সারওয়ার মো: সাইফুল্লাহ খালেদ:
লোভ নানা প্রকার। কারো অর্থের লোভ, কারো সম্পত্তির লোভ, কারো ক্ষমতার লোভ, কারো সাম্রাজ্যের লোভ, আর কারো পরস্ত্রীর লোভ। কারো বিভিন্ন এলাকা বা অঞ্চলে প্রভাববিস্তারের লোভ ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে নানা উদাহরণ ও নানা মনীষীর উক্তি উল্লেখ করা যায়। এ নিবন্ধে আমি তাই করব। তবে এ কথাও উল্লেখ্য, নির্লোভ ত্যাগী লোকেরও এ জগতে অভাব নেই।
মীর মশাররফ হোসেন তার ‘বিষাদ সিন্ধু’ গ্রন্থে বলেন, ‘প্রণয়, স্ত্রী, রাজ্য, ধনÑ এ কয়টি বিষয়ের লোভ বড় ভয়ানক। এই লোভে লোকের ধর্ম, পুণ্য, সাধুতা, পবিত্রতা একেবারে সমূলেই বিনাশপ্রাপ্ত হয় (১৯৯৮, পৃষ্ঠা ৭৭)। সে যাই হোক, এ লোভ চরিতার্থ করার জন্য লোভী মানুষ মানুষের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন করতে ও নানা ছলনার আশ্রয় নিতেও দ্বিধা করে না। লোভ থেকে হিংসা; হিংসা থেকে অশান্তি জন্ম নেয়। এই অশান্তি আজ বিশ্বময় ছড়িয়ে গেছে।
প্রথমে অর্থের লোভের কথা বলি। এ কথা সবাই জানে, সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো পৃথিবীর সব দরিদ্র দেশকে নিজেদের প্রভাব বলয়ে নেয়ার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করে। তাদের ভাবাদর্শ দরিদ্র দেশগুলোর ওপর চাপিয়ে দেয়ার জন্য তারা দরিদ্র দেশের শাসক শ্রেণীকে হাত করতে এ অর্থ ব্যয় করে। উদাহরণস্বরূপ অনেক দেশের মধ্যে আমার দেখা পাকিস্তানের কথা উল্লেখ করতে পারি। এ দেশটি ইসলামিক রিপাবলিক হওয়া সত্ত্বেও জন্মলগ্ন থেকে ষাটের দশকের শেষাবধি পাশ্চাত্য স্টাইলে নাইট ক্লাব কালচার চালু রেখেছিল। পরে যখন ৭০-এর দশকে এসব বন্ধ করে দেয়া হলো, তখন থেকে এ দেশটি পাশ্চাত্য দেশগুলোর রোষানলে পড়ল। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব উপেক্ষা করে অনুমতি ছাড়াই সে দেশের ভেতরে ঢুকে নিজেদের সেনা সদস্য ব্যবহার করে ইসলামপন্থী বিন লাদেনকে হত্যা করে। পাকিস্তানে এখনো মার্কিন সেনা মোতায়েন রয়েছে। এর পেছনে যে কারণ তা হচ্ছে, পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রচুর অর্থ সাহায্য পেয়েছিল। এ তো গেল রাষ্ট্রপর্যায়ে অর্থলোভের কথা। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের সরকারগুলো ভিন্নমতাবলম্বী দমন করার জন্য এবং নিজ দেশে একটি তাঁবেদার গোষ্ঠী গড়ে তোলার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করে। ‘হায়রে অর্থ! হায় রে পাতকী অর্থ! তুই জগতের সকল অনর্থের মূল’ (বিষাদ সিন্ধু, ১৯৯৮, পৃষ্ঠা-১৩৭)। তবে জগতে নির্লোভ লোকের সংখ্যাও কম নয়। তারা যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত, তবু অর্থের লোভের কাছে মাথানত করেন না। এখানে রাষ্ট্রপর্যায়ে লিবিয়ার গাদ্দাফি, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, চিলির সালভেদর আলেন্দে প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়।
ক্ষমতার লোভের উদাহরণ দেশে দেশে পাওয়া যায়। আমার নিজ দেশ বাংলাদেশ থেকেই এমন লোভের প্রমাণ দেয়া যায়। যেমন, এ দেশের একাধিক সরকার বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতার লোভে সব নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে অনৈতিক উপায়ে ক্ষমতায় এসেছে। অপর দিকে, মিসরের খলিল এল-সিসি বৈধভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র্রের জর্জ ডব্লিউ বুশ জুনিয়র বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে দ্বিতীয় টার্মে ক্ষমতায় এসেছিলেন। এরূপ উদাহরণ দেশে দেশে কম নয়। সাম্রাজ্যের লোভে ইউরোপের পরাশক্তিগুলো দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধ ঘটিয়ে অসংখ্য নিরীহ মানুষের প্রাণ সংহার করেছে। বর্তমান বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে এশিয়ার অপর পরাশক্তি চীনের সাথে প্রতিযোগিতা করতে অঢেল অর্থ ব্যয় করছে এবং নিত্যনতুন আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হচ্ছে। এসব করছে তারা নিজেদের বাণিজ্য ও এসব অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের লোভে, অথচ এসব অর্থের আংশিক ব্যয় করলেও বিশ্ব থেকে অনেক আগেই দারিদ্র্য বিদায় নিতো। এতদসত্ত্বেও দেশে দেশে এমনকি বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোতেও তাদের মুরব্বিদের সহায়তা করার জন্য অস্ত্র প্রতিযোগিতা বাড়াচ্ছে। ভারত, পাকিস্তান সেই ১৯৪৭ সালে জন্মলগ্ন থেকেই কাশ্মির প্রশ্নে তিনটি যুদ্ধ করেছে। দুটি দেশে প্রচুর দরিদ্র লোক থাকা সত্ত্বেও তারা অস্ত্র প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের অভিশাপে ভুগছে অসংখ্য মানুষ।
পরস্ত্রীর লোভ সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয়, ব্রিটেনের এক রাজকুমার সে দেশের এক ব্রিগেডিয়ারের স্ত্রীকে প্রেমে জড়িয়ে বিয়ে করেছেন। সেই রাজকুমারের স্ত্রী প্রিন্সেস ডায়নাকে প্রেমে জড়ান লন্ডনের ডিপার্টমেন্টাল স্টোর হেরডসের বিলিওনিয়ার মালিকের পুত্র দোদি ফাহাদ। পরে প্যারিসের রাজপথে সড়ক দুর্ঘটনায় উভয়েই মৃত্যুবরণ করেন। এ জাতীয় পরস্ত্রী লোভের ঘটনা বাংলাদেশেও ঘটছে। তবে মুসলিম দেশে এরূপ আচরণ নিন্দনীয়। ‘ভাবিয়া দেখো দেখি, ধর্মপুস্তকের উপদেশ কী? পরস্ত্রীর প্রতি কুভাবে যে একবার দৃষ্টি করিবে, কোনো প্রকার কুভাবের কথা মনেরমধ্যে একবার উদিত করিবে, তাহার তো প্রধান নরক জাহান্নামে বাস হইবে।’ (বিষাদ সিন্ধু, ১৯৯৮, পৃষ্ঠা-৩)। পরধন লোভের উদাহরণ টানতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে নিহত প্রেসিডেন্ট কেনেডির স্ত্রী জেকুলিন কেনেডি ৩৯ বছর বয়সে ৬২ বছর বয়সের গ্রিসের শিপিং ম্যাগনেট এরিস্টটল উনাসিসকে বিয়ে করেছিলেন। এর কিছুদিন পর ৬৯ বছর বয়সে ওনাসিস মারা গেলে জেকুলিন ওনাসিসের বিপুল বিত্তের উত্তরাধিকারী হন।
কারো বিভিন্ন এলাকা বা অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের লোভ সম্পর্কে উপরে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর কথা উল্লেখ করেছি। বিভিন্ন দেশে বিশেষত অনুন্নত দেশগুলোতে অহরহ দেখা যায় পাড়া-মহল্লা বা অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে বিভিন্ন দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও এর থেকে উদ্ভূত রেষারেষি ও হানাহানির ঘটনা।
এর পেছনে শুধু ক্ষমতা বিস্তারের লোভই নয়, অর্থ অর্জনের লোভও কাজ করে। ক্ষেত্রবিশেষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। বিশেষত বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ নিতে এসব প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন দলের ছাত্র সংগঠনের মধ্যে প্রাণঘাতী প্রতিযোগিতা চলে। এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার পরিবেশ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। এ প্রতিযোগিতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দলবাজ শিক্ষক ও ক্ষমতাসীন দলের সক্রিয় সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা থাকে বলে এই প্রতিযোগিতায় পুরো ক্যাম্পাস সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এ কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী রাজনীতি বন্ধ করে দেয়ার জন্য শুভবুদ্ধিসম্পন্ন শিক্ষক, অভিভাবক ও দেশের সচেতন নাগরিকসমাজ বিভিন্ন সময়ে সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েও বিফল হয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলো এবং সরকার শিক্ষার্থীদের স্বীয় স্বার্থে কাজে লাগানোর জন্য তা বন্ধ করতে নারাজ। ছাত্র সংগঠনগুলো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে সমর্থন দিতে গিয়ে অর্থ উপার্জনের জন্য টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও ভালো চাকরির সুযোগ পায়। এমনটা পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশে রাজনীতি নিরপেক্ষ তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকারের আমলেও ছিল না। তখন মেধাবীরা চাকরি-বাকরির অবাধ সুযোগ পেত, যেটা বাংলাদেশে দলীয় সরকারের আমলে চাকরি প্রার্থীরা পায় না। এতে করে অযোগ্য লোকেরা চাকরিতে প্রবেশ করে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে সরকারি দলের নেতাদের তোষামোদ করে ও রাজনৈতিক নেতাদের নান্দিপাঠ করে পার পেয়ে যায়; সৎ ও কর্মঠ মেধাবী কর্মকর্তাদের চাকরিজীবনে প্রায় সব দিক থেকেই বঞ্চিত হতে দেখা যায়।
সুতরাং লোভ মানবজীবনের নানা ক্ষেত্রেই মানুষকে বিপথগামী করে এবং সমাজে নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ বৈষম্যের শিকার হয় যাতে করে দেশ ও ব্যক্তিবিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাজনীতিক নেতারা দলীয় ও ব্যক্তি স্বার্থে সে দিকে নজর দিতে চান না। এতে করে নানা অনুন্নত দেশে এমনকি উন্নত দেশেও জীবনের সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি সর্বগ্রাসী রূপ নেয়। ভারতের জাতির পিতা গান্ধীর একটি উক্তির বাংলা করলে এরূপ দাঁড়ায়- ‘পৃথিবীতে সম্পদ অফুরান কিন্তু লোভীদের জন্য তা অপর্যাপ্ত’। রবিঠাকুর তার ’দুই বিঘা জমি’ কবিতায় ধনীদের সম্পদলিপ্সার ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন- ‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি,/রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি’।
শহিদুল্লাহ কায়সারের ‘সংসপ্তক’ নাটকে জমিদার মিয়ার বেটাকে উচ্চারণ করতে শোনা যায়, ‘টাকা, নইলে জমি আমার চাই’। গরিব লোককে বঞ্চিত করে, প্রতারিত করে কিংবা শোষণ করে এসব লোভী লোক সম্পদের পাহাড় গড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো ধনী দেশেও শোষণের শিকার হয়ে আজো বিস্তর দরিদ্র লোক আছে। পুঁজিবাদী দেশে এ সব দরিদ্র লোক কোনো দিনই দারিদ্র্যমুক্ত হবে না। অথচ ইসলামী রাষ্ট্রের পঞ্চম খলিফা আবদুল আজিজের শাসনকালে তার দেশে একপর্যায়ে জাকাত নেয়ার মতো দরিদ্র লোক পাওয়া যেত না। আজকের দুনিয়ায় এমনকি মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোতেও যুগের পর যুগ দরিদ্র লোক থেকে যাচ্ছে, অথচ এ সব দেশের নেতারা পশ্চিমা মডেল যা উন্নত দেশেও দারিদ্র্য নির্মূলে অকার্যকর তা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কার্যক্রমে কাজে লাগাচ্ছে, কিন্তু দারিদ্র্য মোচন হচ্ছে না। বরং ধনীদের খাই মেটাতে গিয়ে ধনবৈষম্য বাড়ছে।
লেখক : অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক