অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে শতকোটি টাকার বেশি আত্মসাতের অভিযোগে ১৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার সুপারিশ জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর চিঠি দিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ছয় মাস পর অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। এর পর গত ২৪ জুন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে দুদকের সুপারিশ বাস্তবায়নে দেশের সব সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল এবং সিভিল সার্জন অফিসে চিঠি পাঠানো হয়।
জানা গেছে, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, নিম্নমানের যন্ত্রপাতি সরবরাহ, যন্ত্রপাতি না দিয়ে বিল উত্তোলনের মাধ্যমে শতকোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ১৪টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। এর পর মামলার এজাহারের কপি ও অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে কালো তালিকাভুক্ত করার সুপারিশ তুলে ধরে গত বছরের ১২ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে চিঠি দেয় দুদক। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে গত ৯ জুন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে চিঠি পাঠানো হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব (ক্রয় ও সংগ্রহ অধিশাখা) হাসান মাহমুদ স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, দুদকের সুপারিশের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হলো। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের চিঠি পাওয়ার পর গত ২৪ জুন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. বেলাল হোসেন এ বিষয়ে প্রয়োজনীয়
ব্যবস্থা নিতে দেশের সব সরকারি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ, সিএমএসডির পরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক/লাইন ডিরেক্টর, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক, বিশেষায়িত হাসপাতালের পরিচালক, বিভাগীয় পরিচালক, সিভিল সার্জন ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে চিঠি দেন। চিঠিতে ১৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তালিকাও পাঠানো হয়।
মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দপ্তরে পাঠানো দুদকের সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখতের চিঠিতে বলা হয়েছিল- অনুসন্ধানে দেখা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগশাজসে কতিপয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও বাজারমূল্য থেকে অনেক বেশি মূল্যে এমএসআর সামগ্রী, ভারী যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য মেশিনারিজ ক্রয় করে থাকে। এমনকি কোনো কোনো সময় মালামাল সরবরাহ না করে বিল উত্তোলন করে থাকে। অসাধু ঠিকাদাররা সিন্ডিকেট করে টেন্ডারে অংশগ্রহণ করে থাকে এবং সিন্ডিকেটের কারণে প্রতিযোগিতামূলক দর না পাওয়ায় বাজারমূল্য থেকে কয়েকগুণ বেশি দামে মালামাল ক্রয় করতে হয়। এ কারণে বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ ক্ষতিসাধনের মাধ্যমে আত্মসাতের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে দুদক কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। সরকারি অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণসহ ক্রয় কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনয়ন, এই ধরনের দুর্নীতি, অনিয়ম, প্রতারণামূলক কার্যক্রম প্রতিরোধে এসব প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করা দরকার বলে দুদক মনে করে।
জানা গেছে, অভিযুক্ত ১৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুর্নীতিবাজ কর্মচারী দম্পতি আফজাল হোসেন ও তার স্ত্রী রুবিনা খানমের প্রতিষ্ঠান রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশানাল ও রুপা ফ্যাশন রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ১০০ কোটি ১২ লাখ ৬১ হাজারের বেশি টাকা অনিয়ম-দুর্নীতি ও মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগে মামলা করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠান দুটির বিরুদ্ধে সরকারি হাসপাতালে এমএসআর ও ইকুইপমেন্ট ক্রয়ের ৫ কোটি ৯০ লাখ ২৮ হাজার ৯২৬ টাকা আত্মসাৎ ও ৩১ কোটি ৫০ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করা হয়। এ ছাড়া রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশানালের মালিকের বিরুদ্ধে কক্সবাজার সরকারি হাসপাতালের ৩৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগে মামলা করা হয়।
রাজধানীর তোপখানা রোডের বেঙ্গল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড সার্জিক্যাল কোম্পানির মালিক জাহের উদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ১৬ কোটি ৬১ লাখ ৩১ হাজার ৮২৭ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ৪ কোটি ৪৮ লাখ ৮৯ হাজার ৩০০ টাকা আত্মসাতের অভিযোগেও মামলা হয়েছে।
রাজধানীর মার্কেন্টাইল ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক আব্দুস সাত্তার ও আহসান হাবীব, বেঙ্গল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড সার্জিক্যাল কোম্পানির মালিক জাহের উদ্দিন সরকার এবং ইউনিভার্সেল ট্রেড করপোরেশনের মালিক আসাদুর রহমানের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ৬ কোটি ৬ লাখ ৯৯ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করা হয়। গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর বাসিন্দা আহমেদ এন্টারপ্রাইজের মুন্সী ফারুক হোসেন, বেঙ্গল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড সার্জিক্যাল কোম্পানির মালিক জাহের উদ্দিন সরকার এবং বনানীর এএসএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফতাব আহমেদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে যন্ত্রপাতি ক্রয়ের নামে ৯ কোটি ১৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করা হয়।
অনিক ট্রেডার্স ও আহমেদ এন্টারপ্রাইজের মালিক গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর বাসিন্দা আব্দুল্লাহ আল মামুন ও মুন্সী ফাররুখ হোসাইন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগশাজস করে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইকুইপমেন্ট ক্রয়ের নামে ১০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন।
রংপুর হাজিপাড়ার বাসিন্দা ম্যানিলা মেডিসিন এবং এসকে ট্রেডার্সের মালিক মনজুর আহমেদ, এইচএ ফার্মার মালিক মোসাদ্দেক হোসেন, অভি ড্রাগসের মালিক জয়নাল আবেদীন, আলবিরা ফার্মেসির মালিক আলমগীর হোসেন এবং এসএম ট্রেডার্সের মালিক মিন্টুর বিরুদ্ধে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে সিন্ডিকেট করে এমএসআর ও পথ্য খাতের ৮ কোটি ৬১ লাখ ১৭ হাজার ৭৩৮ টাকা আত্মসাৎসহ টেন্ডার ছাড়াই ৯ কোটি ৫৩ লাখ ৬১ হাজার ৩৬ টাকার এমএসআর সামগ্রী ক্রয়ের অভিযোগে মামলা হয়।
ঢাকার ব্লেয়ার এভিয়েশনের মালিক মোকছেদুল ইসলাম বরাদ্দকৃত অর্থের ৭৪ লাখ ৯৮ হাজার ৫০ টাকার কাজ না করে মিথ্যা ব্যয় দেখিয়ে ভ্যাট ও ট্যাক্সসহ ৮৭ লাখ ৪৯ হাজার ৮২৫টা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা হয়েছে।
স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে বর্তমান কমিশন প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক বেশকিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ২০১৯ সালের শুরুতে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির ১১টি উৎস চিহ্নিত ও তা নিয়ন্ত্রণে ২৫ দফা সুনির্দিষ্ট সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও সচিবের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এই পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন বাস্তবায়ন করা গেলে হয়তো স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির লাগাম কিছুটা হলেও টেনে ধরা সম্ভব হতো। এ ছাড়া ঢাকা, সাতক্ষীরা, রংপুর, চট্টগ্রাম, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাসামগ্রী ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগেও কমিশন থেকে ১১টি মামলা হয়। তবে অনুসন্ধান এখনো শেষ হয়নি।