মুন্সীগঞ্জ সদরের মিরকাদিম পৌরসভার রিকাবীবাজার পশ্চিমপাড়ার দিদার হোসেন (৪৫) ও বোন হাফসা আক্তার রুমা (৪০) অসুস্থ বোনজামাইকে দেখতে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। গতকাল সোমবার সকালে সদরের মিরকাদিম নদীবন্দরের লঞ্চঘাট থেকে মর্নিংবার্ড নামে লঞ্চে চড়েন। বোনজামাইকে দেখে আবার ওইদিনই বাড়িতে ফিরে আসার কথা ছিল। ফিরেছেন ঠিকই, কিন্তু দেহে তাদের আর প্রাণ নেই। রাজধানীর শ্যামবাজারসংলগ্ন বুড়িগঙ্গায় লঞ্চডুবিতে মৃত্যুর মিছিলে ছিলেন তারও দুজন।
মাত্র সাত মাস আগে বিয়ে করেছিলেন দিদার। স্বামীর মৃত্যুর খবরে তাই ক্ষণে ক্ষণে মূর্ছা যাচ্ছেন নববধূ রেশমা বেগম। বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে ভাই-বোনের মরদেহ বাড়িতে পৌঁছলে স্বজনদের কান্না ও আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে বাতাস। পুরো বাড়িতে শোকের মাতম। চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি তাদের দেখতে আসা মানুষজনও।
দোকানের মালামাল কিনতে রাজধানীতে যাচ্ছিলেন একই এলাকার হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী শিপলু মিয়া (২৩)। পথিমধ্যে লঞ্চডুবিতে লাশ হতে হয়েছে তাকেও। তিনিও বিয়ে করেছিলেন বছর দুয়েক আগে। স্বামীর মৃত্যুর খবর বাড়ি পৌঁছতেই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন স্ত্রী জাকিয়া সুলতানা। ১১ মাস বয়সী কন্যাসন্তানকে কোলে নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে চারদিকে তাকিয়ে বেড়াচ্ছেন, কখন আসবে প্রিয়তম। অন্যের ঘারে চড়ে নিথর শিপলু এলেন। তবু জাকিয়ার যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না স্বামী আর কথা বলবেন না, ডাকাডাকি করবেন না প্রয়োজনে-অপ্রোয়জনে। বাড়িতে চলছে কান্নার রোল। সবই যেন স্বপ্ন মনে হয় জাকিয়ার।
একই এলাকার সুফিয়া বেগম (৫৫) ও তার মেয়ে সোমা বেগম (২৫) যাচ্ছিলেন সদরঘাটের সুমনা ক্লিনিকে ডাক্তার দেখাতে। লঞ্চডুবিতে মেয়ে প্রাণে বেঁচে গেলেও মা চলে গেছেন না ফেরার দেশে। নিহত সুফিয়া বেগম রিকাবীবাজার পশ্চিমপাড়ার পরশ মিয়ার স্ত্রী। লঞ্চডুবিতে ওই এলাকার অন্তত সাতজনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া জেলা সদরের গোয়ালঘূর্ণি, টঙ্গিবাড়ী উপজেলার আব্দুল্লাহপুর, দিঘীরপাড় এলাকারও অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন এ ঘটনায়।
টঙ্গিবাড়ী উপজেলার আব্দুল্লাহপুর সলিমাবাদ গ্রামের কাপড় ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মনিরেরও (৪৫) মৃত্যু হয়েছে। সকালে মর্নিংবার্ড নামে লঞ্চে চড়ে ঢাকার ইসলামপুরে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুর খবরে পুরো পরিবারেই চলছে শোকের মাতম। একই ঘটনায় ইসলামপুরের কাপড় ব্যবসায়ী উজ্জল মাদবরের মৃত্যুর খবরে কান্নার রোল পড়ে জেলা শহরের মালপাড়া এলাকার তার বাড়িতে। বিকাল ৪টার দিকে বাড়িতে মরদেহ পৌঁছলে স্বজনদের আহাজারিতে সেখানকার বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। দুই মেয়ে তানহা ও তোহা এবং স্ত্রী সাফিয়া আক্তার বারবার মূর্ছা যাচ্ছিল। বিলাপ করতে করতেই সাফিয়া আক্তার জানান, প্রতিদিন সকালে শহরের মালপাড়া এলাকার বাড়ি থেকে বের হয়ে ইসলামপুরের উদ্দেশে ছুটে গিয়েছিলেন তার স্বামী; কিন্তু ফিরলেন প্রাণহীন হয়ে।
লঞ্চডুবিতে নিখোঁজ টঙ্গিবাড়ী উপজেলার আব্দুল্লাহপুর গ্রামের সুমন বেপারীর (৩৫) বাড়িতেও চলছে শোকের মাতম। আট ভাই ও এক বোনের সবার ছোট সুমন। বাবা ফজল বেপারি বেঁচে নেই। ফজরের নামাজ আদায় শেষে প্রতিদিনের মতোই গতকাল সকালে মায়ের সঙ্গে শেষ কথা বলে বাড়ি থেকে বের হন সুমন। ঢাকার সদরঘাটের বাদামতলীর ফল ফট্টিতে তিনি ফল বিক্রি করেন। তার ভাতিজা আরাফাত রায়হান সাকিব জানান, বাড়ি থেকে অটোরিকশায় করে মুন্সীগঞ্জ সদরের মিরকাদিম নদীবন্দরের লঞ্চঘাটে এসেছিলেন। সেখান থেকে মর্নিংবার্র্ড লঞ্চে চড়েন সদরঘাটের উদ্দেশে। ফল বিক্রি শেষে প্রতিদিনই বিকালে ফিরে আসেন নিজ বাড়িতে। আবারো দেখা হয় মায়ের সঙ্গে, কথা হয়। কিন্তু ৭০ বছরের বৃদ্ধা মা আমেনা বেগমের সঙ্গে কি আর কখনই দেখা হবে না সুমন বেপারির?