বিশ্বজিত রায়: চা উৎপাদনে বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। চীন-ভারতের মতো উৎপাদন শীর্ষ দেশকে টপকে উৎপাদনশীলতায় তাক লাগিয়ে দিয়েছে উৎপাদনশীল অষ্টম দেশটি। এটা দেশবাসীর জন্য যেমন তুষ্টিদায়ক, তেমনি রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রেও একটি বড় অগ্রগতি। বিশ্বের ২৫টি দেশে চা রপ্তানি করা বাংলাদেশ এর মাধ্যমে নিজেদের উন্নয়ন অগ্রগতির রস আস্বাদন করতে পারবে বলে প্রতীয়মান হয়। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম এ শিল্পটি বর্তমান উৎপাদন শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে পারলে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পাশাপাশি চা-প্রিয় বাঙালির বিপুল চাহিদাও পূরণ করতে সক্ষম হবে। সিলেটের স্থানীয় একটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, বাংলাদেশে চা উৎপাদনের ১৬৫ বছরের ইতিহাসে এবার সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ড গড়েছে। চা উৎপাদনের ইতিহাসে ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ৮ কোটি ৫০ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়। কিন্তু তারপরের বছরেই উৎপাদন কমে দাঁড়ায় ৭ কোটি ৮০ লাখ কেজিতে। তবে ২০১৮ সালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮ কোটি ২০ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এবার দেশে চা উৎপাদন রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। শুধু দেশে নয়, বিগত জুলাই মাস পর্যন্ত বিশ্বের চা উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের স্থান সবার ওপরে রয়েছে। তাই এ বছরের চায়ের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ কোটি ৫০ লাখ কেজি।
১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়া চা বাগানের মাধ্যমে প্রথম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা চাষ শুরু হয়। বর্তমানে চা বোর্ডের নিবন্ধিত ১৬৬টি চা বাগান রয়েছে। এর মধ্যে মৌলভীবাজারে ৯১টি, হবিগঞ্জে ২৫টি, সিলেটে ১৯টি, চট্টগ্রামে ২২টি, পঞ্চগড়ে ৭টি, রাঙ্গামাটিতে ২টি ও ঠাকুরগাঁওয়ে ১টি চা বাগান রয়েছে। চা শিল্প বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প। জাতীয় অর্থনীতিতে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশের চা উৎপাদনের পরিমাণ বছরে প্রায় সাড়ে ৬০০ মিলিয়ন কেজি এবং এখান থেকে চা রপ্তানি করা হয় ২৫টি দেশে। চা উৎপাদনের দিক থেকে এগিয়ে আছে চীন, ভারত, কেনিয়া, শ্রীলঙ্কা। এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টমে। বাংলাদেশে চা পানকারীর সংখ্যা প্রতি বছর ৬ শতাংশ হারে বাড়ছে। চা পানে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১৬তম। চা এমন একটি পানীয়, যাতে বিশ্বব্যাপী কর্মক্লান্ত মানুষকে চাঙ্গা করার শক্তিসঞ্চারী গুণ রয়েছে। চুমুকেই বাড়তি সজীবতার জন্ম দেওয়া এ মূল্যবান পানিজাত পণ্যটির উৎপাদন সফলতা ধরে রাখা অবশ্যই জরুরি। এটি শুধু নব্বই হাজার চা শ্রমিকের অন্নের জোগানই দিয়ে যাচ্ছে না, কোটি বাঙালির চা উষ্ণ ঘোর কাটিয়ে কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি তলাবিহীন ঝুড়ির দেশটিকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সোপানে নিয়ে দাঁড় করানোর মহাগুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে।
জীবন রক্ষাকারী পানির পরই দ্বিতীয় প্রাণ সতেজিত প্রিয় পানিরকম বস্তুটির নাম হচ্ছে চা। সেই চা উৎপাদন করে বাংলাদেশ নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানির মাধ্যমে বিপুল অর্থ আয়ের সক্ষমতা দেখিয়ে যাচ্ছে। এটা সম্ভব হয়েছে চা শ্রমিকদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর সরকারি সহযোগিতার ফলে। সরকার তার নিজস্ব স্বার্থেই উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যাপারে বিশেষ মনোযোগী হবে সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু যে শ্রমিকরা দুই হাত চার আঙুলের সস্তা শ্রম বিলানো বিরতিহীন কর্মতৎপরতা চালিয়ে দেশকে অর্জনের ডোরে বেঁধে রাখল তাদের ভাগ্যের কি কোনো উন্নতি হয়েছে? চা শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়ন কিংবা ন্যায্য পাওনা কি তাদের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব হয়েছে? যাদের পরিশ্রমে বাংলাদেশ চা উৎপাদনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করল তাদের ভাগ্য আজও সেই ব্রিটিশ বিপন্নতায় বন্দি।
চীনে চা উৎপাদন দেখে ধূর্ত ব্রিটিশরা ১৮৫৪ সালে বাণিজ্যিকভাবে এ দেশে চায়ের আবাদ শুরু করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এজন্য প্রচুর শ্রমিক নিয়োগের প্রয়োজন অনুভব করে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকরা। এরই অংশ হিসেবে নানা সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে দক্ষিণ ও মধ্য ভারতের উড়িষ্যা, মাদ্রাজ, বিহার, মধ্যপ্রদেশের অভাবপীড়িত অঞ্চল থেকে হাজার হাজার মানুষকে এখানে নিয়ে আসে। পাহাড়ি ঢালু ভূমিতে চা উৎপাদন ভালো হয় বিধায় বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের পাহাড়ি গহিন জঙ্গলে এদের কঠোর পরিশ্রমী কাজ করতে বাধ্য করে তারা। পরে প্রতিশ্রুতির বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার বিপরীতে চা শ্রমিকদের ওপর চালানো হয় জুলুমবাজিতা। জোরজবরদস্তির কবলে পড়ে নিপীড়িত শ্রমিকরা একসময় আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়। শ্রমিকরা গোপনে ‘মুল্লুকে চলো’ অর্থাৎ আপন ভূমিতে ফিরে যাওয়ার আন্দোলনে শামিল হয়। কিন্তু যাওয়ার পথ জানা নেই তাদের। তারা শুধু জানতেন চাঁদপুর থেকে স্টিমারে কলকাতা যাওয়া যায়। ১৯২১ সালে দিনক্ষণ ঠিক করে কাছাড় ও সিলেটের প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক ‘মুুল্লুকে চলো’ ডাক দিয়ে পথে নামেন। ওই বছরের ২০ মে শ্রমিকরা স্টিমারে উঠতে চাইলে শ্রমিকদের ওপর চড়াও হয় ব্রিটিশ শাসিত বাহিনী। শ্রমিকরা এতে বিদ্রোহী হয়ে উঠলে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করা হয়। সেই ব্রিটিশ আমলের রক্তাক্ত ইতিহাসের বিলুপ্তি ঘটেছে। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশে পাকি রাজত্বের শোষিত সময়কাল পেরিয়ে গেলেও চা শ্রমিকের বঞ্চনা আজও ঘোচেনি।
নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত এ শ্রমিকশ্রেণি এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে জীবনযাপন করছে। চা শ্রমিকদের দুঃখ-দুর্দশার কথা লিখতে গিয়ে বলতে হয়Ñ ব্রিটিশ গেল, পাকিস্তান এলো, স্বাধীনতা পেল বাংলাদেশ; তবু হয়নি ভাগ্য পরিবর্তন ব্রিটিশ ভারতীয় এ চা শ্রমিকদের। দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক উন্নতির সুবর্ণ সময়ে এসেও একজন চা শ্রমিকের দৈনিক পারিশ্রমিকের অঙ্কটা আশ্চর্য হওয়ার মতো। এছাড়া তাদের নেই কোনো নিরাপদ কর্মপরিবেশ, নেই জীবনের নিশ্চয়তা। এভাবেই চলছে তাদের জীবন। শ্রম বিধিমালায় চা শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নসহ নানা সুযোগ-সুবিধার কথা বলা হলেও তা শুধু কাগজ-কলমেই বন্দি।
দেশে যে কয়টি খাতে শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হচ্ছে তার মধ্যে চা শ্রমিকের অবস্থান সবার ওপরে। গত বছরের ডিসেম্বরে টিআইবির ‘চা বাগানের কর্মপরিবেশ ও শ্রমিকদের অধিকার’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন বাস্তবতার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। গবেষণায় বলা হয়, দেশের উল্লেখযোগ্য ১১টি খাতের মধ্যে সবচেয়ে কম বেতনে চাকরি করে চা শ্রমিকরা। চা বাগান শ্রমিকদের সর্বশেষ চুক্তিতে দৈনিক মজুরি মাত্র ১০২ টাকা ধরা হয়েছে। গবেষণার আওতায় থাকা ৬৪টি বাগানের মধ্যে ২৮টি বাগানে অস্থায়ী শ্রমিকদের স্থায়ীদের সমান মজুরি দেওয়া হয় না। দৈনিক মজুরি ৮৫ টাকার জায়গায় ৫০-৭৫ টাকা দেওয়া হয়। আবার শ্রম আইন অনুযায়ী একজন শ্রমিক তিন মাস সন্তোষজনক শিক্ষানবিস কাল পার করার পরে স্থায়ী হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার কথা থাকলেও ৬৪টি বাগানের কোনোটিতেই তা মানা হচ্ছে না। অপরদিকে শ্রমিকরা যে পরিমাণ চা পাতা উত্তোলন করে আনে, সেখানেও হিসাবের গরমিল করা হয়। কোনো শ্রমিক ওজনের পরিমাপ নির্দেশক কাঁটা দেখার চেষ্টা করলে তাকে ধমক দিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি কেউ কাঁটা দেখতে একটু জোর করলে তাকে পরবর্তী সময় বিভিন্ন উপায়ে অলিখিত শাস্তি ভোগ করতে হয়। গবেষণা বলছে, গামছার ওজন, পরিবহনের সময় পাতা পড়ে যাওয়া, বৃষ্টি হলে পাতার ওজন বেড়ে যাওয়া এবং কোনো কারণ ছাড়াই নানা অজুহাতে পাতার ওজন কম ধরা হয়। এক সপ্তাহের একটি হিসাবে দেখা যায়, প্রায় ৩১ লাখ দুই হাজার ৪৩৫ টাকা মূল্যের চা পাতা হিসাবে কম ধরা হয়েছে।
শ্রমিক ঠকানির এ হিসাব বাদ দিলে সামনে চলে আসে সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত শ্রমিক অবহেলার নানা কথা। শ্রম বিধিমালা অনুযায়ী, প্রত্যেক চা বাগানের কাজের জায়গায় পর্যাপ্ত খাবার পানি সরবরাহের সুব্যবস্থা থাকার কথা থাকলেও কোনো বাগানেই স্থায়ী ব্যবস্থা নেই। অন্যদিকে শ্রম বিধিমালায় বাগান মালিক কর্তৃক প্রতিটি শ্রমিক ও তার পরিবারের বসবাসের জন্য বিনামূল্যে বাসগৃহের ব্যবস্থা করার কথা থাকলেও বাংলাদেশ টি বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ৩২ হাজার ২৯৯ জন স্থায়ী শ্রমিক ও অন্য অস্থায়ী শ্রমিকদের জন্য আলাদা কোনো আবাসন বরাদ্দ করা হয়নি। জরিপে উঠে এসেছে ৫১.৪ শতাংশ পরিবারের ছয় থেকে ১২ বছর বয়সি ছেলেমেয়ে রয়েছে, যার মধ্যে ৮৪.২ শতাংশ স্কুলে যায়। তবে এর মধ্যে মাত্র ২১.৫ শতাংশ যায় বাগানের স্কুলে। বাকি ৭৮.৫ শতাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, এনজিও স্কুল ও অন্যান্য স্কুলে যায়। (সূত্র : কালের কণ্ঠ, ১৯.১২.১৮)।
যাদের হাত ধরে চা উৎপাদনে রেকর্ড সৃষ্টি করল বাংলাদেশ তাদের ভাগ্য উন্নয়নে নেই কোনো প্রচেষ্টা, উদ্যোগ, অগ্রগতি। কোনো পক্ষই ভাবছে না ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী চা শ্রমিকদের কথা। রাষ্ট্র ও মালিক উভয়পক্ষই তাদের শুধু শ্রমিক হিসেবেই ব্যবহার করে আসছে। রেকর্ডের অন্যতম সারথি সেই চা শ্রমিকদের নিয়ে ভাবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে না কেউ। যাদের শ্রমে-ঘামে বাংলাদেশ আজ চা উৎপাদনে বিশ্ব রেকর্ডের মালিক তাদের প্রতি রাষ্ট্রের অনেক করণীয় আছে বলে মনে করছি। যৎসামান্য মজুরি আর অধিকারশূন্য করে শ্রমিকদের দাবিয়ে রাখা কতটা যুক্তিযুক্ত, তা নিয়ে ভেবে দেখা প্রয়োজন। শ্রমিকদের ব্যাপারে ব্রিটিশের সেই দাসপ্রথা ভুলে বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে ভাবতে হবে। যেখানে একজন দিনমজুরের ন্যূনতম মজুরি ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, সেখানে একজন চা শ্রমিককে যে পারিশ্রমিক দেওয়া হয়, তা শুধু লজ্জাজনকই নয়, রীতিমতো মানবতাবিরোধী। এ থেকে বেরিয়ে এসে চা শ্রমিকদের জীবনমান নিয়ে ভাবা দরকার।