দেশের বিভিন্ন নদ-নদীর পানি ওঠা-নামার মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে মধ্যাঞ্চলের নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে বেশ কয়েকটি নদীর পানি কমছে। তবে অবিরাম বৃষ্টি ও উজানের পাহাড়ি ঢলে কমে যাওয়া কিছু নদীর পানি আবার বাড়ছে। এতে বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। আর বন্যার সঙ্গে যেন পাল্লা দিয়ে ভাঙছে নদী। একদিকে বানের পানি অন্যদিকে নদীভাঙন- দুই দিক সামালা দিতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন দুর্গতরা।
অনেকেই ঘরবাড়ি ফেলে আশ্রয়কেন্দ্র ও নিরাপদ স্থানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। গরু-ছাগল নিয়ে দুর্ভোগে দিন কাটছে তাদের। খাদ্য ও নিরাপদ পানি সংকটে রয়েছেন তারা। বানভাসি মানুষের অভিযোগ, বন্যায় তারা দুর্বিষহ জীবনযাপন করলেও সরকারি কোনো সহায়তা এখন পর্যন্ত পাননি। দু-একজন সামান্য ত্রাণ পেলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারে অপ্রতুল।
এদিকে সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর পানি আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ, ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করবে। এ ছাড়া এ সপ্তাহের মধ্যে ঢাকাসহ সারাদেশে বৃষ্টি বাড়তে পারে। ফলে একদিকে শহরের ভেতরে বৃষ্টির পানি জমবে, অন্যদিকে নদীর পানি বন্যা হয়ে শহরে ঢুকবে। এই দুই মিলে আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে ঢাকার পূর্বাংশের ১৬টি ইউনিয়নসহ প্রায় ৪০ লাখ মানুষের বসতি এলাকা বন্যায় ডুবতে পারে। এতে চলতি মাসের পুরো সময় এই পানি নগরবাসীকে ভোগাতে পারে।
প্রবল বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে বগুড়ার সারিয়াকান্দি পয়েন্টে যমুনার পানি বৃদ্ধি পেয়েছিল। তবে শেষ হিসাব অনুযায়ী এ নদীর পানি কিছুটা কমছে। অন্যদিকে কিছুটা বাড়ছে বাঙ্গালীর পানি। বাঙ্গালী নদীর পানি এখনো বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
যমুনার পানি কমতে শুরু করায় জেলার একাংশে বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলেও যমুনার পানি এখনো বাহাদুরাবাদঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৯৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। তবে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমা অতিক্রম করায় জেলার চার উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, বকশীগঞ্জ ও সদর উপজেলার নতুন নতুন এলাকা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। বন্ধ হয়েছে জামালপুর-শেরপুরের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ।
কুড়িগ্রামে অবিরাম বৃষ্টি ও উজানের পাহাড়ি ঢলে আবারো ধরলা ও তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি এখনো বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তার পানি বৃদ্ধির ফলে বুড়িরহাট স্পার হুমকির মুখে পড়েছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে থাকায় চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের দুই লক্ষাধিক বানভাসি মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। ত্রাণ স্বল্পতার কারণে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি সংকটে পড়েছে এসব বন্যাদুর্গত মানুষ। চারণভূমি তলিয়ে থাকায় তীব্র হয়ে উঠছে গবাদি পশুর খাদ্যের সংকট।
নীলফামারীর ডিমলা তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ডালিয়া তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে রবিবার বেলা ৩টায় তিস্তার পানি নেমে ৫২ দশমিক ৩০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সিরাজগঞ্জে যমুনার পানি ধীরগতিতে কমলেও কমছে না নদীপাড়ের অসহায় বন্যার্ত মানুষের আতঙ্ক। বসতবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় ভানবাসি মানুষরা বিভিন্ন ওয়াবদা বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। এসব বাঁধে শোচাগার ও টিউবওয়েল না থাকায় বিপাকে পড়েছেন তারা। অপরদিকে শাহজাদপুরের কৈজুরী ও এনায়েতপুরে নদীভাঙন অব্যাহত থাকায় অসহায় হয়ে পড়েছেন এখানকার বন্যাকবলিত মানুষ।
পাবনার বেড়া উপজেলায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। গত কয়েকদিনে বেড়া উপজেলার চরাঞ্চলের প্রায় ১০০ গ্রাম বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। পানিতে ডুবে যাওয়া চরাঞ্চলের মানুষ গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি নিয়ে বিপাকে রয়েছে।
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া পদ্মা নদীতে পানি কমতে শুরু করেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১ সেন্টিমিটার পানি কমে বিপদসীমার ১০৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে পানি কমলেও গোয়ালন্দ, রাজবাড়ী সদর, কালুখালী ও পাংশা উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে পদ্মা নদীর ভাঙন দেখা দিয়েছে। একদিকে বন্যা অন্যদিকে নদীভাঙনের ফলে দিশেহারা হয়ে পড়েছে ওই এলাকার মানুষ।
অব্যাহত পানি বৃদ্ধির ফলে মাদারীপুরের শিবচরে পদ্মা ও আড়িয়াল খাঁ নদ যেন পাল্লা দিয়ে ভাঙনে মেতেছে। এ পর্যন্ত দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, চার শতাধিক ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হয়েছে। সরকারি হিসাবেই প্রায় ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। ২১টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ৩ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। ভয়াবহ ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে একাধিক স্কুল ভবন, ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, কমিউনিটি ক্লিনিক, বাজারসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।
সরেজমিন জানা যায়, পানি বৃদ্ধি ও তীব্র স্রােত অব্যাহত থাকায় নদীভাঙন ব্যাপক আকার ধারণ করেছে শিবচরের সাত ইউনিয়নে। পদ্মার চরাঞ্চলের চরজানাজাত, কাঁঠালবাড়ি, বন্দরখোলায় ব্যাপক নদীভাঙন অব্যাহত রয়েছে। আড়িয়াল খাঁর ভাঙনে আক্রান্ত হয়েছে বহেরাতলা দক্ষিণ, সন্ন্যাসীরচর, শিরুয়াইল ও নিলখী ইউনিয়নে। ভাঙন আক্রান্ত হওয়ায় চরজানাজাত ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয় ও ইউনিয়ন পরিষদ সরিয়ে নেওয়া শুরু হয়েছে। এর আগে এই স্কুলের ৩টি ভবন ও ইউনিয়ন পরিষদ ভবন ২০১৮ সালে নদীতে বিলীন হয়েছিল। বর্তমানে প্রায় ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছে।
ফরিদপুরের সদরপুরে পদ্মা-আড়িয়াল খাঁ পয়েন্টে বন্যার পানি গতকাল রবিবার ১ সেন্টিমিটার কমলেও বিপদসীমার ১০৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যাকবলিত পরিবারগুলো নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য গরু-ছাগল নিয়ে স্কুল, উঁচু রাস্তায় ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। বন্যার পাশাপাশি পদ্মা ও আড়িয়াল খাঁর ভাঙন অব্যাহত থাকায় নিদারুণ কষ্টের মধ্যে পড়েছেন নদী তীরের বাসিন্দারা।
টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার বৈরান নদীর মুশুদ্দি কসাই বাড়ি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও মুশুদ্দি বাজার সংলগ্ন গাইড ওয়াল ভেঙে ১৫ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে চলতি আমন মৌসুমের বীজতলা ও শত শত একর সবজি ফসল, মাছের ঘের পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কয়েকশ পরিবার।
এদিকে দ্বিতীয় দফায় যমুনা ও ধলেশ্বরী নদীতে পানি বাড়ায় টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। নাগরপুর সরকারি কলেজ, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, নাগরপুর-চৌহালী সড়কসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বন্যার পানি ওঠায় বিপাকে পড়েছে সাধারণ মানুষ। মানুষের ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় তাদের গবাদিপশু নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে ছুটছে শত শত মানুষ। যমুনা নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে নদীভাঙনও। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ সহায়তা দিলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বন্যার পানির স্রােতে চৌহালী-আরিচা সড়কের সলিমাবাদ ইউনিয়নের তেবাড়িয়ায় বেইলি ব্রিজ ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া নাগরপুর শাহাজানী সড়কের বনগ্রামে পাকা রাস্তায় পানি উঠে পার্শ¦বর্তী চৌহালী উপজেলার সঙ্গে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন বগুড়া থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক প্রদীপ মোহন্ত, জামালপুর থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক আতিকুল ইসলাম রুকন, কুড়িগ্রাম থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক মোল্লা হারুন উর রশীদ, নীলফামারী প্রতিনিধি রেজাউল করিম রঞ্জু, সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি আমিনুল ইসলাম, পাবনা প্রতিনিধি সুশান্ত কুমার সরকার, রাজবাড়ী প্রতিনিধি মো. রফিকুল ইসলাম, শিবচর (মাদারীপুর) প্রতিনিধি সম্পা রায়, সদরপুর (ফরিদপুর) প্রতিনিধি প্রভাত কুমার সাহা, ধনবাড়ী (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি আব্দুল্লাহ আবু এহসান ও নাগরপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি রামকৃষ্ণ সাহা রামা।