রাজস্ব আদায়ে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা পার হয়েছে সমাপ্ত অর্থবছরে। এই সময় (২০১৯-২০) এনবিআর-নন-এনবিআর মিলিয়ে সার্বিক রাজস্ব ঘাটতি গিয়ে ঠেকেছে দেড় লাখ কোটি টাকার কোটায়। আর এই অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি ছিল সবচেয়ে হতাশাব্যঞ্জক। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়েও ২০১৯-২০ অর্থবছরে এনবিআর খাতে রাজস্ব আদায় কম হয়েছে ২৫ শতাংশ।
রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ার কারণে সরকারের পুঞ্জীভূত ঋণও বেশ বেড়ে গেছে। এক বছরের ব্যবধানে এই ঋণ বেড়েছে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। নৈরাশ্যজনক রাজস্ব আদায়ের প্রভাবে চাপের মুখে পড়েছে চলতি অর্থবছরের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। এতে সরকারের ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা এক দিকে বাড়বে অন্য দিকে প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন দুরূহ হয়ে দাঁড়াবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা মো: আজিজুল ইসলাম গতকাল এই প্রতিবেদককে বলেছেন, এ চিত্র এটি প্রমাণ করে, সরকার যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা বলছে তা বাস্তবে অর্জিত হয়নি। সরকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে হিসাব দিয়েছে বাস্তব অর্জন হবে এর চেয়ে বেশ কম। সমাপ্ত অর্থবছরে সরকারের পক্ষ থেকে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু এই দাবি বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা দ্বিমত পোষণ করে আসছেন।
মির্জ্জা আজিজ বলেন, এই অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য সরকারের উচিত হবে সরবরাহ ব্যবস্থা বা সাপ্লাই চেইন মেইনটেইন করে রফতানি আয় বাড়ানোর দিকে নজর দেয়া। আর একই সাথে বিদেশ থেকে যেসব শ্রমিক কোভিডের কারণে দেশে ফিরে এসেছে তাদেরকে আবার সেসব দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা।
রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অভিমত হচ্ছে, কোভিড-১৯ কারণে গেল অর্থবছরে মার্চ এপ্রিল মে জুন মাসে ব্যবসায় বাণিজ্য ছিল নাই বলে চলে। তাই এ সময়ে একটি নেতিবাচক প্রভাব পুরো অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের ওপরে গিয়ে পড়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে রাজস্ব আদায়ের চূড়ান্ত এ চিত্র উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে সার্বিক রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৬৯ কোটি টাকা। কিন্তু এর বিপরীতে আদায় করা সম্ভব হয়েছে ২ লাখ ২৪৮ কোটি টাকা। যা কি না লক্ষ্যমাত্রার ৫৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ। অর্থাৎ সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রকৃত রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৮২১ কোটি টাকা (৪২ দশমিক ৪৭ শতাংশ)।
রাজস্ব আদায়ের এই চিত্র এর আগের অর্থবছর অর্থাৎ ২০১৮-১৯ অর্থবছরের তুলনায় ২০ দশমিক ৪৯ শতাংশ কম। সেই অর্থবছর সার্বিক রাজস্ব আদায়ের প্রকৃত পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৫১ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা।
এ দিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন রাজস্ব আদায়ের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৫০০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে প্রকৃত আদায় হয়েছে ১ লাখ ৬৮ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা।
অর্থাৎ সমাপ্ত অর্থবছরে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এনবিআর-এর রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা। রাজস্ব আদায়ের এই অঙ্ক এর পূর্ববর্তী অর্থবছর অর্থাৎ ২০১৮-১৯ অর্থবছরের তুলনায় ২৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ কম। ওই বছর এনবিআরের আওতাধীন প্রকৃত রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ২৫ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা।
অর্থ বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজস্ব ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার কারণে গত অর্থবছরে সরকারের পুঞ্জীভূত মোট অভ্যন্তরীণ ঋণ এবং নিট ঋণও বেড়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে সরকারের মোট অভ্যন্তরীণ ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ২ হাজার ৬৩৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
এর মধ্যে পুঞ্জীভূত নিট ঋণ হচ্ছে ১ লাখ ৭৬ হাজার ১৪৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে এই দুই খাতে সরকারের ঋণ বেড়েছে যথাক্রমে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা (১৩.৫৮ শতাংশ) এবং ৬২ হাজার ৮২৫ কোটি ২০ লাখ টাকা (৫৫.৫১ শতাংশ)।
এর আগের অর্থবছরে অর্থাৎ ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে সরকারের মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৪৬ হাজার ৮৮৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা এবং পুঞ্জীভূত নিট ঋণ ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ২৭৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
এ দিকে রাজস্ব আদায়ের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলেও চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের মূল বাজেটে সার্বিক রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের আওতাধীন রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এ জন্য এনবিআর রাজস্ব আদায় প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে ৫০ শতাংশের ওপরে।
এ বিষয়ে ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আমি আগেও বলেছি, এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে আমি নতুন করে কিছু বলতে চাই না। এখন এনবিআরের উচিত হবে রাজস্ব আদায় কিভাবে বাড়ানো যায় তার দিকে মনোযোগ দেয়া। আমাদের এখানে ট্যাক্স অ্যাভেশন বা কর ফাঁকি হয় প্রচুর। এটি যেমন আয়কর খাতে হয়, তেমনি ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন খাতেও হয়। ব্যবসায়ীরা অনেক জিনিস বিক্রি করে কিন্তু ক্রেতাদের কোনো রসিদ দেয় না। এতে করে যে রাজস্ব আদায় হওয়ার কথা তা সরকারের কোষাগারে জমা হয় না।
এনবিআরের উচিত রাজস্ব আদায়ের টার্গেটের কাছাকাছি যেতে হলে এই কর ফাঁকি কিভাবে বন্ধ করা যায় তার উদ্যোগ নেয়া।
এ দিকে রাজস্ব আদায়ে দুরবস্থার পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনীতির অন্যান্য সূচকেও চাপ লক্ষ করা যাচ্ছে। সমাপ্ত অর্থবছরে রফতানি আয়ে ১৭ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয় আর নতুন বছরের প্রথম মাসে রফতানি বেড়েছে মাত্র ০.৬ শতাংশ। বিগত অর্থবছরের আমদানিতে সাড়ে ৮ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ১৯ শতাংশ। এর মধ্যে কেবল রেমিট্যান্সে কিছুটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে। এ খাতে বিগত অর্থবছরের ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে আর চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ৫০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে।