করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে বিপর্যস্ত পুরো বিশ্ব। ব্যতিক্রম নয় বাংলাদেশও। তবে করোনা ভাইরাসের এমন ভয়াবহতার মধ্যেও দেখা যাচ্ছে কিছু ইতিবাচক বিষয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গত কয়েক বছরে তালাকের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়লেও করোনাকালে এর সংখ্যা কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় তালাকের সংখ্যা কমেছে অর্ধেকেরও বেশি।
সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনাকালে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে শেয়ারিং বেড়েছে। একসঙ্গে থাকা হয়েছে অন্য সময়ের তুলনায় বেশি। এ ছাড়া স্ত্রীদের ঘরের কাজও যে কষ্টকর এ বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন অনেক পুরুষ। ফলে অনেকে তালাকের মতো সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন।
রাজধানীতে ২০১৯ সাল পর্যন্ত গড়ে প্রতি ঘণ্টায় একটি তালাকের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু করোনাকালে এ চিত্র পাল্টে গেছে। ঢাকার তালাকের তথ্য তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য মিলেছে।
চলতি বছরের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চÑ এই তিন মাসে রাজধানীতে তালাকের ঘটনা ঘটেছে দুই হাজার ৯৭৬টি। অন্যদিকে পরের তিন মাস এপ্রিল, মে ও জুনে তালাকের সংখ্যা ছিল এক হাজার ২৪০টি। দেশে করোনা রোগী প্রথম শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। এর পর ২৬ মার্চ থেকে সারাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। এই ছুটি ৬৬ দিন স্থায়ী ছিল। এর পর সাধারণ ছুটি তুলে নিলেও অফিস-আদালত, কলকারখানা পুরোপুরি খুলে দেওয়া হয়নি। অনেক বেসরকারি অফিস এখনো বন্ধ রয়েছে। সাধারণ মানুষও করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে অপ্রয়োজনে বাইরে যাচ্ছেন না। এর প্রভাব পড়েছে দাম্পত্য জীবনেও। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্ব, কলহ থাকলেও একসঙ্গে সময় কাটাতে হচ্ছে। এতে অনেকের মধ্যেই মনোমালিন্য বা ভুল বোঝাবুঝি কেটে গেছে। ফলে তালাকের মতো সিদ্ধান্ত নেননি তারা। কমে এসেছে তালাকের সংখ্যা।
রাজধানীতে মুসলিম বিবাহ ও নিকাহ রেজিস্ট্রার হিসেবে কাজ করেন কাজী মাহমুদুল হাসান। তিনি বলেন, এখন বিয়ের পরিমাণ যেমন খুবই কম, তেমনি তালাকের সংখ্যাও কমে গেছে। তবে তালাকের সংখ্যা কমাটা ইতিবাচক। করোনা ভাইরাসের কারণে অফিস-আদালত বন্ধ ছিল দীর্ঘদিন। সবাই পরিবারের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন। একে অপরের সঙ্গে নানা বিষয় শেয়ার করতে পেরেছেন। এভাবেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মান-অভিমান কেটে গেছে। আমাদের কাছে অন্য সময় সপ্তাহে ৫-৭টি বিচ্ছেদের আবেদন এলেও বর্তমানে ২-৩টি আসছে।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার তালাকের সংখ্যা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দক্ষিণ সিটিতে জানুয়ারিতে তালাকের ঘটনা ঘটে ৫২৮, ফেব্রুয়ারিতে ৪৪২ ও মার্চে ৪৯২টি। আর করোনাকালে এপ্রিলে সাধারণ ছুটি থাকায় কোনো তালাকই কার্যকর হয়নি। মে মাসে ১১৩ ও জুনে ৪৪১টি তালাকের ঘটনা ঘটে।
এ ছাড়া দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ২০১৯ সালের জুলাইয়ে ৫৬৩টি, আগস্টে ৫৪৫, সেপ্টেম্বরে ৫৪১, অক্টোবরে ৮২০, নভেম্বরে ৪৫৩ ও ডিসেম্বরে ৪৯৮টি তালাকের ঘটনা ঘটেছিল। সেই হিসাবে ২০১৯ সালের শেষ ছয় মাসে তালাকের ঘটনা ঘটে তিন হাজার ৪২০টি। অন্যদিকে ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসে তালাকের ঘটনা ঘটে দুই হাজার ১৬টি।
এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে এক হাজার ৫১৪টি তালাকের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৬১৮, ফেব্রুয়ারিতে ৪৪১ ও মার্চে ৪৫৫টি। এপ্রিলে কোনো তালাক কার্যকর হয়নি। মে মাসে ৫৪ ও জুনে ৬৩২টি তালাকের ঘটনা ঘটে।
তবে তালাকের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীরাই তালাক দিচ্ছেন। জানুয়ারি মাসে পুরুষ তালাক দিয়েছেন ১৮৬, নারী তালাক দিয়েছেন ৪৩২টি। ফেব্রুয়ারিতে পুরুষ ১৩৪, নারী ৩০৭টি। মার্চে পুরুষ ১৪৫, নারী ৩১০টি। মে মাসে পুরুষ ১৫ ও নারী ৩৯টি তালাক দিয়েছেন। জুনে পুরুষ ২৩৫, নারী ৩৯৭টি তালাক দিয়েছেন।
এর বাইরে ২০১৯ সালে উত্তর সিটির পাঁচটি অঞ্চলের হিসাবে দেখা গেছেÑ অঞ্চল ১-এ তালাকের ঘটনা ঘটেছে ৪১১টি। এর মধ্যে পুরুষ ১৮৮ ও নারী ২২৩টি। পরবর্তী সময় মীমাংসার মাধ্যমে ১২ জন সংসারে ফিরে গেছেন।
অঞ্চল ২-এ ২০১৯ সালে এক হাজার ১১৮টি তালাকের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে পুরুষ ৩৬৪ ও নারী ৭৫৪টি তালাক দিয়েছেন। পরবর্তী সময় মীমাংসার মাধ্যমে ৪৪ জন সংসারে ফিরে গেছেন।
অঞ্চল ৩-এ ২০১৯ সালে এক হাজার ৫১টি তালাক হয়েছে। এর মধ্যে পুরুষ ৩৭৪ ও নারী ৬৭৭টি তালাক দিয়েছেন। পরবর্তী সময় সংসারে ফিরে গেছেন ৪৫ জন।
অঞ্চল ৪-এ ২০১৯ সালে ৮৬১ জন তালাকের জন্য আবেদন করেছিলেন। এর মধ্যে পুরুষ কর্তৃক ৩০৭ ও নারী ৫৫৪টি। পরবর্তী সময় ১০ জন সংসারে ফিরে যান।
অঞ্চল ৫-এ ২০১৯ সালে এক হাজার ৩৭৪ জন তালাকের জন্য আবেদন করেছিলেন। এর মধ্যে পুরুষ ৪১২ ও নারী ৯৬২ জন। পরবর্তী সময় ২৭ জন সংসারে ফিরে গেছেন। এ ছাড়া ২০১৯ সালে ১৩১৯ জন তালাক নিতে আইনের আশ্রয় নিয়েছেন। এর মধ্যে ৬৭৫ পুরুষ ও ৬৫৪ নারী।
জানতে চাইলে সমাজ ও অপরাধ গবেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, সংকট মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের উপলব্ধি তৈরি করে। এখন করোনার সংকট চলছে। মানুষ যখন অবসর পান, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান, তখনই পরিবার নিয়ে নানা ধরনের আত্মজিজ্ঞাসা তৈরি করেন। এখন সেই সময়টাই চলছে। মানুষ পাঁচ মাস ধরে অনেকটা ঘরে সময় কাটাচ্ছেন। একটি পরিবারকে পরিচালনার ক্ষেত্রে স্ত্রীর যে বেশি ভূমিকা তা দেখার সুযোগ তৈরি হয়েছে। করোনাকালে পুরুষরা অনেক সময় ধরে বিষয়গুলো লক্ষ্য করেছেন। আগে এ সময়টা ছিল না। কোনো ভঙ্গুর বা মান-অভিমানের সম্পর্ককে পুনরায় স্থাপনের বিষয়ে এ বিষয়গুলো খুবই ভাবায়। এটি স্ত্রীর ক্ষেত্রেও হতে পারে। তিনি বলেন, যে কোনো বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন স্বামী-স্ত্রীর সংসার ভাঙা কোনো সমাধান নয়। ভুল বোঝাবুঝি থাকতে পারে। কিন্তু ভঙ্গুর অবস্থায় নিয়ে যাওয়াটা কাম্য নয়। এই সময়টাতে হয়তো নিজেদের মধ্যে আলোচনার বেশি সুযোগ তৈরি হয়েছে। ফলে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই তাদের আত্মউপলব্ধির আশ্রয় নিতে পেরেছেন। হয়তো এসব কারণেই নিজেদের মধ্যে সম্মান ও শ্রদ্ধা ফিরে এসেছে। এটি তালাক নয়, সম্পর্ক টিকে থাকার পক্ষে কাজ করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম বলেন, প্রতিটি জিনিসেরই একটি পজিটিভ ও নেগেটিভ দিক রয়েছে। করোনার সময় বাসায় বেশি থাকার কারণে অনেকেই হতাশ হয়ে যাচ্ছেন, ডমিস্টিক ভায়োলেন্স বেড়ে যেতে পারে, এটি নেগেটিভ হিসেবে আমরা দেখতে পারি। আবার অন্যদিকে স্বামী-স্ত্রী দীর্ঘসময় একসঙ্গে থাকার সুযোগ পাচ্ছেন। এতে শেয়ারিং বেশি হচ্ছে। প্রতিটি দম্পতির মধ্যেই দুই ধরনের প্রয়োজন দেখা যায়। একটি হচ্ছেÑ ভালোবাসা, সম্মান ও নিরাপত্তা। আরেকটি হচ্ছে- স্বাধীনতা, নিজস্বতা প্রভৃতি। এই প্রয়োজনগুলো যাদের মধ্যে বেশি পূর্ণ হয়, তারা সংসারে তত সুখী হয়। সংসারও দীর্ঘজীবী হয়।
তিনি বলেন, রাজধানীতে কর্মব্যস্ততার কারণে স্বামী-স্ত্রী নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনারও খুব একটা সুযোগ পায় না। এখন তারা সেই সুযোগটা পাচ্ছেন। ভাববিনিময়টা করতে পারছেন। সমস্যাগুলো তারা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে পারছেন। শারীরিক দূরত্বের চেয়ে মানসিক দূরত্বটা সংসারে বেশি প্রভাব ফেলে। আবার এমনও দেখা যায়, শারীরিক দূরত্ব থাকলেও মানসিক দূরত্ব না থাকায় অনেকেই ভালো আছেন। করোনার এমন সময়ে একসঙ্গে বাসায় থাকা, কাজ ভাগ করে নেওয়া একজনের প্রতি আরেকজনের আকর্ষণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এমনকি গৃহস্থালি কাজেও স্বামী তার স্ত্রীকে সহায়তা করছেন। এসব কাজও যে পরিশ্রমের, একটি মর্যাদা রয়েছে এটি স্বামীরা বুঝতে পারছেন। পরিবারের বন্ধনটা এতে শক্তিশালী হচ্ছে। ফলে তালাকের সংখ্যাটা কমছে।