দেশে এ মুহূর্তে চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অনেক বেশি। অর্থাৎ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি করেছে সেটা বাস্তবে কাজে লাগছে না। সক্ষমতার একটি বিরাট অংশ অলস বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। শুধু বসে থাকছে না, চুক্তি অনুযায়ী প্রতি মাসে শতকোটি টাকা মাসুল গুনতে হচ্ছে সরকারকে। এখানেই শেষ নয় অদূর ভবিষ্যতে আরও অর্ধশতাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়ে গ্রিডে যুক্ত হবে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন। ফলে ভাবনায় বিদ্যুৎ বিভাগ।
ভাবনার কারণ কী? জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বিভাগের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, সরকারের মাস্টার প্ল্যান বা পরিকল্পনায় ছিল ২০৪০ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের। বিদ্যুৎ বিভাগ লক্ষ্য অনুযায়ী উৎপাদনে সক্ষম হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদন নয়, প্রতিবেশী দেশ থেকে আমদানিও করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে পুরো বিদ্যুৎ কাজে লাগছে না।
অন্যদিকে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে শত শত কোটি টাকা বিদ্যুৎ ব্যবহার না করেও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। এ ছাড়া সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে এগিয়ে যাচ্ছে আরও অনেক বড় বড় বিদ্যুৎ প্রকল্প। ফলে এ বিদ্যুৎ ব্যবহার হবে কীভাবে সেটা এখন চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ পরিকল্পনাটা মূলত বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়া মাথায় নিয়ে করা হয়েছিল। সেগুলোর সঙ্গে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যে শিল্পায়ন হবে তাও ধরা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে বেজার পরিকল্পনা অনুযায়ী শিল্পায়ন এগোচ্ছে না। সঙ্গত কারণেই বিদ্যুৎ বিভাগের পরিকল্পনা নতুন করে সাজাতে হবে।
এদিকে উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় দ্বিগুণ হলেও চাহিদা না থাকায় অলস বসে থাকছে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র। চুক্তি অনুযায়ী এসব কেন্দ্রের জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে সরকারকে। ফলে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। পিডিবির হাজার কোটি টাকা লোকসানের বোঝা জনগণের বিদ্যুৎ বিলে এসে যোগ হচ্ছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় প্রায় ৭ বছর সময় নিয়ে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে একটি মহাপরিকল্পনা করে। ওই পরিকল্পনায় বছরভিত্তিক দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা বৃদ্ধির যে ছক আঁকা হয়, বাস্তবে চাহিদা ততটা বাড়েনি। পরিকল্পনায় আগামী বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশে ১৩৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা (ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ) ২৩ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশে বর্তমানে দৈনিক গড় চাহিদা গরমের সময় ১২ হাজার মেগাওয়াট। শীতে প্রায় সাড়ে সাত হাজার থেকে আট হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে। বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা হয়েছিল গত বছর ২৯ মে। ওই দিন সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় ১২ হাজার ৮৯৩ মেগাওয়াট। এ ছাড়া বর্তমানে দেশের ৯৭ শতাংশ মানুষ বিদ্যুতের আওতায় চলে এসেছে। অবশিষ্ট ৩ শতাংশ মানুষকে মুজিববর্ষেই বিদ্যুতের আওতায় আনা হবে বলে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ঘোষণা দিয়েছেন। এতে বিদ্যুতের বর্তমান চাহিদার সঙ্গে আরও প্রায় ৪০০ মেগাওয়াট অতিরিক্ত বিদ্যুৎ প্রয়োজন হবে। শিল্পায়নের ক্রমবিকাশের ফলে আগামী এক-দুই বছর বিদ্যুতের চাহিদা ১৫ থেকে ১৭ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যেই থাকবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেছেন, দেশে ১৬ হাজার ৮৭৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৪৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে। নির্মাণাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পর্যায়ক্রমে উৎপাদনে আসবে। মুজিববর্ষে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতিশ্রুতি এবং প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে চলমান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে।
এ বিষয়ে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, দেশে করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে বিদ্যুৎ চাহিদা কমে গেছে। এখন যে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা তা দিয়েই চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। আরও বিদ্যুৎ উৎপাদন করার কোনো দরকার নেই। বরং যেগুলো আছে সেগুলোর সংস্কার করায় মনোযোগ দেওয়া উচিত। তিনি বলেন সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে প্রচুর ভুল পরিকল্পনা ও অপচয় রয়েছে। যার দায়ভার জনগণের ওপর পড়ছে।
জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (জাইকা) সহযোগিতায় বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনায় আগামী বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট, ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে হতে ব্যাপক শিল্পায়নের সম্ভাবনাকে সামনে রেখে এই লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের পরিকল্পনা অনুযায়ী মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কয়লা ও গ্যাসভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো যথাসময়ে উৎপাদনে না আসায় ব্যয়বহুল তেলভিত্তিক ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বারবার প্রাণ পেয়েছে। এদের কাছ থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনে কম মূল্যে বিক্রি করায় ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।
সর্বশেষ প্রকাশিত পিডিবির বার্ষিক (২০১৮-১৯ অর্থবছর) প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পিডিবি ডিজেলচালিত ৭টি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের (ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার-আইপিপি এবং স্মল ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারের-এসআইপিপি) কাছ থেকে চড়া দামে ৬২ কোটি ৮ লাখ ৩৯ হাজার ১০০ ইউনিট (কিলোওয়াট/ঘণ্টা) বিদ্যুৎ কিনেছে। এতে পিডিবির খরচ হয়েছে ২ হাজার ৬৫৯ কোটি ২ লাখ ৯ হাজার ৯৬৯ কোটি টাকা। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় মূল্য পড়েছে ৪২ টাকা ৮৩ পয়সা।
পিডিবির তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছর পিডিবির লোকসান হয়েছে আট হাজার ১৪১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এর আগের (২০১৭-১৮) অর্থবছর পিডিবির লোকসান ছিল ৯ হাজার ২৮৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা। সংস্থাটির ইতিহাসে এটি ছিল সর্বোচ্চ লোকসান। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চার হাজার ৪৩৪ কোটি ৯০ লাখ, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তিন হাজার ৮৭৩ কোটি ৭৫ লাখ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সাত হাজার ২৮২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছিল সংস্থাটি। এ ছাড়া ২০১৩-১৪ অর্থবছরে পিডিবি লোকসান গুনে ছয় হাজার ৮০৯ কোটি ২৫ লাখ, ২০১২-১৩ অর্থবছর পাঁচ হাজার ৪৩ কোটি ৮৪ লাখ, ২০১১-১২ অর্থবছরে ছয় হাজার ৬৯৩ কোটি ৩৪ লাখ ও ২০১০-১১ অর্থবছরে চার হাজার ৬২০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।
বিদ্যুৎ খাতের একাধিক বিশ্লেষকের মতে, বিদ্যুৎ বিভাগের মহাপরিকল্পনায় বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি, জনবসতি, জাতীয় সক্ষমতা এবং জনস্বার্থ উপেক্ষিত হয়েছে। আমদানি ও ঋণনির্ভরতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনায় অতিরিক্ত চাহিদা নিরূপণ করা হয়েছে। দেশি-বিদেশি ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর প্রভাব প্রড়েছে এ পরিকল্পনায়। এর ফলে মহাপরিকল্পনায় প্রণয়নের আগেই তার বস্তবায়ন দৃশ্যমান হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের একটি সূত্র জানা গেছে, বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনায় আবার পরিবর্তন আনার চিন্তা ভাবনা করা হচ্ছে। সূত্র বলছে, ‘রিভাইজ প্ল্যানে’ উৎপাদনের পাশাপাশি সঞ্চালন ও বিতরণ খাতকে গুরুত্ব দেওয়া হতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, বিদ্যুৎ বিভাগের ভুল পরিকল্পনায়, পিডিবি হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে। পিডিবির এই লোকসানের মাসুল গ্রাহকদের দিতে হচ্ছে। বছর বছর বিদ্যুৎ বিল বাড়ানো হচ্ছে। এখন আবার বছরে দুবার বিদ্যুৎ বিল বাড়ানোর বৈধতা দিতে জাতীয় সংসদে বিল উত্থাপন করা হয়েছে, যা আগামী অধিবেশনে পাস করা হবে।
দেশে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে মোট ৭০ হাজার ৫৩৩ গিগাওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন (আমদানিসহ) হয়েছে, যার ৯০ শতাংশ উৎপাদিত হয়েছে গ্যাস ও তেল দিয়ে। মোট বিদ্যুতের ৬৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ গ্যাস ব্যবহার এবং ১৯ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ তেল (ফার্নেস ও ডিজেল) ব্যবহার করে উৎপাদিত হয়েছে। মোট বিদ্যুতের মাত্র ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ উৎপাদন হয়েছে কয়লা দিয়ে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে এসেছে শূন্য দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। অবশিষ্ট ৯ দশমিক ৬২ শতাংশ বিদ্যুৎ ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছে। দেশে উৎপাদিত ও আমদানিকৃত মোট বিদ্যুতের প্রায় ৫৪ শতাংশ ব্যবহৃত হয় আবাসিক খাতে। শিল্প খাতে প্রায় ৩০ শতাংশ, বাণিজ্যিক খাতে ১২ শতাংশ, কৃষি খাতে পৌনে ৩ শতাংশ এবং অন্য খাতে বাকিটা ব্যবহার হয়।
এদিকে এত বিদ্যুৎ সক্ষমতা থাকার পরও লোডশেডিং কেন হয় এমন প্রশ্ন মানুষের মধ্যে ঘুরপাক খায়। বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়লেও বিতরণ ও সঞ্চালন ব্যবস্থায় এখনো ত্রুটি রয়েছে। যার ফলে লোডশেডিং করতে হয়। বিগত সময় একের পর এক নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে বেশি নজর ছিল সেই অনুযায়ী বিতরণ ও সঞ্চালন ব্যবস্থায় এগোয়নি। তবে এবারের বাজেটে সঞ্চালন ও বিতরণ খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।