নেপোলিয়ন বোনাপার্টের ১৬ জন সভাসদের ওপর তার শেষ উপদেশ ছিল এরকম- ক. দেশের ১০ জন সেরা ডাক্তার যেন তার মৃত্যুর পর শবদেহ গোরস্থানে বহন করেন। খ. কফিনের দু’দিকে তার হাত দুটো যেন ঝুলিয়ে দেয়া হয়। গ. তার শবযাত্রার সময় তার অর্থসম্পদ যেন মাটিতে ছিটিয়ে দেয়া হয়।
এতবড় ব্যক্তিত্বের মৃত্যুকালীন এ বোধোদয় আশ্চর্য, রোমাঞ্চকর গল্পের মতো। অবিশ্বাস্য, তবে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কোভিড-১৯ বাংলাদেশে সংক্রমণের পর দেশের অসাধারণ-সাধারণ, ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব পরিবারে চরম আঘাত হেনেছে। দেশের অবস্থা বিপর্যস্ত। যুদ্ধকালীন সময়ের চেয়েও সংকটময় এই পরিস্থিতি।
কার্বন নিঃসরণের জন্য বিশ্ব নেতাদের এত মিটিং, এত প্রস্তাব পাস হল; অথচ কার্বন নিঃসরণ কমছে না। ধনী দেশগুলো তথা শিল্পোন্নত দেশগুলো যে পরিমাণ জ্বালানির ব্যবহার করে, এতে তারা কার্বন নিঃসরণের কারণ হেতু পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য দায়ী- এটা মেনে নিয়েও তারা ঠিক করতে পারছেন না, প্রতি বছর তারা কী পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ কমাবেন।
আর তাদের শিল্পকারখানার জন্য বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ক্ষতির পরিমাণ লাঘবে তাদের সাহায্যের পরিমাণ কত হবে; বাংলাদেশসহ অন্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে কত দিতে হবে। পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য বাংলাদেশ মোটেই দায়ী নয়; অথচ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। বৈশ্বিক উত্তাপ বাড়ার কারণে বাংলাদেশ আজ বিরূপ প্রাকৃতিক পরিস্থিতির সম্মুখীন।
তেলের দাম ও তেলের বাজার দখল নিয়ে কত যুদ্ধ হল। তারপর এখন তেল নিয়ে কেন কথাবার্তা নেই? তেলের জন্য ইরাক ধ্বংস হল। লিবিয়ার তেলক্ষেত্র দখলের জন্য কর্নেল গাদ্দাফি হত্যাসহ লিবিয়া আজ ধ্বংসপ্রায়। লিবিয়ায় এখন নড়বড়ে একটি সরকার, যার অধীনে নিজ দেশের বহুলাংশ নেই।
সেখানে রয়েছে অস্ত্রধারী দলপতিদের কর্তৃত্ব। মধ্যপ্রাচ্যে এখন আর আল কায়দা বা তথাকথিত মুসলিম সন্ত্রাসবাদীদের দাপট নেই। তেল তার মূল্য হারিয়েছে। সেই সঙ্গে করোনাভাইরাসের আবির্ভাব। এখন প্রকৃতি তার নিজস্ব প্রভাবে পৃথিবী চালাচ্ছে। এ এক অন্য পৃথিবী।
বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশের প্রধান শহরগুলোর এয়ার কোয়ালিটি বা বাতাসের উৎকর্ষ বাড়ানো নিয়ে কত প্রচেষ্টা হয়েছে। বাতাসে ধূলা আর সিসার পরিমাণ ছিল গ্রহণযোগ্যমাত্রার চেয়েও বেশি। সেই ঢাকা লকডাউন সময়ে পরিচ্ছন্ন।
ফুল-পাখি-নতুন পাতার সবুজ রং ঢাকাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। আশ্চর্য! ঢাকার বাতাসের কোয়ালিটি বা ধরন এখন খুবই ভালো। কোটি টাকা খরচ করে যা সম্ভব হয়নি; কোভিড-১৯ তা দু’মাসে করে দেখিয়েছে। প্রকৃতি বা প্রভু যাই বলুন, তার সমাধান অবিশ্বাস্য।
মানুষ খালি হাতে দুনিয়ায় আসে, খালি হাতে ফেরত যায়- তা কত পণ্ডিত কতভাবে বুঝিয়েছেন। কে শোনে কার কথা! অথচ আজ সারা বিশ্বের শুধু নয়, বাংলাদেশের ধনী, বিশেষ লোকজন- যারা নিজেকে ভিআইপি ভাবেন; তাদের আর অন্যদের একই অবস্থা।
মানুষ বুঝতে পারছে, সম্পদ দুনিয়ায় রেখে যেতে হবে এবং নিজের প্রস্থানের সময় এ সম্পদ কোনো কাজে লাগছে না। অনেক বিখ্যাত লোকের জানাজায় তার কাছের কেউ উপস্থিত থাকছে না ভয়ে ও আতঙ্কে।
অথচ এই রোগের নিরাময়ের জন্য শুধু আমরা নই, স্বয়ং ইতালির প্রধানমন্ত্রীর আকুতি সবার মনে থাকার কথা। সৃষ্টিকর্তা ছাড়া এ সমস্যা কে দূর করবেন! মানুষের সাধ্যের সীমা রয়েছে, যার অতিক্রম শুধু স্রষ্টার ইচ্ছাতেই সম্ভব। এ ধ্রুবসত্য বোঝাতে কোভিড-১৯ আমাদের নতুন শিক্ষা দিচ্ছে।
প্রকৃতি, কী আল্লাহ, কী ভগবান বা গড যাই হোক; তার ওপর মানুষের বিশ্বাস অকৃত্রিম, শাশ্বত। আগেও ছিল সে বিশ্বাসের প্রখরতা। তবে বর্তমানে তা জ্বলজ্বল করছে সর্বত্র। একজন মার্ক ওয়াহ, ব্রায়ান লারা, শচীন টেন্ডুলকার, বিরাট কোহ্লি, সাকিব-আল-হাসান, মুশকিফ বা তামিম সেঞ্চুরি হাঁকালে ওপরে তাকান। ধন্যবাদ জানান স্রষ্টাকে। এখন করোনাভাইরাসের কারণে ও তার ছোবল দেখে মানুষ আশ্চর্য হচ্ছে। হাত তুলে স্রষ্টার কাছে ক্ষমা চাচ্ছে। মুক্তি চাচ্ছে এ মহামারী থেকে।
বিত্তশালীদের করুণ মৃত্যু ও শেষযাত্রায় লোকের অভাব, স্বেচ্ছাসেবীদের দ্বারা নিজ ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীদের সৎকার- এ এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা; স্রষ্টার এক অদ্ভুত শিক্ষা অথবা প্রতিদান। এ শিক্ষায় আমরা প্রশিক্ষিত হয়ে জীবনযাপন করব, সে এখন বিশ্বাস সর্বত্র।
এ সমস্যা অতিক্রমে মানুষ সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করছে। সরকার চেষ্টা করছে। কিন্তু চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী। এ পর্যন্ত ৭২ জন ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার, পৌরসভার নির্বাচিত সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করতে হয়েছে সরকারকে। এ কঠিন সময়ে ত্রাণ চুরি একটি জঘন্য অপরাধ। অথচ এরা সমাজের চেনাজানা মানুষ, নির্বাচিত প্রতিনিধি। এদের চরিত্র আর মানসিকতায় কোভিড-১৯ও হার মানায়।
নেপোলিয়ন বোঝাতে চেয়েছিলেন, সেরা ডাক্তারদের চিকিৎসাও তাকে সারিয়ে তুলতে পারছে না। তার সময় নিকটবর্তী। সেজন্য ডাক্তারদের তার শবদেহ বহনের কথা বলেছিলেন। তিনি যে মহাশক্তিধর সেনাপতি ও রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন, তাতে কী! শূন্য হাতে তিনি শায়িত হতে যাচ্ছেন চিরনিদ্রায়। এ জন্য কফিনের দু’দিকে দু’হাত ঝুলিয়ে দেয়ার কথা বলেছিলেন। আর সম্পদের কানাকড়িও তিনি নিয়ে যেতে পারছেন না এবং সময়কালে সম্পদ অর্থহীন; তা বোঝাতে শবযাত্রায় অর্থকড়ি রাস্তায় ছিটিয়ে দিতে বলেছিলেন।
এসব বিষয় প্রমাণ কষ্টসাধ্য হলেও তা যে অতি সত্য এবং বর্তমান সময়ে স্পষ্ট, তা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। যিনি হাসপাতালের মালিক, তিনি হাসপাতালে তার সুচিকিৎসা নিয়ে চিন্তিত। যিনি ব্যাংক-বীমা কোম্পানির মালিক, তার নিদানকালে ব্যাংক-বীমা কী কাজে আসবে?
বর্তমান সময়কালটি সেজন্যই আশ্চর্য বিচিত্র উপলব্ধির সময়। প্রতিটি দেশে, প্রতিটি সমাজে ভালো-খারাপ দু’ধরনের মানুষই থাকে। সেজন্য, প্রচলিত আইনে অপরাধ বিবেচনায় জেল-জরিমানা হয়। একটি সমাজ ধ্বংসের শেষ প্রান্তে চলে যায়, যখন অসৎ লোক নেতা বনে যান, যখন বিচার চেয়ে বিচার পাওয়া যায় না, যখন চোর-ডাকাত-অসৎ লোকজন বিচারের ঊর্ধ্বে চলে যান- তখন কোনো সমাজ বা রাষ্ট্রের কী অবস্থা হবে, তা কল্পনা করতেও ভয় লাগে।
সাধারণ মানুষ যখন পুলিশের কাছে যেতে ভয় পায় আর হাসপাতাল দেখলে দূরে সরে যায়; তখন বুঝতে হবে, কোথাও বড় গলদ ভর করেছে। এ জন্য শুধু সরকার নয়; দরকার সর্বত্র সচেতনতা, মানবিক মূল্যবোধের পরিচর্যা- যা সবসময় পরিস্ফূট হবে অফিস, আদালত, কলকারখানা, যানবাহনে আর সবার আচার-আচরণে ও ব্যবহারে।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম (অব.) : তুরস্কে দায়িত্ব পালনকারী সাবেক সামরিক অ্যাটাশে
jahangir010754@gmail.com