কমিটির মেয়াদ শেষ হয়, নেতৃত্ব ফুরায় না। গত এক দশকের কার্যক্রম দেখলে ছাত্রলীগের ক্ষেত্রে কথাটি সহজেই বলা যায়। দেশের অন্যতম এই প্রাচীন ছাত্রসংগঠনটির কোনো কোনো ইউনিটের কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ৯ বছর আগে। অথচ এখনো দিব্যি সেই কমিটি নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে ইউনিটের। এভাবে বছরের পর বছর সাংগঠনিক ইউনিটগুলোর কমিটি না করেই চলছে ছাত্রলীগ।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের দেশব্যাপী ১১১টি সাংগঠনিক জেলা রয়েছে। এর মধ্যে ১০৮টিই মেয়াদ উত্তীর্ণ। আর ৩০১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ৬০টিরও বেশি পদ শূন্য। কমিটি ঘোষণার বছরে পেরিয়ে গেলেও বণ্টন হয়নি সাংগঠনিক দায়িত্ব। মাসে একটি সাধারণ সভা হওয়ার কথা থাকলেও গত এক বছরে হয়নি কোনো সাধারণ সভা। দলীয় কর্মসূচিতে থাকেন না সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা।
ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলনের পর ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই সভাপতি পদে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক পদে গোলাম রাব্বনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, স্বজনপ্রীতিসহ নানা অভিযোগে পূর্ণাঙ্গ মেয়াদে দায়িত্ব পালনের আগেই ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এই দুই নেতা। তাদের অব্যাহতির পর সংগঠনটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পান আল নাহিয়ান খান জয় এবং সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান লেখক ভট্টাচার্য। ৩ মাস ভারপ্রাপ্ত থাকার পর ছাত্রলীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তাদের পূর্ণ দায়িত্ব দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। পরে জয়-লেখক কোনো সম্মেলন ছাড়াই প্রেস রিলিজের মাধ্যমে নড়াইল, কিশোরগঞ্জ, চাঁদপুর জেলা কমিটি ঘোষণা করেন।
এর আগে ২০১৫ সালে ২৮তম জাতীয় সম্মেলনে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন সাইফুর রহমান সোহাগ ও এসএম জাকির হোসেন। ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন এইচএম বদিউজ্জামান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম। ২০০৬ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন মাহমুদ হাসান রিপন ও সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন। অতীতে কেন্দ্রীয় কমিটিও সময়মতো পরিবর্তন হয়নি।
আগে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক জেলা ছিল ১০৯টি। শোভন-রাব্বানীর সময় দুটি ইউনিট বৃদ্ধি করায় সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১১। এক যুগের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও রিপন-রোটনের সময়ে দেওয়া অনেক
কমিটি এখনো ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ে বিদ্যমান। যেমন বরিশাল জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি করা হয় ২০১১ সালের ৯ জুলাই। সেই কমিটি এখনো বহাল। বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদককে শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকায় কেবল সভাপতি দিয়েই চলছে শাখাটি। বিভিন্ন উপজেলা ও ইউনিয়ন ইউনিটেও এ ধরনের চিত্র বিদ্যমান বলে জানান নেতাকর্মীরা।
ছাত্রলীগের সোহাগ-জাকির কমিটির সূত্র জানায়, তাদের সময়ে ১০৯টি ইউনিটের ৩৭টিতে নতুন কমিটি দিতে পারেননি। সেই শাখাগুলোতে শোভন-রাব্বানী এসেও কমিটি দেননি। ফলে ৪-৯ বছর ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়েই চলছে ওইসব ইউনিট। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগে রয়েছে ৫টি শাখা। এগুলো হচ্ছে- বরিশাল জেলা ও মহানগর, ঝালকাঠি, ভোলা, বরগুনা শাখা। রংপুর বিভাগের চারটি শাখায় কমিটি হয়নি। রংপুর জেলা ও মহানগর, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও। চট্টগ্রাম জেলায় ৮টি শাখায় কমিটি হয়নি। এগুলো হলো- চট্টগ্রাম মহানগর, কুমিল্লা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ, ফেনী, কক্সবাজার, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান। খুলনা বিভাগের বাগেরহাট ও খুলনা মহানগরে কমিটি দিতে পারেননি সোহাগ-জাকির।
রাজশাহী বিভাগের ৫টি শাখায় সোহাগ-জাকিরের সময় কমিটি হয়নি। সেগুলো হলো- রাজশাহী জেলা ও মহানগর, নাটোর, বগুড়া, জয়পুরহাট। সিলেট বিভাগের ৩টি শাখায় কমিটি হয়নি সিলেট জেলা ও মহানগর এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে সিলেট জেলা ও মহানগর কমিটি ভাঙা হলেও চলছে নতুন নেতৃত্ব ছাড়া। ঢাকা বিভাগের ৮টি ইউনিটে নতুন কমিটি দিতে পারেননি তারা। এগুলো হচ্ছে- কিশোরগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর জেলা ও মহানগর। এর মধ্যে গাজীপুর মহানগরের সম্মেলন হয়েছে, কমিটি হয়নি। ময়মনসিংহ বিভাগের নেত্রকোনা, জামালপুরেও সোহাগ-জাকিরের সময় কমিটি হয়নি।
হিসাব অনুযায়ী, সোহাগ-জাকিরের সময় ১০৯টি ইউনিটের মধ্যে তারা ৭২টি কমিটি দিতে পেরেছিলেন। তারা দায়িত্বে ছিলেন প্রায় তিন বছর। ফলে তারা যেসব শাখায় কমিটি দিতে পারেননি তার মেয়াদ এখন চার বছরের বেশি। আর সোহাগ-নাজমুল কমিটি প্রায় সাড়ে চার বছর দায়িত্বে থেকে সাংগঠনিক জেলার কমিটি দিয়েছেন ৮৫টির মতো। আর শোভন-রাব্বানীর কমিটি এক বছর দুই মাস দায়িত্ব পালন করে মাত্র দুটি শাখায় কমিটি দিয়েছিল। এছাড়া শোভন-রাব্বানীর সময় গত বছর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কবি নজরুল কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের কমিটি ভেঙে সম্মেলন করা হয়। কিন্তু দেওয়া হয়নি কমিটি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কমিটিগুলোও মেয়াদ হারিয়েছে অনেক আগেই। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ছাত্রলীগের কমিটি অনেক আগেই বিলুপ্ত করা হয়েছে।
ছাত্রলীগের প্রধান ইউনিট বলে বিবেচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ এবং ছাত্রলীগের ‘প্রাণ’ ১৮টি আবাসিক হল কমিটিরও মেয়াদ নেই। এ সময়ে শাখাগুলোতে নতুন নেতৃত্ব না আসায় নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। এই হল শাখাগুলোর অধিকাংশ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগে পদ পেয়েছেন। ফলে হলগুলোতে এক ধরনের সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। একেকটি হলে কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে ঘিরে ৪ থেকে ১০টি গ্রুপ ও সাব গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে।
এছাড়া কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ থাকলেও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের নেতাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি দায়িত্ব। দায়িত্ব বণ্টন না হওয়ায় এক রকম বিশৃঙ্খলভাবে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত। সংগঠনের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন জেলা, মহানগর, বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাংগঠনিক কাজ তত্ত্বাবধানের জন্য ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে একটি সাংগঠনিক টিমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সংগঠনের সহসভাপতি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক, সহসম্পাদক, সম্পাদক, উপসম্পাদক ও সদস্যদের নিয়ে এই টিম গঠন করা হয়। কিন্তু ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই ছাত্রলীগের সর্বশেষ সম্মেলনের পর গঠিত কমিটির সাংগঠনিক দায়িত্ব বণ্টন হয়নি আজও।
বিভিন্ন সাংগঠনিক সমস্যা সমাধানসহ মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলো দ্রুত করা হবে বলে জানান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, আমরা অনেক আগেই মেয়াদোত্তীর্ণ ইউনিটগুলোতে সম্মেলন করে কমিটি দেওয়া শুরু করতাম। কিন্তু করোনার কারণে আমাদের পরিকল্পনা এলোমেলো হয়ে গেছে। আর এক সঙ্গে তো সব কমিটি করতে পারব না। তাই যেখানে কোনো কমিটি নেই বা সম্মেলন হয়ে গেছে সেগুলোর কমিটি আগে দিয়ে দেব। যেসব ইউনিটে নেতৃত্ব নেই সেগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেখা হবে। নেতৃত্বজট যাতে তৈরি না হয়, সে বিষয়ে আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক থাকব।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের নেতাদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ছাত্রলীগের পদপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে তারা একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে দায়িত্ব পেয়েছেন। তারা তো সে দায়িত্বগুলোই ভালো করে পালন করছেন না। তারা আগে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করুক। পরে যদি প্রয়োজন হয় তখন অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া যাবে।