খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে গণতান্ত্রিক উপায়ে কমিটি গঠনের ‘প্রশংসিত’ নিয়ম ভেঙে বয়স্ক, বিবাহিত, অছাত্রদের হাতে কমিটি রাখার সিদ্ধান্ত দিয়েছে কেন্দ্রীয় ছাত্রদল। এমন সিদ্ধান্তে জেলা মহানগরসহ বিভিন্ন ইউনিটে ক্ষোভ ও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রদলের এক নেতা জানান, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে বিবাহিত, অছাত্র ও বয়স্কদের রেখে জেলা কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় কমিটির ‘টপ ফাইভের’ তিনজন দ্বিমত পোষণ করেছেন। বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত অধিকাংশ নেতাও এর বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু টপ ফাইভের দুই নেতা খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে বিবাহিত, অছাত্র ও বয়স্কদের রেখে কমিটি করার সিদ্ধান্ত নিতে অন্যদের বাধ্য করেছেন।
ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামল গতকাল মঙ্গলবার আমাদের সময়কে বলেন, বেশিরভাগ জেলায় আংশিক কমিটি আছে, যা আগের নিয়মে গত কমিটি (রাজিব-আকরাম) ঘোষণা করেছে। যেহেতু বর্তমান নিয়মে আংশিক কমিটিগুলো সম্পূর্ণ হয়নি, তাই মেয়াদ না থাকলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হবে। এ ক্ষেত্রে বিবাহিতদেরও অ্যালাউ করছি।
সংগঠনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে গত কমিটি গঠনের আগে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা কমিটি
গঠনের আগে শীর্ষ দুই পদে বয়স্ক, বিবাহিত, অছাত্রদের বাদ দিয়ে গণতান্ত্রিক উপায়ে কমিটি গঠনের সুপারিশ করেছিল। সাংগঠনিক নেতা হিসেবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও ওই সুপারিশের অনুমোদন দেন, যা দলের মধ্যে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। সে অনুযায়ী গত বছর কাউন্সিলরদের সরাসরি ভোটে ২৭ বছর পর ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়। সাবেক ছাত্রনেতাদের গড়া সেই নিয়ম বর্তমান কমিটি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্তে হতাশা প্রকাশ করেছেন দলের সাবেক এক সভাপতিও। তিনি বলেন, গত বছর এই নিয়ম করতে গিয়ে কত ছাত্রনেতার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে। এ ঘটনায় প্রভাবশালী আট ছাত্রদল নেতাকে বহিষ্কারও করা হয়, যা এখনো প্রত্যাহার করা হয়নি। সংগঠন যদি নিয়ম অনুযায়ী না চলে তবে তা আর সংগঠন থাকে না।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ছাত্রদলের ১১৭টি সাংগঠনিক জেলা ইউনিটের মধ্যে অন্তত ৮৫টির আংশিক কমিটির অধিকাংশের মেয়াদ শেষ। যারা কমিটিতে আছেন তারাও বিবাহিত ও চল্লিশোর্ধ। কেন্দ্রীয় কমিটির এমন সিদ্ধান্তে খোদ সংগঠনের মধ্যে বিতর্ক উঠেছে। সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে চিঠিও দিয়েছেন কয়েকটি জেলার নেতারা। ঢাকা জেলা কমিটিকে ‘সরকারের লিয়াজোঁ কমিটি’ আখ্যা দিয়ে তা ভেঙে নতুন কমিটি গঠনের জোর দাবি জানিয়েছেন জেলা ছাত্রদলের প্রভাবশালী দুই নেতা।
কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে লেখা চিঠিতে তারা উল্লেখ করেছেন, ছাত্রদলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নিরপেক্ষ, অবিবাহিত, মাদকমুক্ত এবং সংগঠনের জন্য নিবেদিত সাহসী নেতৃত্বের মাধ্যমে ঢাকা জেলা শাখার বর্তমান মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি বাতিল করে নতুন কমিটি গঠন করার জোর দাবি জানাচ্ছি। পাশাপাশি বর্তমান মেয়াদোত্তীর্ণ ঢাকা জেলা কমিটি কেন এবং কার ইশারায় বিগত আন্দোলন সংগ্রামে নিষ্ক্রিয় ছিল, তা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতেও তারা জোর দাবি জানান।
ঢাকা জেলার দুই নেতার চিঠি প্রাপ্তির কথা স্বীকার করেছেন ছাত্রদলের সভাপতি ফজলুর রহমান খোকন ও সাধারণ সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হাসান শ্যামলও। ৪ বছর ৫ মাস আগের ৮ সদস্যের মেয়াদোত্তীর্ণ আশিংক কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে পারেনি ঢাকা জেলা। এটি এখন নিষ্ক্রিয় সংগঠনে পরিণত হয়েছে বলে ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
ঢাকা জেলা ছাত্রদলের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন মাসুম আমাদের সময়কে বলেন, তিনি নিজে বিবাহিত নন, তার সাধারণ সম্পাদক বিবাহিত। সংগঠন নিষ্ক্রিয় নয় বলে দাবি করেন তিনি।
ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলা ও মহানগর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের এসব কর্মকা-ে তারাও ক্ষুব্ধ। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি যদি পূর্ণাঙ্গ করা হয়, অথবা বয়স্ক, বিবাহিত অছাত্রদের দিয়ে যদি কমিটি করা হয়, তা হলে তারা প্রতিরোধ করবেন। কেন্দ্রীয় কমিটির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা জানান, ছাত্রদলকে ঢেলে সাজাতে কেন্দ্রীয় নেতাদের নেতৃত্বে বিভাগীয় টিম গঠন করা হয়েছে। এসব টিমের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কোনো টিমের বিরুদ্ধে অনৈতিক লেনদেনের অভিযোগও আছে। এসব অভিযোগ কেন্দ্রীয় কমিটিকে জানাবেন বলে একাধিক জেলার নেতারা জানান।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক সহ-সভাপতি জানান, গত ১৮ মার্চ ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদের নীতিনির্ধারণী কমিটির কার্যনির্বাহীর এক সভায় বিভিন্ন ইউনিট কমিটির ক্রাইটেরিয়া বা পদপ্রার্থিতার বিষয়ে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত হয়। যার মধ্যে অন্যতম ছিল সাংগঠনিক জেলা ও জেলা সমমান শাখার (জেলা, মহানগর ও বিশ্ববিদ্যালয়) পদপ্রত্যাশী প্রার্থীকে অবশ্যই অবিবাহিত হতে হবে এবং বয়সসীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রার্থীর এসএসসি পাসের সাল কোনোভাবেই ২০০৩ সালের পূর্বে হতে পারবে না। সংগঠনিক উপজেলা ও উপজেলা সমমান শাখার (উপজেলা, থানা, পৌর ও কলেজ) পদপ্রত্যাশী প্রার্থীকে অবশ্যই অবিবাহিত হতে হবে এবং বয়সসীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রার্থীর এসএসসি পাসের সাল কোনোভাবেই ২০০৫ সালের পূর্বে হতে পারবে না। ছাত্রী নেত্রীদের বৈবাহিক অবস্থা শিথিলযোগ্য।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা জানান, সম্প্রতি এক বৈঠকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে বুঝিয়ে আগের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়েছে। নতুন এ সিদ্ধান্তের পর প্রথম গত শনিবার বেসরকারি মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজ শাখার ১০১ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়, যেখানে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ বেশ কয়েক জন বিবাহিত। অথচ এই শাখার আংশিক কমিটির দুই বছরের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ১৮ জুলাই।
ঢাকা জেলার দুই নেতার চিঠি : চল্লিশোর্ধ্ব ও বিবাহিতদের নেতৃত্বে কমিটি পূর্ণাঙ্গ না করতে কেন্দ্রে চিঠি দিয়েছে ঢাকা জেলা শাখার দুই নেতা। গত শনিবার কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে দেওয়া চিঠির অনুলিপি বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকেও দেওয়া হয়েছে। ঢাকা জেলা শাখা ছাত্রদলের সহ-সভাপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান রনি ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. আবুল হোসাঈন মুন্সী স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, জেলা ছাত্রদলের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন মাসুম ও সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম জুয়েলের নেতৃত্বাধীন ৮ সদস্যবিশিষ্ট আংশিক কমিটি হয় ২০১৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। ২ বছর মেয়াদি এই কমিটি এখন পার করছে ৪ বছর ৫ মাস। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বিবাহিত। একজনের বয়স ৩৬, অন্যজনের ৪১। সভাপতির এলাকা কেরানীগঞ্জ এবং সাধারণ সম্পাদকের সাভারে হলেও তাদের নামে সংশ্লিষ্ট থানায় কোনো রাজনৈতিক মামলা নেই। গুরুত্বপূর্ণ এই ইউনিটটি নিষ্ক্রিয় থাকার কারণে সংগঠনের নতুন কোনো কর্মীও তৈরি হয়নি।
চিঠিতে তারা বলেন, কেন্দ্রীয় সংসদকে অন্ধকারে রেখে একটি গোষ্ঠী ঢাকা জেলা ছাত্রদলের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি মাসুম-জুয়েলকে বহাল রেখে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার পাঁয়তারা করছে। এ জন্য অনৈতিকভাবে অর্থ দিতেও প্রস্তুত আছে বলে খবর রটেছে। চিঠিতে তারা আরও বলেন, মাসুম-জুয়েলকে বহাল রেখে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয় তা হলে সরকার সমর্থক লিয়াজোঁ পক্ষই লাভবান হবে, যা ঢাকা জেলার তৃণমূল ছাত্রদল নেতাকর্মীরা কোনোভাবে মেনে নিতে পারবে না, মানবেও না। ঢাকা জেলা শাখার বর্তমান মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি বাতিল করে ছাত্রদলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নিরপেক্ষ, অবিবাহিত, মাদকমুক্ত এবং সংগঠনের জন্য নিবেদিত সাহসী নেতৃত্বের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠনের দাবি জানানো হয় ওই চিঠিতে।
এ বিষয়ে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি খোকন বলেন, ঢাকা জেলা ছাত্রদল নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সাধারণ সম্পাদক শ্যামল বলেন, এটি ঢাকা জেলা ছাত্রদলের নিজেদের সমস্যা নয়, বিএনপির সমস্যা।