বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) সাধারণ রোগীর চিকিৎসাসেবায় অব্যবস্থাপনা অনেক বেড়ে গেছে। ২ হাজার শয্যার বেশি হাসপাতালটিতে বর্তমানে রোগী ভর্তি আছেন মাত্র ১৩০ জন। শয্যা খালি পড়ে থাকলেও সেখানে কোনো রোগী ভর্তি হতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের সুপারিশে কাউকে ভর্তি করা হচ্ছে। সংক্রমণের ভয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও চিকিৎসকরা রোগী ভর্তি সীমিত করে। এ ছাড়া অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালটিতে সংকট রয়েছে প্রয়োজনীয় পারসোনাল প্রটেকটিভ ইক্যুইপমেন্টের (পিপিই)। মানা হচ্ছে না কোয়ারেন্টিনের নিয়মও। দেশের শীর্ষস্থানীয় চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে চিকিৎসাসেবা নিয়ে চলছে অব্যবস্থাপনা।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, বিএসএমএমইউতে মেডিসিন অনুষদ, সার্জারি অনুষদ, বেসিক সায়েন্স অ্যান্ড প্যারা-ক্লিনিকাল সায়েন্স অনুষদ, ডেন্টিস্ট্রি অনুষদ, পেডিয়াট্রিক অনুষদ, নার্সিং অনুষদ, মেডিক্যাল টেকনোলজি অনুষদ এবং প্রিভেন্টিভ ও সোশ্যাল মেডিসিন অনুষদসহ মোট আটটি অনুষদের আওতায় ৫৬টি বিভাগ রয়েছে। এসব বিভাগের আওতাধীন শয্যার সংখ্যা ১ হাজার ৯০৪টি। এর মধ্যে বিনা ভাড়ার বিছানা হচ্ছে ৭৫৮টি। এ ছাড়া ১২৪টি কেবিন এবং ২৪টি আইসিইউ ও এনআইসিইউ মিলিয়ে শয্যা রয়েছে ৯১টি। কিন্তু এসব শয্যার বিপরীতে রোগী আছেন মাত্র ১৩০ জন। করোনা সংক্রমণের ভয়ে হাসপাতালে মার্চ মাসের শেষদিকে ভর্তি সীমিত করা হয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শয্যা প্রায় তিন মাস ধরে খালি পড়ে আছে।
জানা গেছে, বিএসএমএমইউ চিকিৎসাসেবা শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান হওয়ায় একটি শয্যা বা কেবিন পেতে অনেক সময় দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়। এমনকি ৬ মাসেও শয্যা পায়নি এমন রোগীও আছেন। অথচ সেই বিএসএমএমইউতে বর্তমানে রোগী আছেন মাত্র ১৩০ জন। এর মধ্যে আইসিইউতে ২ জন, ফিভার ক্লিনিকে ১৭ জন ও কেবিন ব্লকে (৬ তলায়) ৬ জন এবং বাকি রোগী আছেন বিভিন্ন বিভাগের ওয়ার্ডগুলোয়। এর আগে গত ৫ জুন তারিখে বিএসএমএমইতে আড়াই শতাধিক রোগী ভর্তি ছিল। তার মধ্যে কেবিনে ছিল ২০ জন আর আইসিইউতে রোগী আছে মাত্র ১০ জন। এরপর ১৫ জুন তারিখে ভর্তি রোগীর সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১৫৬ জনে। ওই সময়ে আইসিইউতে ২ জন, কেবিনে ১০ জন এবং ফিভার ক্লিনিক ও সিক রুমে ৩২ জন আর বাকি রোগী ছিলেন বিভিন্ন বিভাগে। দিনে দিনে রোগী ভর্তি কমছে।
এদিকে, সরকার বারবারই দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রাখার নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু দেশের শীর্ষস্থানীয় চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ সরকারের সেই নির্দেশনা কতটা আমলে নিয়েছে, রোগীর ভর্তির চিত্র দেখলেই তা অনুমান করা যায়।
গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। সরকার করোনার রোগীর চিকিৎসায় ঢাকা ও ঢাকার বাইরে কোভিড হাসপাতাল নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। পাশাপাশি নির্দেশ দেওয়া হয় দেশের সরকারি হাসপাতালে আইসোলেশন ওয়ার্ড চালুর। কিন্তু নির্দেশ মানা হয়নি বিএসএমএমইউতে। উল্টো করোনার সংক্রমণ থেকে দূরে থাকতে এবং প্রয়োজনীয় পারসোনাল প্রটেকটিভ ইক্যুইপমেন্ট (পিপিই) না থাকার অজুহাতে মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে হাসপাতালে রোগী ভর্তি সীমিত করা হয়। এমনকি ২৫ মার্চ ও ২৬ মার্চ জটিল কিছু রোগী রেখে বাকিদের হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়া হয়। কোনো ওয়ার্ডের শতভাগ রোগীও রিলিজ দেওয়া হয়। এপ্রিল মাস থেকে বিএসএমএমইউর বেশিরভাগ বিভাগের শয্যাগুলো খালি পড়ে আছে। তবে কিছু বিভাগে ২-৩ জন করে রোগী ভর্তি রাখা হয়। কোনো ওয়ার্ডে ১০-১৫ জন রয়েছে। এভাবেই গত দুই-তিন মাস ধরে চলছে বিএসএমএমইউর চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম। বিষয়টি যেন জানাজানি না হয় সে বিষয়ে চলে কঠোর গোপনীয়তা। শুধু সংক্রমণের ভয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও চিকিৎসকরা রোগী ভর্তি সীমিত করে। তবে সরকারি নির্দেশনা মেনে বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমিত পরিসরে বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগের সেবা কার্যক্রম চালু রাখা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বিভাগের ওয়ার্ডের শতভাগ শয্যা খালি পড়ে আছে। এর মধ্যে চক্ষু বিভাগ, নাক-কান-গলা বিভাগ, কার্ডিয়াক সার্জারি, মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ ও গাইনি অনকোলজি বিভাগ। এসব ওয়ার্ডে প্রায় তিন মাস ধরে শয্যা খালি ফেলে রাখা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, বিএসএমএমইউতে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষাসামগ্রীর সংকট রয়েছে। হাসপাতালের আউটডোর ও ইনডোরে যারা চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন, তাদের কেউ কেউ সুরক্ষাসামগ্রী পাচ্ছেন না। বিশেষ করে ইনডোরের কোনো কোনো ওয়ার্ডে হ্যান্ডগ্লাভস ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার ছাড়া অন্য কোনো সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহ নেই।
মানা হচ্ছে না কোয়ারেন্টিনের নিয়ম : গত ১৩ জুন রাতে বিএসএমএমইউর ডি-ব্লকে পেডিয়াট্রিক নেফ্রোলজি ওয়ার্ডে ফাহিম (১০) নামে শিশু ভর্তি হয়। তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের সুপারিশে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার জ্বর ও ডায়রিয়ার উপসর্গ দেখা দিলে সেখানকার চিকিৎসকরা রোগীকে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করার পরামর্শ দেন। এরপর ১৭ জুন সকালে রোগী ফাহিমের কোভিড-১৯ টেস্টের জন্য নমুনা দেওয়া হয় এবং রাতে রিপোর্ট পেলে তাকে কোভিড পজিটিভ আসে। এরপর রাত ১১টার দিকে শিশুকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার করে দেওয়া হয় এবং ওয়ার্ডের অন্য রোগীদের রিলিজ দেওয়া হয়। পরদিন সকালে ১৮ জুন রোগী চলে যাওয়ার পর ওই ওয়ার্ডটি জীবাণুমুক্ত করতে কয়েকদিন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু নেফ্রোলজি ওয়ার্ড জীবাণুমুক্ত করতে বন্ধ রাখা হলেও যারা রোগীর সংস্পর্শে গেছেন তাদের কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং করা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোয়ারেন্টিন পালনের বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। উল্টো বিএসএমএমইউর ১৯ তলাবিশিষ্ট ভবন ডি-ব্লকের নার্সিং অফিসারদের দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন ডেপুটি নার্সিং সুপারিনটেনডেন্ট মেহেরুন স্বপ্না। তিনি কোভিড-১৯ রোগীর সংস্পর্শে যাওয়া নার্সকে পরদিন রাতে অন্য ওয়ার্ডে ডিউটি করতে নির্দেশ দেন।
এসব বিষয়ে জানতে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. রফিকুল আলমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমাদের দেশে করোনা বৃদ্ধির দিকে। যখন করোনা বৃদ্ধির দিকে থাকে, তখন সারাবিশ্বেই কয়েকটি বিষয় স্বীকৃত হয়ে আছে সামাজিক দূরত্ব, ঘরের বাইরে গেলে মাস্ক পরা, জনসমাগম না করা। এসব বিষয় নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। আমাদের দেশে যখন করোনা বৃদ্ধির দিকে তখন দেশের জনসংখ্যার কথা বিবেচনায় নিয়ে আমাদের আউটডোরে একটি বিভাগে চারটি রুমে আট জন চিকিৎসক রোগী দেখতেনÑ সেখানে একটু কমিয়ে আনলাম, তখন থেকে হাসপাতালে রোগী আসা কমে গেছে। যখন করোনা খুব কড়াকড়ি তখন আউটডোর সীমিত করেছি। এরপর আমরা খুলতে শুরু করলাম, আগে যেখানে চার রুমে রোগী দেখা হতোÑ এখন সেখানে প্রথমে এক রুম, পরে দুই রুমে দেখা হচ্ছে। আমরা আস্তে আস্তে পরিসর বাড়াচ্ছি।
অধ্যাপক ডা. রফিকুল আলম বলেন, ভর্তি রোগীর যে পরিসংখ্যান দিয়েছেন, সেটি সঠিক। রোগী আস্তে আস্তে বাড়তেছে। আমরাও অনলাইনে সিরিয়াল নিচ্ছি, যাতে এক সাথে অনেক লোক না আসে। যাদের চিকিৎসার প্রয়োজন তারাই যেন আসে। আমরা এসব ব্যবস্থা নিয়েছি ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে। বিষয়টি এমন নয় যে আমরা রোগী ভর্তি করব না। চিকিৎসকরা রোগী দেখতে কষ্ট হচ্ছে বা হাসপাতালে খাবার সংকট এমন কিছু নয়। আমরা রোগী বাড়াচ্ছি, আগামী কয়েকদিনের মধ্যে রোগী স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
মাস্ক সরবরাহ প্রসঙ্গে জানাতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা সবাইকে মাস্ক দিব। আমাদের অনেক মাস্ক জমা আছে। কিন্তু কোনো ওয়ার্ডে হয়তো সরবরাহে একটু ঝামেলা হচ্ছে। এগুলো ঠিক হয়ে যাচ্ছে। তারপরও আমরা বিভাগীয় চেয়ারম্যানদের নির্দেশ দিয়েছি হাসপাতাল পরিচালকের অফিস থেকে মাস্ক পেতে সমস্যা হলে বিভাগীয় ফান্ড থেকে সুরক্ষাসামগ্রী কিনে ব্যবহার করতে। সুরক্ষা ছাড়া কেউ যেন ডিউটিতে না যায়।
কোয়ারেন্টিন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অধ্যাপক ডা. রফিকুল আলম বলেন, চিকিৎসকসহ কোনো স্বাস্থ্যকর্মী কোভিড রোগীর সংস্পর্শে গেলে তাকে দুই সপ্তাহ কোয়ারেন্টিনে রাখছি। এর মধ্যে কোনো উপসর্গ দেখা গেলে তাকে পরীক্ষা করে আইসোলেশনে নিয়ে যাচ্ছি। এটি আন্তর্জাতিক নিয়ম। এ নিয়মের কোনো ব্যত্যয় না হয় সেটি দেখার জন্য নার্সিং ডিপার্টমেন্টের পরিচালককে বলেছি। এখানে মনগড়া কিছু করা যাবে না।
জানা গেছে, করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে যাওয়া রোগীর সংখ্যা একেবারেই কমেছে। হাসপাতালে গিয়ে করোনায় সংক্রমিত হতে পারে এমন ভয়ে অনেকে অসুস্থ হলেও হাসপাতাল যেতে চাচ্ছেন না। তারপরও সকল ভয়ভীতি উপেক্ষা করে যারা যাচ্ছেন তারাও সঠিক চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না। এসব বিষয় সরকারের নজরে রয়েছে। সরকার সরকারি-বেসরকারি সকল হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রাখতে নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে।