সোমবার, ২০ জানুয়ারী ২০২৫, ০৩:৫৭ পূর্বাহ্ন

কেনাকাটায় দুর্নীতি রোধে ট্রাইব্যুনাল দরকার

এম হাফিজউদ্দিন খান
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ৩১ আগস্ট, ২০২০
  • ২৪৯ বার

একটা সাধারণ ধারণা হলো, যথাযথ শাস্তির অভাবে দেশে সরকারি কেনাকাটায় দুর্নীতি বন্ধ করা যাচ্ছে না। একটি প্রকল্প প্রস্তাব (পিপি) প্রণয়ন থেকে শুরু করে প্রস্তাব গ্রহণ ও পাস হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট দপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা জড়িত থাকেন। পরে তা তদারকি করার জন্য রয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ—আইএমইডি। কিন্তু দিন দিন যেভাবে সরকারি কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগ আসছে, তাতে ওই সব কর্মকর্তার আন্তরিকতা, দক্ষতা ও সততা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। দেশে সরকারি কেনাকাটায়ই সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় এবং সরকারের বড় ব্যয়ের খাতও এটা। তাই অর্জিত উন্নয়ন টিকিয়ে রাখতে হলে দুর্নীতি দমন করতেই হবে। এ জন্য সরকারি কেনাকাটায় সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর শীর্ষ ব্যক্তিদের দায় নিরূপণ করতে হবে।

পাবলিক প্রকিউরমেন্ট তথা সরকারি কেনাকাটায় দুই ধরনের দুর্নীতি হয়। প্রথমত, কাজ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এবং দ্বিতীয়ত, বিতরণের ক্ষেত্রে। দেখা যায়, সরকার একটা রাস্তা করার অল্পদিন পর নষ্ট হয়ে যায়। অনেক সময় ব্রিজ ধসে যায়। রাস্তা বা ব্রিজের আয়ু দ্রুত শেষ হয়ে যায়। এর পেছনে প্রধান কারণই হলো দুর্নীতি। আমার চাকরিজীবনে দেখেছি, যে স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কাজ করার কথা, সেভাবে কাজটা হয় না। যেসব উপাদান ব্যবহার করার কথা, সংশ্লিষ্টরা তা ব্যবহার করে না। এ জন্য দায়ী যিনি কাজ করেন এবং যিনি সুপারভাইজ করেন—উভয় পক্ষই। গণপূর্ত বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড বা সড়ক ও জনপথ বিভাগসহ সর্বত্রই একই অবস্থা। এসব কাজে সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীরা ঠিকমতো দেখভাল করেন না কিংবা ইচ্ছা করেই দেখেন না। আবার এসব অনিয়ম করার কারণে তাঁদের খুব কমই জবাবদিহি করতে হয়। সাধারণত বড় ধরনের অভিযোগ না উঠলে তাঁরা জবাবদিহির আওতায় আসেন না।

অন্যদিকে বিতরণের ক্ষেত্রে যে দুর্নীতি হয়, সেটা সাম্প্রতিককালে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আমরা দেখলাম রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, ফরিদপুরে হাসপাতালে কেনাকাটাসহ বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে কেনাকাটায় অস্বাভাবিক দাম ধরে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা। সম্প্রতি প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পে অস্বাভাবিক দামে কেনাকাটার একটা অভিযোগ দেখলাম। ধারণা করা যায়, প্রকাশ হয় না এমন বহু ঘটনা আছে। এসব দুর্নীতি বিভিন্ন পক্ষের যোগসাজশেই হয়।

একের পর এক এ ধরনের দুর্নীতি হচ্ছে; কিন্তু কার্যকর  ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয় না। যা হয়, দু-চারটা ঘটনা ধরা পড়ে এবং সেগুলোর ব্যাপারে কিছু তৎপরতাই শুধু দেখা যায়। চূড়ান্ত বিচারের এই ঘটনায় কী ব্যবস্থা নেওয়া হয় তা জানা যায় না। তাই সরকারি কেনাকাটায় দুর্নীতি বেড়েই চলছে।

সরকারি অর্থের বড় ধরনের অপচয় হচ্ছে এসব অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে। অথচ অনিয়ম বন্ধ করার জন্যই দেশে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস (পিপিআর) করা হয়েছে। আবার কেনাকাটার এই বিধিমালা ঠিকমতো মানা হলো কি না তা তদারক করার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগকে। কিন্তু কেনাকাটায় একের পর এক অনিয়মের ঘটনায় তাদের আন্তরিকতা প্রশ্নবিদ্ধ। আবার কেনাকাটায় অনিয়ম বন্ধ করতে বিভিন্ন সময় দুর্নীতি দমন কমিশন থেকেও নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে; কিন্তু তাতেও খুব একটা কাজ হচ্ছে না। এই অবস্থায় অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করা নিয়ে সরকারের আরো চিন্তা-ভাবনা করা দরকার।

আমি চাকরিজীবনে দেখেছি, একটা ব্রিজের ঢালাইয়ের সময়  রড, সিমেন্ট ও কংক্রিট ঠিকমতো দেওয়া হচ্ছে কি না তা তদারকির জন্য সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীর উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তিনি থাকতেন না। আমি মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব পালনকালেও এমনটা দেখেছি। ধরুন, একটা রাস্তা ২০ বছরের আয়ু ধরে তৈরি করা হলো। কিন্তু ১০ বছরের মধ্যে সেটা নষ্ট হয়ে গেল। এর দুটি কারণ থাকতে পারে। একটা হলো প্রকল্প প্রণয়নের সময় স্পেসিফিকেশন দুর্বল ছিল কিংবা তদারকির অভাবে ঠিকাদার ঠিকমতো কাজ করেননি। এ ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের যোগসাজশ থাকাটাই স্বাভাবিক। তাই এসব বন্ধ করতে সরকারের দিক থেকে যে সতর্কতা বাড়ানো দরকার ছিল, সেটা  নেই। এসব হরদম হচ্ছে এবং দৃশ্যত সরকারও মেনে নিচ্ছে। কিছু ঘটনা হয়তো ধরা পড়ল, কয়েকটা মামলা হলো। কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে কী হলো সেটা আর জানানো হয় না। ফলে কোনো শাস্তি দৃষ্টান্ত হিসেবে দাঁড়ায় না। অনিয়ম বন্ধ করার জন্য যে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার আইন ও বিধি অনুযায়ী, সেটা নেওয়া হচ্ছে না।

সম্প্রতি প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন নিয়ে একটি প্রকল্পের অতিরিক্ত দাম দেখিয়ে কেনাকাটার একটা অভিযোগ জানা গেছে। এখানে এমন একটা ধারণা গড়ে ওঠাই স্বাভাবিক যে অতিরিক্ত দাম ধরে প্রকল্প অনুমোদনের কাজগুলো যারা করে, তারা বেশি বেশি করে দাম ধরে থাকে, যাতে তাদের বড় অঙ্কের পারসেনটেজটা থাকে। কিন্তু সেটা তো পরিকল্পনা কমিশন যাচাই-বাছাই করার কথা। বাজারমূল্যের সঙ্গে তা সংগতিপূর্ণ কি না তা বিচার-বিশ্লেষণ করার কথা। তারা সেটা দেখবে না কেন? এ ছাড়া প্রতিটি বিভাগীয় প্রকল্প কমিটিও এগুলো দেখার কথা। তার মানে একটা প্রকল্পে অতিরিক্ত খরচ ধরে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার সঙ্গে অনেকেই জড়িত থাকেন। দেখা যাচ্ছে, একের পর এক ঘটে যাচ্ছে; কিন্তু তদারকিতে থাকা কোনো কর্মকর্তার ওপর এর দায় বর্তাচ্ছে না।

রূপপুরের ঘটনা ধরার পর কয়েক দিন হৈচৈ হলো। এরপর ধরা পড়ল ফরিদপুরের সেই পর্দা কাহিনি। আবার স্বাস্থ্য ও ঔষধ প্রশাসনের কেনাকাটায় বড় ধরনের একটি দুর্নীতির অভিযোগ এলো। বহু আগে থেকেই এটা হচ্ছে। আমি চাকরিজীবনেও এটা দেখেছি। স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটায় চরম দুর্নীতির কথা শোনা যায়। চাকরিজীবনে এগুলো নিয়ে আমার নিজেরও অনেক আপত্তি ছিল। কিন্তু কোনোটারই কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আমি দেখেছি, কিছু সরকারি কর্মচারীকে, যাঁরা বিভিন্ন দপ্তরের চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট পদে পোস্টিং পেতে তদবিরের পর তদবির করতেন। এ ছাড়া গণপূর্ত, পানি উন্নয়ন বোর্ড, সড়ক ও জনপথ, জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ যেসব দপ্তরে বেশি কেনাকাটা হয়, বেশি বেশি বিল পাস হয়, সেসব জায়গায় পোস্টিং পেতে তদবির করতেন। আবার প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায়, প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু প্রতিবছরই যেভাবে বিভিন্ন প্রকল্পে ‘টাইম ওভাররান ও কস্ট ওভাররান’ করা হয়, তার জন্য কে দায়ী কখনো খুঁজে বের করা হয় না। তাই দুর্নীতি বন্ধের পদক্ষেপ হিসেবে প্রকল্পে মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধি কেন হচ্ছে এবং কে দায়ী তা অবশ্যই খুঁজে বের করার বাধ্যবাধকতা রাখতে হবে। আর আইনগতভাবে যা-ই হোক, দুর্নীতি ও অনিয়মের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নৈতিকভাবে তাঁদের সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি (নেতৃত্বের দায়) এড়াতে পারেন না।

এখন এসব দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে জড়িত কর্মকর্তাদের শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। না হলে দুর্নীতি চলতেই থাকবে। আমি যেটা প্রায়ই বলি, আমাদের এখানে দুর্নীতির মামলা যেভাবে হয় এবং আমাদের যে আইনি প্রক্রিয়া, তাতে শাস্তি দেওয়া কঠিন ও সময়সাপেক্ষ। কারণ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মামলা হবে, তদন্ত হবে, নিম্ন আদালত থেকে হাইকোর্টে যাবে, আপিল বিভাগে যাবে। মাঝে নানা প্রভাব খাটিয়ে তদন্ত দীর্ঘায়িত করা হবে। এভাবে চলতেই থাকে এবং একপর্যায়ে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের চাকরিজীবনও শেষ হয়ে যায়। সে জন্য আমার প্রস্তাব, দুর্নীতির মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে একটি উচ্চতর ট্রাইব্যুনাল গঠন করা, যেটা অনেকটা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার জন্য গঠন করা হয়েছিল। হাইকোর্টের বেঞ্চের সমপর্যায়ের এই ট্রাইব্যুনালে মামলার রায় হওয়ার পর শুধু একটি মাত্র আপিল করার সুযোগ থাকবে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে মামলার দীর্ঘসূত্রতা বাদ দিয়ে দ্রুত নিষ্পত্তি একান্ত জরুরি। আর দ্রুত নিষ্পত্তির জন্যই এ ধরনের একটা ট্রাইব্যুনাল দরকার। আমাদের আইনগুলোকে সেভাবেই তৈরি করতে হবে।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

অনুলিখন : আফছার আহমেদ

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com