খারাপ মহামারী পরিস্থিতির মধ্যেই তুমুল রাজনৈতিক উত্তেজনা নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ যুক্তরাষ্ট্রের ৫৯তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এতে শেষ মুহূর্তের সব জরিপেই ডেমোক্র্যাটদলীয় প্রার্থী জো বাইডেন এগিয়ে থাকলেও এত সহজে হার মেনে নিতে রাজি নন বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও রিপাবলিকানদলীয় প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এরই মধ্যে তিনি হুশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন যে, ভোটের ফলে চুল পরিমাণ হেরফের হলে তিনি আইনি রাস্তায় হাঁটবেন। তেমন কিছু হলে ডেমোক্র্যাটরাও যে ছেড়ে কথা বলবে না তারও আভাস আছে। সিএনএন, ফক্সসহ প্রভাবশালী মার্কিন গণমাধ্যমগুলো বলছে, ইতোমধ্যে পরস্পরকে রুখতে দুদলই শত শত আইনজীবীকে প্রস্তুত করে রেখেছে। গোটা নির্বাচনের ফলও নয়, শুধু যে কোনো একটি প্রভাবশালী অঙ্গরাজ্যের ফল কাছাকাছি বা সামান্য বিচ্যুতি হলেই হয়তো উভয় পক্ষ আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে।
এরই মধ্যে ট্রাম্প সুপ্রিমকোর্টের বিচারক হিসেবে নিজের পছন্দের অ্যামি কনি ব্যারেটকে নিয়োগ দিয়ে আইনি প্রস্তুতির বেশ খানিকটা এগিয়েও রেখেছেন। সব মিলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘিরে এক অস্থির পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশটি।
গতকাল প্রকাশিত এক খবরে বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলেছে, করোনা ভাইরাস মহামারীর কারণে এবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন একবারের ব্যতিক্রমী। বলা হচ্ছে, এ নির্বাচন ঘিরে ভোটপরবর্তী বিরোধমূলক পরিস্থিতিও তৈরি হতে পারে। আর তেমনটি হলে এ নির্বাচন নিয়ে বিভক্তি যুক্তরাষ্ট্রে হতে পারে দীর্ঘায়িত। কারণ এরই মধ্যে জনমত জরিপে পিছিয়ে থাকা ট্রাম্প বলেছেন, নির্বাচনের দিনের পরও যদি রাজ্যগুলোয় ভোট গণনা বাকি থাকে তা হলে তিনি আইনি পথে হাঁটবেন।
সোমবার রাতেও তিনি পেনসিলভানিয়ায় সাংবাদিকদের বলেছেন, এখানে মেইলে যেসব ভোট নেওয়া হয়েছে, তা নির্বাচনের তিন দিন পর কেন্দ্রে পৌঁছবে। পরে যদি সেসব ভোট গণনা করা হয় তা হলে ব্যাপক জালিয়াতি হতে পারে। যদিও কীভাবে এবং কারা জালিয়াতি করবে সে সম্পর্কে তিনি কিছু বলেননি। আবার পেনসিলভানিয়াতে ভোট গণনার এ অতিরিক্ত সময় অনুমোদন করেছে সুপ্রিমকোর্ট, যা পুনর্বিবেচনা করতে আদালতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ট্রাম্প। তবে ট্রাম্পের এমন আচরণকে অগণতান্ত্রিক বলে আখ্যায়িত দিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, যদি আপনি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তা হলে প্রতিটি ভোট গণনা হোক এটি আপনাকে চাইতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য পেনসিলভানিয়া এবং মিনেসোটায় ভোটের ফল খুব কাছাকাছি হতে পারে। তেমনটা হলে বিষয়টি নিয়ে হতে পারে ঝামেলার সূত্রপাত। কারণ রিপাবলিকান শিবির মেইলে বা ডাকযোগে পাঠানো ব্যালট ভোট ৩ নভেম্বরের পর গ্রহণের ব্যাপারে আপত্তি করে আসছে। এ নিয়ে এরই মধ্যে একের পর এক মামলায় আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাটরা। ইতোমধ্যে ডাকযোগে আসা ভোটে বাইডেন এগিয়ে আছেন বলে খবর রয়েছে। আবার নির্বাচনের দিন সশরীরে ভোট দেওয়া ভোটারদের রায়ে ট্রাম্প এগিয়ে যেতে পারেন। আর এমন কিছু ঘটলে ট্রাম্প হয়তো নিজেকে আগাম বিজয়ী ঘোষণা করে দিতে পারেন।
লস অ্যাঞ্জেলেসের একটি আইনবিষয়ক স্কুলের নির্বাচনী আইনের শিক্ষক জেসিকা লেভিনসন বলেন, যদি পেনসিলভানিয়া ও ফ্লোরিডায় ফল সমান হয় বা ব্যবধান খুব সামান্যও হয়, তা হলেই হয়তো আমরা আইনি লড়াইয়ে পড়ে যেতে পারি।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দুজন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেলের কথাতেও ভোটের ফল নিয়ে তীব্র উত্তেজনার আভাস পাওয়া গেছে। তারা উভয়েই ফল মেনে না নেওয়ার বিরুদ্ধে হুশিয়ারি দিয়েছেন। তাদের একজন এরিক হোল্ডার, যিনি ওবামার আমলে অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন। অপরজন মাইকেল মাকাসি, যিনি অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন ওবামার পূর্বসুরি জর্জ ডব্লিউ বুশের আমলে। ওয়াশিংটন পোস্টের এক লেখায় দুজনই বলেছেন, তাদের মধ্যে আইন এবং নানা নীতিনির্ধারণী বিষয়ে অতীতে অনেক মতপার্থক্য ছিল। এখনো আছে। কিন্তু আজ আমরা এক সঙ্গে লিখছি, কারণ অতীতে যেভাবে একে অন্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছি, এখনো তা করে যেতে চাই, যেভাবে অতীতে আমেরিকানরা করেছে।
এ লেখায় তারা মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে জনগণকে তাদের মত প্রকাশের জন্য বিক্ষোভের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। তার মানে এই নয় যে তারা যেমন রাজনৈতিক ফল আশা করেন, সেই ফল না পেলে অন্য নাগরিকদের শান্তি কেড়ে নেওয়ার অধিকার তাদের আছে। তাই রাজনৈতিক নেতারা যাতে নির্বাচনের ফল নিয়ে কোনো সহিংসতায় উস্কানি না দেন বা সমর্থন না করেন সে আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
অবশ্য মার্কিন নির্বাচনের ফল এবং ভোট গণনা নিয়ে ডেমোক্র্যাট আর রিপাবলিকানদের মধ্যে আইনি লড়াইয়ের আরেকটি নজির আছে। ২০০০ সালের নির্বাচনের মীমাংসা হয়েছিল আদালতে। ওই সময় ডেমোক্র্যাট প্রার্থী আলগোর এবং জর্জ ডব্লিউ বুশের মধ্যে নির্বাচনের ফল নিয়ে চরম উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। সে সময় শেষ পর্যন্ত সুপ্রিমকোর্টে বুশের কাছে পরাজয় মেনে নেন আল গোর।