বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া মানুষের দাফন ও সৎকারের জন্য এখন দেশের বেশ কিছু তৈরি পোশাক কারখানা এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠান বডিব্যাগ তৈরি করছে।
কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে বা উপসর্গ নিয়ে যারা মারা যাচ্ছেন তাদের দাফনের কাজে বডিব্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির দাফন বা সৎকারে বডিব্যাগ অত্যাবশ্যক নয়।
তবে, যেহেতু বডিব্যাগ তৈরিতে প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়, ফলে দীর্ঘ মেয়াদে সেটি পরিবেশের জন্য ঝুঁকি তৈরি করবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
বডিব্যাগ কী?
সারা পৃথিবীতে লাশ পরিবহনের জন্য বিশেষত দূর্ঘটনাজনিত কারণে মৃত্যু হলে দাফন বা সৎকারের জন্য বডিব্যাগ ব্যবহার করা হয়।
কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হবার পর, এতে আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেলে বা কোভিড-১৯-এর উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির দাফনে বডিব্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে, যে কারণে এখন অনেক বেশি শোনা যাচ্ছে এর কথা।
বিশেষত মহামারি শুরুর পর প্রথমদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা ছিল, লাশ থেকে যাতে ভাইরাস ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য বিশেষভাবে তৈরি ব্যাগে মৃত ব্যক্তির কবর দিতে হবে।
বাংলাদেশে একেবারে প্রথমদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিছু ব্যাগ সরবরাহ করে, পরে সরকারও কিছু ব্যাগ আমদানি করে।
শুরুতে লাশ বহনের যে ব্যাগগুলো ব্যবহার করা হতো, সেগুলো চীন থেকে আসত। পরে স্থানীয় উদ্যোক্তারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী দেশেই এগুলো বানাতে শুরু করেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব সাইফুল্লাহ আযম বিবিসিকে বলেছেন, এখন স্থানীয় উদ্যোক্তাদের কাছ থেকেই কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের অর্থাৎ সিএমএসডি’র মাধ্যমে বডিব্যাগ কিনছে সরকার।
কারা তৈরি করছে?
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২৮ জুন পর্যন্ত মোট ১৭৩৮ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে ৮৮৪ জন ব্যক্তির দাফন করেছে বেসরকারি সংগঠন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবীরা। প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত মোট ৭০০ জনকে নিজেদের তৈরি বডিব্যাগে দাফন করেছে।
কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের দাফন কার্যক্রমের সমন্বয়ক সালেহ আহমেদ বিবিসিকে বলেছেন, শুরুর দিকে সরকারের সরবারহ করা ব্যাগ ব্যবহার করতেন তারা।
“আমাদের একটি গবেষণা সেল আছে, তারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী বডিব্যাগের মাপ এবং গুনগত মান অনুসরণ করে একটি মডেল তৈরি করে, যা সরকারি সংস্থার কাছ থেকে আমরা পরে অনুমোদন পাই।”
“এখন আমাদের নিজেদের তৈরি বডিব্যাগেই দাফনের কাজটি করছি আমরা। এখন পর্যন্ত ১৩৯৮টি বডিব্যাগ বানিয়েছি আমরা, আরো উৎপাদন চলছে”
সাধারণত একটি বডিব্যাগের দৈর্ঘ্য সাত ফুট এবং প্রস্থ সাড়ে তিন ফুট হয়।
তবে বাংলাদেশের মানুষের গড় উচ্চতার হিসাব করে নারী ও শিশুদের আকৃতি অনুযায়ীও বডিব্যাগ তৈরি করছে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো।
দাতব্য প্রতিষ্ঠানের বাইরে তৈরি পোশাক খাতেও এখন বডিব্যাগ তৈরি করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ১২টির মতো প্রতিষ্ঠান এ কাজে যুক্ত রয়েছে। তবে ঠিক কতগুলো প্রতিষ্ঠান বডিব্যাগ তৈরি করছে, তার হিসাব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই।
বডিব্যাগ সাধারণত ওয়াটার-প্রুফ মানে পানি নিরোধক হতে হয়। এটি তৈরি করতে সাধারণত ভেতরে দুই পরতে পলি প্রোপাইলিন দিয়ে তৈরি কাপড় ব্যবহার করা হয়, যারা মাথাগুলো এমন ভাবে মুড়ে দেয়া হয়, যাতে মৃতদেহ থেকে কোন জলীয় পদার্থ বা তরল ব্যাগের বাইরে ছড়িয়ে পড়তে না পরে।
পোশাক কারখানায় একে ‘ল্যামিনেটিং’ করা বলে।
বহন করার জন্য এর চারপাশে চারটি থেকে আটটি হাতল থাকে।
সামনের অংশে চেন লাগানো থাকে।ঢাকার শ্যামলীতে ডি স্মার্ট ইউনিফর্ম সল্যুশন নামের প্রতিষ্ঠানটি বডিব্যাগ তৈরি করে মূলত কিছু দাতব্য সংস্থাকে সরবরাহ করার জন্য, যারা কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মারা ব্যক্তিদের দাফন করে থাকে।
প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মাইনুল হাসান পাটোয়ারি বিবিসিকে বলেছেন, এ পর্যন্ত দুই হাজার ব্যাগ বানানোর অর্ডার পেয়েছেন তারা।
তিনি বলছিলেন, সাধারণত একটি বডিব্যাগের দাম মান অনুযায়ী ৬৫০ টাকা থেকে শুরু করে ১৪০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের আহমেদ বলছিলেন, একটি বডিব্যাগ তৈরিতে তাদের খরচ হয় ১৩০০ টাকার মত।
সরকারি নির্দেশনা কী?
মহামারি শুরুর পর প্রথমদিকে করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়ে বা উপসর্গ নিয়ে কেউ মারা গেলে সেই ব্যক্তির দাফন ও সৎকার নিয়ে নানা ধরণের স্টিগমা ও ভীতি রয়েছে জনমনে।
এ কারণে, মারা যাওয়ার দীর্ঘ সময় পরেও লাশ সরানো বা দাফন না হওয়ার নানা ঘটনা শোনা গেছে গত কয়েক মাসে। মৃত ব্যক্তির শরীর থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়বে, এ কথা শোনা গিয়েছিল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে বা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির দাফনে বিশেষ সতর্কতার কথা বলেছিল। যে কারণে কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তির দাফনে আলাদা কবরস্থান নির্ধারিত করা হয়েছিল।
কিন্তু জুন মাসের তিন তারিখে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে যে, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার তিন ঘণ্টা পর ওই লাশে আর ভাইরাসটির কোনো কার্যকারিতা থাকে না, ফলে লাশ থেকে এই ভাইরাস ছড়ানোর কোন আশঙ্কা নেই।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিষয়ক নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, এ কারণে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কেউ মারা গেলে তাকে স্বাস্থ্য নির্দেশনা মেনে, নিজ ধর্ম মেনে দাফন বা সৎকার কিংবা পারিবারিক কবরস্থানেই তাকে দাফন করা যাবে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব সাইফুল্লাহ আযম বিবিসিকে বলেছেন, শুরুতে মানুষের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে যত ভীতি ছিল, সেটা কিছুটা কমেছে।
তিনি বলেছেন, সরকারি নির্দেশনা হচ্ছে, স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে লাশের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে বডি ব্যাগ বা সেটা না পাওয়া গেলে পলিথিনে মুড়ে দাফন করা যাবে।
এক্ষেত্রে লাশ দাফন বা শেষকৃত্যের জন্য নির্ধারিত কবরস্থান বা পারিবারিকভাবে নির্ধারিত স্থানে দাফন ও শেষকৃত্য করা যায়।
“বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, এখনো পর্যন্ত এটা প্রমাণিত হয়নি যে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির দেহ থেকে সুস্থ কোনো ব্যক্তির মধ্যে এ ভাইরাস ছড়ায়। তাছাড়া রোগী হাসপাতালে মারা গেলে আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শেষ করে তার দাফন বা সৎকার প্রক্রিয়া শুরু করতে তিন চার ঘণ্টা সময় লেগেই যায়। ততক্ষণে লাশে এই ভাইরাসের কার্যকারিতা থাকে না। ফলে আতঙ্কিত না হয়ে একজন মৃত ব্যক্তিকে সম্মানের সঙ্গে বিদায় জানানোর কথা ভাবতে হবে।”
পরিবেশগত ঝুঁকি তৈরি করবে?
করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হবার পর থেকে এর ফলে স্বাস্থ্য খাত এবং অর্থনীতি নিয়ে অনেক আলাপ হয়েছে।
কিন্তু এই মহামারির ফলে পরিবেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন পরিবেশবিদেরা।
বিশ্লেষকদের অনেকেই বলেছেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির দাফনে যে বডিব্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে, তার অন্যতম উপকরণ হচ্ছে পলিথিনের কাঁচামাল পলি প্রোপাইলিন, যা মাটিতে মিশে যায় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক নাসরিন রফিক বলছেন, “মহামারির কারণে মানুষ অনেক ভীত ও বিহ্বল অবস্থায় রয়েছে, যে কারণে এখনো এদিকে দৃষ্টি যায়নি লোকের। কিন্তু এই বডিব্যাগের কারণে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হবে, কারণ এটা বায়ো-ডিগ্রেডেবল নয়।”
তবে, কত মানুষ মারা যাবে, তার ওপর পরিবেশের এই ক্ষতির পরিমাণ নির্ভর করবে, বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সন্দেহ নেই দীর্ঘদিন এই ক্ষতি বহন করতে হবে পৃথিবীকে। কারণ ব্যবহৃত পলিথিনের পরিত্যক্ত অংশ দীর্ঘদিন অপরিবর্তিত ও অবিকৃত অবস্থায় থেকে মাটি ও পানি দূষিত করে। পলিথিন জাতীয় পদার্থ মাটির উর্বরতা হ্রাস করে ও মাটির গুনাগুণ পরিবর্তন করে ফেলে।”
সূত্র : বিবিসি