জিলকদ হোসেন। তৃতীয়পক্ষের একটি কোম্পানির (থার্ড পার্টি) কর্মী হিসেবে বেসরকারি ব্যাংকে কাজ করতেন। করোনা সংক্রমণ শুরুর পর এপ্রিল থেকে থার্ড পার্টির মাধ্যমে কাজ প্রায় বন্ধ করে দেয় ব্যাংকটি। লেখাপড়া শেষে কোনোরকমে চাকরি জোগাড় করে বেকারত্ব ঘোচান। কিন্তু দুই বছর পর এপ্রিল থেকে আবার চাকরি হারিয়ে এখন বেকার। করোনার সংক্রমণ দীর্ঘায়িত হওয়ায় শিগগিরই চাকরিতে যোগ দেওয়ার আশাও দেখছেন না।
জিলকদের মতো প্রায় ১ কোটি চাকরিজীবী চাকরি হারিয়েছেন। এর বাইরে শ্রমিক বা দৈনিকভিত্তিতে বিভিন্ন কর্মে নিয়োজিত মানুষও কাজ হারিয়ে এখন বেকার। হোটেল, রেস্তোরাঁ, শপিংমল, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টার, আবাসন ব্যবসা, ব্যাংক ও বীমার থার্ড, পরিবহন খাতে মোটামুটি স্থায়ীভাবে চাকরিতে ছিলেন এখন প্রায় সবাই বেকার। শুধু পর্যটন খাতেরই ৪০ লাখ কর্মী করোনার কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত।
করোনার সময়কাল দীর্ঘ হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে- অনিশ্চয়তার মাত্রা। অনেকেই ইতোমধ্যে বেকারত্বের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছেন। দিন দিন এ সংখ্যা বাড়ছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে প্রায় ৫ কোটি শ্রমিক অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক খাতে শ্রমিক ছাঁটাই না হলেও বেতন কর্তন থেকে শুরু করে অন্য সুবিধা বর্জন ও বেতনহীনভাবেই কাজ করছেন অনেকে। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত মিলিয়ে প্রায় ১ কোটি শ্রমিক পূর্ণাঙ্গ চাকরির সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। শক্তিশালী ব্যাংকগুলোয় বেতন কমানো শুরু হয়েছে। ছাঁটাই প্রক্রিয়া শুরু করেছে দুয়েকটি ব্যাংক।
দেশে বর্তমানে ৯০ লাখ প্রাতিষ্ঠানিক চাকরি রয়েছে। এর মধ্যে গার্মেন্টস থেকে শুরু করে বিভিন্ন শিল্পকারখানাও রয়েছে। করোনার প্রভাবে অনেক শ্রমিক ছাঁটাইয়ের কথা বলা হলেও বিশেষ ব্যবস্থায় তাদের চাকরি রয়ে যায়। কিন্তু চাকরি থাকলেও বেতনসহ অন্যান্য সুবিধা পাচ্ছেন না প্রায় ১০ লাখ কর্মচারী। বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের অনুদান বেসিক বেতন বা তার অর্ধেক বেতন দেওয়া হচ্ছে। যাতায়াত, স্বাস্থ্য, ঘরভাড়া বাবদ প্রাপ্ত অন্য অর্থ পাচ্ছেন না তারা।
এদিকে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে দেশের ৫৪ লাখ ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানে প্রায় দেড় কোটি শ্রমিক কাজ করছেন। ব্র্যাক ও পিপিআরআইয়ের গবেষণা অনুসারে এখানে প্রায় ৫৬ শতাংশ পূর্ণাঙ্গ সুবিধা পাচ্ছেন না, যা প্রায় ৭৫ লাখ শ্রমিক। এর মধ্যে ৩ শতাংশ বা ৪ লাখ ৫০ হাজার শ্রমিক কোনো ধরনের বেতন ছাড়াই চাকরি করে যাচ্ছেন।
এ ছাড়া ভাসমান ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তা রয়েছেন প্রায় ৬০ লাখ। লকডাউনের কারণে তাদের প্রথাগত ব্যবসার কোনোটি হয়নি। অনেকেই মাস্ক, পিপিইসহ অন্যান্য সরঞ্জামের ব্যবসা করেছেন। কিন্তু বর্তমানে এগুলোর চাহিদা কমে যাওয়ায় তারা আবার বেকার হয়ে পড়েছেন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দীন বলেন, দেশে ফুটপাতে ব্যবসা করে কিংবা অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সংখ্যা ৬০ লাখ। যাদের কোনো লাইসেন্স নেই, ব্যাংকে লেনদেন নেই। কম পুঁজি দিয়ে দিনে ইনকাম দিনে শেষ- এমন ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি বিপদে রয়েছেন। গত চার মাসে তাদের কেউ-ই ব্যবসা করতে পারেননি। উল্টো পুঁজি ভেঙে খেতে হচ্ছে।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের দিকে জোর দেওয়ার আহ্বান জানান সংশ্লিষ্টরা। বাজেটে ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা সঠিকভাবে কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন তারা। এ ছাড়া অনেকেই গ্রামমুখী হয়ে কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য ব্যবসার দিকে ঝুঁকে পড়বেন। তাই এ খাতে সহজলভ্য ঋণ প্রদানেরও আহ্বান জানান তারা।
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে টেনে তুলতে এসএমইর দিকে নজর দিতে হবে। লাখ লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন। যাদের একেবারেই কোনো সুযোগ নেই, তাদের জন্য সুযোগ করে দিতে হবে। দারিদ্র্য নিরসনে সরকারকে বড় বড় ব্যবসায়ীর পাশাপাশি এই ছোট ব্যবসায়ীদের পাশেও দাঁড়াতে হবে।
করোনার সংক্রমণে সর্বপ্রথম ক্ষতিগ্রস্ত হয় পর্যটন খাত। করোনার কারণে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে পর্যটন খাত। দেশে-বিদেশে ভ্রমণ বন্ধ। অভ্যন্তরীণ পর্যটনকেন্দ্রগুলো এখন জনশূন্য। মানুষজন আতঙ্কে বের হচ্ছে না। দেশের পর্যটনকেন্দ্রগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ আজ চরম অনিশ্চয়তায় দিনাতিপাত করছেন। পর্যটন স্পটের সঙ্গে সম্পৃক্ত হোটেল-মোটেল সব শূন্য। একই অবস্থায় পাঁচতারকা মানের হোটেলও। বিদেশি পর্যটকের পাশাপাশি গার্মেন্টস ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত বিদেশিরা থাকতেন পাঁচতারকা হোটেলে। হোটেলের অধিকাংশ কক্ষ খালি আজ। পর্যটনসংশ্লিষ্ট ট্রাভেল এজেন্সি, ট্যুর অপারেটর সবারই একই দশা। পর্যটন খাতে সম্পৃক্ত প্রায় ১৫ হাজার কর্মী চাকরি হারানোর শঙ্কায় রয়েছেন। তা ছাড়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও পর্যটন খাত সাধারণ অবস্থায় ফিরতে আরও ২ বছর লাগবে। কারণ করোনা কেটে গেলেই মানুষ ঘুরতে বের হবে না। জীবনযাত্রার মান নিয়ন্ত্রণে আসার পরই ভ্রমণের চিন্তা আসে।
এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী আমাদের সময়কে বলেন, পর্যটন খাত ভেঙে পড়েছে। এ ক্ষতি সবার। পর্যটন করপোরেশনের অধীনে হোটেল আমরা দিয়েছি করোনার চিকিৎসায় হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করতে। রাজধানীর বিখ্যাত ইন্টারকন্টিনেন্টাল, সোনারগাঁও হোটেলসহ সর্বত্র করোনার ছাপ। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও খারাপ অবস্থায়।
করোনার ছোবলে গেল জানুয়ারি থেকে ব্যবসা বন্ধ হতে থাকে এ খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের। পর্যটনশিল্পে প্রায় পাঁচ হাজার ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছে ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব)। পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে বাড়বে ক্ষতির পরিমাণ। উপার্জন বন্ধ হওয়ায় স্থানীয় পর্যায়ের ট্যুর অপারেটর, ট্যুর গাইড, কমিউনিটি পর্যায়ের মানুষেরা বিপদে পড়েছেন। প্রাদুর্ভাব শেষে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের পর্যটনের প্রচার, ব্র্যান্ডিং ও বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে ৫০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করাসহ এ খাতের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকারের কাছে বিশেষ বরাদ্দ চান সংশ্লিষ্টরা।
পর্যটন খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, জীবিকা নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তায় রয়েছেন ট্যুর অপারেটর, ট্রাভেল এজেন্ট, হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, রেস্তোরাঁ, এয়ারলাইনস, পর্যটক পরিবহন, ক্রুজিং ও গাইডসংশ্লিষ্ট অন্তত ৪০ লাখ কর্মী।
টোয়াব সভাপতি মো. রাফেউজ্জামান বলেন, পর্যটন খাতে আগে আঘাত এসেছে, আবার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতেও বেশি সময় লাগবে। কারণ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই তো মানুষ ঘুরতে বের হবেন না। অন্তত দুই বছর লেগে যেতে পারে। ব্যক্তিপর্যায়ে যারা সেবা দিতেন তারা, আয়হীন হয়ে মানবেতর দিনযাপন করছেন। সরকার এ খাতকে বিশেষ নজর দিয়ে সুরক্ষা না দিলে অনেক উদ্যোক্তার ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না।
এদিকে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার আয়ের পথ বন্ধ হয়ে দরিদ্র মানুষের জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। করোনা কারণে গ্রামের মানুষের ৬২ শতাংশ এবং শহরের মানুষের আয়-রোজগার ৭৫ শতাংশ কমে গেছে। কাজ হারিয়ে নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছে ৩ কোটি ৬৯ লাখ ৪৪ হাজার মানুষ। আগে থেকেই দরিদ্র ছিল ৩ কোটি ৩০ লাখ মানুষ। সব মিলিয়ে ৭ কোটি দরিদ্র মানুষ করোনার কারণে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। করোনার চাকরি হারিয়ে রোজগার কমেছে রেস্তোরাঁ কর্মীদের। তাদের রোজগার কমেছে ৯৯ শতাংশ। রোজগার কমার ক্ষেত্রে এর পরের অবস্থানে আছেন ভাঙাড়ি ওয়ার্কাররা। তাদের রোজগার কমেছে ৮৮ শতাংশ। রিকশাচালকদের আয় কমেছে ৮৪ শতাংশ। দিনমজুর ও শিল্পী সমাজের আয় কমেছে ৮৩ শতাংশ। মালী ও কারখানা কর্মীদের আয় কমেছে ৮০ শতাংশ। এ ছাড়া দক্ষ শ্রমিকদের ৭৯ শতাংশ, কৃষি শ্রমিকদের ৭৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ৭৩ শতাংশ, দোকান/সেলুন/পার্লারের রোজগার কমেছে ৭২ শতাংশ। পোশাককর্মীদের আয় কমেছে ৪৯ শতাংশ, কৃষকের ৪৪ শতাংশ, পিয়ন ও নিরাপত্তারক্ষীদের ৪৩ শতাংশ, অফিসের আনুষ্ঠানিক কর্মীদের কমেছে ৩৩ শতাংশ এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের আয় কমেছে ২৭ শতাংশ।