করোনা ভাইরাস মহামারীর বিস্তার ঠেকাতে ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলায় ৪৫টি অঞ্চলকে ‘রেড জোন’ ঘোষণা করে লকডাউন করা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি করোনা সংক্রমণ এলাকা ঢাকা মহানগরীর কোন অঞ্চলের কতটুকু নিয়ে ‘রেড জোন’ হবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তা চূড়ান্ত করতে কাজ করছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে পুরান ঢাকার ওয়ারী এলাকাকে আজকালের মধ্যে রেড জোন ঘোষণা করে লকডাউন করা হতে পারে। ইতোমধ্যে ওই ডেটা অ্যানালাইসিস করে একটি নকশা প্রস্তুত করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
জানা গেছে, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে পরীক্ষামূলকভাবে ঢাকা মহানগরের ওয়ারী ও রাজাবাজার এলাকা এবং ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও নরসিংদী তিনটি জেলায় রেড জোন ঘোষণা করে লকডাউন চালু করার কথা জানায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সংক্রমণের ঝুঁকি ও বেশ কিছু প্যারামিটারের ভিত্তিতে সারাদেশকে রেড জোন, ইয়েলো জোন এবং গ্রিন জোন ভাগ করার কথাও বলা হয়। এর পর সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের অনুমোদন সাপেক্ষে পূর্ব রাজাবাজার রেড জোন ঘোষণা করে লকডাউন করা হয়। আর ওয়ারী এলাকাকে আজকালের মধ্যে রেড জোন ঘোষণা করে লকডাউন করা হতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে জোনিং সিস্টেমবিষয়ক কেন্দ্রীয় কারিগরি গ্রুপের একজন সদস্য জানিয়েছেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পূর্ব রাজাবাজার এলাকাকে রেড জোন ঘোষণা করে লকডাউন করা হয়েছে। আমরা পূর্ব রাজাবাজারের অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখেছি পরিস্থিতির একটু উন্নতি হচ্ছে। এখন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ওয়ারী এলাকাকে সংক্রমণে যাবতীয় ডাটা অ্যানালাইসিস করে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছি। এটি নিয়ে বৃহস্পতিবার সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে যাবতীয় তথ্যউপাত্ত উপস্থাপন করা হবে। সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। দেখা যাক মিটিংয়ে কী হয়।
এদিকে আগামী দুই-চার দিনের মধ্যে ঢাকার রেড জোন নিয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ধাপে ধাপে সেসব এলাকায় ছুটি ঘোষণা ও অবরুদ্ধ করা হবে বলে গতকাল বুধবার জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ঢাকায় রেড জোন ঘোষণা করে ছুটি ঘোষণা করব, কিন্তু এক্ষেত্রে একটু বেশি চিন্তাভাবনা করতে হচ্ছে। কারণ রাজধানী খুব ঘন বসতিপূর্ণ এলাকা। এখানে কলকারখানা আছে, গুরুত্বপূর্ণ অফিসগুলো রয়েছে। এসব কারখানা ও অফিসগুলোকে বাঁচাতে হচ্ছে। কোন এলাকাকে কীভাবে রেড জোন হিসেবে ঘোষণা করা হবে, তা নিয়ে কাজ চলছে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, অনেক বিষয় সামনে রেখে ঢাকার রেড জোনের এলাকা নির্ধারণ করতে হচ্ছে। সব জায়গায় এক সঙ্গে বিধিনিষেধ দেওয়া যাবে না। যে জায়গায় বেশি সংক্রমণ, সেই জায়গা আগে অবরুদ্ধ করা হবে। ইকোনমি চালু রাখতে হবে, এটা আমাদের স্ট্র্যাটেজি। এর পাশাপাশি ছোট ছোট করে অঞ্চল সামর্থ্য অনুযায়ী অবরুদ্ধ করা হবে, যাতে নরমাল লাইফ বাধাগ্রস্ত না হয়।
জানা গেছে, দেশে করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সংক্রমণের মাত্রার ওপর ভিত্তি করে রেড (লাল), ইয়েলো (হলুদ) ও গ্রিন (সবুজ) জোন করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। করোনা নিয়ন্ত্রণে সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলকে রেড জোন ও মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলকে ইয়েলো জোন এবং নিম্নঝুঁঁকিপূর্ণ অঞ্চলকে গ্রিন জোন ঘোষণা করে লকডাউন করে দেওয়া হবে। করোনা প্রতিরোধে সরকারের গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি রাজধানীর ৪৫টি এলাকাকে অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় রেড জোন হিসেবে লকডাউন করার সুপারিশ করে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৮টি এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৭টি এলাকা রয়েছে।
সরকারের গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সারাদেশকে রেড জোন, ইয়েলো জোন ও গ্রিন জোনে বিভক্ত করে কার্যক্রম পরিচালনার সুপারিশ পাঠায় সরকারের কাছে।
এর পরই সরকার এ বিষয়ে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায় তা ঠিক করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় গৃহীত স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পর্যালোচনা ও সমন্বয়ের লক্ষ্যে গঠিত ৮ সদস্যের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ কমিটির কাছে মতামত চায়। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ কমিটি সংক্রমণের ধরন ভেদে আরবান এরিয়াকে রেড, ইয়েলো ও গ্রিন জোনে বিভক্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের একটি প্রতিবেদন দাখিল করে সরকারের কাছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রস্তাবিত জোনিং কার্যক্রম নিয়ে গত ৬ জুন শনিবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে আলাপ-আলোচনার পর পরীক্ষামূলকভাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ওয়ারী ও উত্তর সিটি করপোরেশনের রাজাবাজার এলাকাকে রেড জোন হিসেবে এবং ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও নরসিংদী জেলার কিছু অংশকে রেড জোন ঘোষণা করে লকডাউন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ওই সিদ্ধান্তে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের অনুমোদন সাপেক্ষে পূর্ব রাজাবাজার রেড জোন ঘোষণা করে লকডাউন করা হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর করোনার সংক্রমণ ঝুঁকির ওপর ভিত্তি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে বাংলাদেশ রিস্ক জোন বেজড কোভিড-১৯ কন্টেইনমেন্ট ইমপ্লেমেন্টেশন স্ট্র্যাটেজি/গাইড শীর্ষক একটি কৌশল গত ৯ জুন চূড়ান্ত করা হয়েছে। তাতে পূর্ববর্তী ১৪ দিনে রাজধানীর কোনো এলাকায় প্রতি লাখে ৬০ জনের অধিক করোনা রোগী শনাক্ত হলে এবং ঢাকার বাইরের কোনো এলাকায় ১০ জনের অধিক রোগী শনাক্ত হলে সেটিকে রেড জোন ঘোষণা করে লকডাউন করা হবে। একই সময়ে ঢাকার কোনো এলাকায় প্রতি লাখে ৩ থেকে ৫ জন রোগী এবং ঢাকার বাইরের কোনো এলাকায় ৩-৯ জন রোগী হলে সেই এলাকাকে ইয়েলো জোন ঘোষণা করে লকডাউন করা হবে। আর কোনো এলাকায় প্রতি লাখে ৩ জনের কম করোনা রোগী শনাক্ত হলে সেটিকে গ্রিন জোন করা হবে।
এর পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গত ১০ জুন জোনভিত্তিক লকডাউন চালু করতে দেশের সকল সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা মেয়রদের চিঠি দিয়েছে। ওই আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের কোনো কোনো জেলা-উপজেলার সংক্রমণ ঝুঁকি বিবেচনায় রেড জোন ঘোষণা করে লকডাউন করছে স্থানীয় প্রশাসন। তবে ঢাকা মহানগরসহ দেশের বেশিরভাগ জেলা-উপজেলায় জোনভিত্তিক লকডাউন চালু করতে পারেনি। সংক্রমণের ঝুঁকি অনুযায়ী ম্যাপিং না হওয়ায় জোনভিত্তিক লকডাউন কার্যক্রম আটকে রয়েছে।