেজাল ও নকল বীজ বিক্রি হওয়ায় তা ক্রয় করে কৃষকরা প্রতারিত হচ্ছে। ফলে সরকারের দেয়া কৃষি প্রণোদনার সফলতা পাচ্ছেন না কৃষকরা। তারা বলছেন, বেশি দাম হলেও যদি কৃষকরা ভালো বীজ পেয়ে থাকেন তাহলে তাদের ফসলের উৎপাদন বেড়ে যাবে। এতে আয়ও বেড়ে যাবে। কিন্তু ভেজাল বীজে কৃষকদের পুঁজি হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাই জরুরি ভিত্তিতে ওইসব নকল বীজ বিক্রয়কারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তারা জোর দাবি জানান।
এদিকে ভেজাল ধানের বীজ নিয়ে কৃষক বন্ধু ট্রেডার্সের মালিক আবু হোসেন বলেন, বীজ টাকা দিয়েই ক্রয় করেছি, আমার কি অপরাধ?
জানা যায়, বিএডিসি ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত বীজ কেউ বাজারে বিক্রি করতে চাইলে জেলা বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির প্রত্যয়নপত্র লাগে। আবেদনের প্রেক্ষিতে তদন্ত সাপেক্ষে প্রত্যয়নপত্র দেয়া হয়। সেক্ষেত্রে বাজারে বিক্রি করতে আনা বীজের মান যাচাই-বাচই করা হয়। ওই ঘটনা ঠাকুরগাঁও জেলা বীজ প্রত্যয়ন অফিসার আবু বক্কর সিদ্দিকে জানানো হলে তিনি ঘটনাস্থান পরিদর্শন করবেন বলে জানিয়েছেন।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা কৃষি অধিদফতর সূত্র জানায়, আসন্ন মওসুমে রোপা-আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর এই আমন চাষ উপলক্ষে এখন বীজতলা তৈরি ও বীজ বপন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে আড়াইশ হেক্টর জমিতে বীজ বপনও করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বীজ ব্যবসায়ী জানান, এখানকার বাজারে বিএডিসিসহ অন্তত ৮-১০টি নামকরা কোম্পানীর বীজ পাওয়া যাচ্ছে। তবে দেখে শুনে আসল বীজ কিনতে হবে। ভালো কোম্পানীর মোড়কেই নিম্নমানের বীজ বিক্রি করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষ্ণ রায় জানান, তিনি অভিযোগ পেয়েছেন। তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।