করোনা মহামারীতে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে চলছে তেলেসমাতি। বিক্রিতে নেই কোনো নিয়ম কিংবা নিয়ন্ত্রণ। তিন-চার গুণ দাম বাড়িয়ে ইচ্ছামাফিক বিক্রি করা হচ্ছে রোগীর প্রাণ রক্ষায় ব্যবহৃত এই চিকিৎসাসামগ্রী। বিক্রেতারা বলছেন, অনেকেই আগাম সতর্কতা হিসেবে অক্সিজেন সিলিন্ডার ঘরে তুলে রাখছেন। তাই করোনায় অক্সিজেনের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সিলিন্ডার সঙ্কটে পড়েছেন তারা। কেউ কেউ শুধু খালি সিলিন্ডার বিক্রয় করছেন ২০-২৫ হাজার টাকায়। অন্য দিকে অক্সিজেন উৎপাদনকারীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অক্সিজেনের উৎপাদন পর্যাপ্ত হলেও সিলিন্ডারের অভাবে সরবরাহে সমস্যা হয়ে যাচ্ছে।
বিক্রয় প্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় চার মাস আগে অর্থাৎ করোনা শুরুর সময় সবচেয়ে ভালো অক্সিজেন সিলিন্ডারের দাম ছিলো ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা, এখন সেই সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪৫ হাজার টাকায়। আর অক্সিজেন রিফিল করতে যেখানে লাগত ৩০০ টাকা, এখন তাতে দিতে হচ্ছে এক থেকে তিন হাজার টাকা।
বাজার ঘুরে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, ক্রেতাদের কাছে চীন ও তাইওয়ান থেকে আনা সিলিন্ডারের চাহিদা থাকলেও ‘লিনডে’ কোম্পানির উৎপাদিত সিলিন্ডারের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। ক্রেতা সেজে সিলিন্ডার কিনতে চাইলে লিনডের পরিবেশক আবু তাহের জানান, সরবরাহ না থাকায় তারা এখন এ কোম্পানিটির সিলিন্ডার দিতে পারবেন না। তবে তিনি ৩৫ হাজার টাকায় একধরনের ‘প্রাইভেট’ সিলিন্ডার বিক্রি করেন। আর দুই-এক দিন পরে লিনডের সিলিন্ডার দিতে পারবেন; কিন্তু দাম পড়বে ৪৫ হাজার টাকা। দাম এত বেশি কেন? জানতে চাইলে বলেন, ‘এখন চাহিদা অনেক বেশি। আর সিলিন্ডারগুলো আমদানি করা হয়। বর্তমানে চাহিদা অনুযায়ী আমদানি করা যাচ্ছে না বলে দাম বেশি।’
তিনি জানান, একটি অক্সিজেন সিলিন্ডারের সাথে ট্রলি, ফ্লো মিটার, ক্যানোলা ও মাস্ক দেয়া হয়। সাধারণত বাড়িতে ব্যবহারের জন্য একটি সিলিন্ডারে এক হাজার ৪০০ লিটার (১ দশমিক ৪ কিউবিক মিটার) অক্সিজেন থাকে। ব্যবহার করা যায় এক হাজার ২০০ মিনিট।
একজন ক্রেতা অভিযোগ করেন, একটি সিলিন্ডর কিনতে তিনি অন্তত ১৪ জন বিক্রেতার কাছে ধরনা দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত ২৭ হাজার টাকা খরচ করেও পছন্দের ব্র্যান্ডের সিলিন্ডার কিনতে পারেননি। তিনি জানান, ‘করোনা শুরুর সময় সবচেয়ে ভালো একটি অক্সিজেন সিলিন্ডারের দাম ছিল ১০-১২ হাজার টাকা। আর রিফিল করতে লাগত ৩০০ টাকা; কিন্তু এখন সেই সিলিন্ডারের দাম ৩০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। রিফিল এক থেকে তিন হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সিলিন্ডার ভাড়া না নিয়ে কেন কিনছেন এমন প্রশ্নে তিনি জানান, আগে সিলিন্ডার ভাড়া পাওয়া গেলেও এখন আর তা পাওয়া যাচ্ছে না। তার ওপর এক প্রতিষ্ঠান থেকে কিনলে আরেক প্রতিষ্ঠান ‘রিফিলও’ করতে চায় না। ফলে বাধ্য হয়েই এখন কিনতে হচ্ছে।
অপর দিকে ইমার্জেন্সি অক্সিজেন হোম সার্ভিসের পরিবেশক শাকিল আহমেদ জানান, বর্তমানে সিলিন্ডারের চাহিদা আগের চেয়ে চার পাঁচ গুণ বেশি। ফলে চাহিদা অনুযায়ী তারা এখন তা পাচ্ছেন না। কেন চাহিদা বাড়ছে, এর ক্রেতা কারা এমন প্রশ্নে তিনি জানান, প্রয়োজন না থাকলেও অনেকে আতঙ্কে ঘরে অক্সিজেন সিলিন্ডার মজুদ করছেন। মূলত এ কারণেই চাহিদার সাথে দামও বৃদ্ধি পেয়েছে।
যদিও স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন কিংবা সিলিন্ডারের কোনো সমস্যা নেই। কোভিড-১৯ উপলক্ষে বাড়তি তিন হাজার ৫০০ অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দ্রুততম সময়ে যাতে খালি অক্সিজেন সিলিন্ডারগুলো পুনরায় রিফিল করা যায়, সে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে ঘরে সিলিন্ডার ব্যবহারের ঝুঁকির কথা জানিয়েছেন চিকিৎসরা। তাদের মতে, পরামর্শ ছাড়া সিলিন্ডারের ব্যবহার এমনকি মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাদের মতে, রোগীর জন্য অক্সিজেন ব্যবহারের প্রবাহ নির্ধারণ করতে হয়। কার কতটুকু অক্সিজেন প্রয়োজন তা নির্ধারণ করতে হয়। এটা না করে রোগীকে অক্সিজেন দেয়া বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হতে পারে, যার ফলে চোখ ও শ্বাসতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বিরাজমান পরিস্থিতিতে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে অক্সিজেন সিলিন্ডারের মূল্য নির্ধারণে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে এ নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। নির্দেশনায় নির্ধারিত কার্যদিবসের মধ্যে করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বাজারে অক্সিজেন সিলিন্ডারের দাম নিয়ন্ত্রণে দ্রুত এর যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করতে সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশ দেন। একই সাথে করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে আরো চার দফা নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত।