বৈশ্বিক মহামারী করোনার ধকলের মধ্যে দেশে চুরি, দুর্নীতি, জালিয়াতি, টেন্ডারবাজি বিবেকবানদের কেবল কষ্ট নয়, দুর্ভাবনায়ও ফেলেছে। তার ওপর মহামারীর মতো ভর করেছে ধর্ষণ। এর মাঝেই কিশোর সমাজে উচ্ছৃঙ্খলতা। দিনকে দিন তা এখন ভয়ঙ্কর মাত্রায়। দল বেঁধে এরা জড়িয়ে পড়ছে পিলে চমকানো যত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। গণমাধ্যম এদের নাম দিয়েছে কিশোর গ্যাং। গ্যাংগুলোর নানা নামও রয়েছে। বিগবস, হাংকি-ফাংকি, নাইন স্টার, পাংকু টেন, ডিসকো বয়েজ প্রভৃতি আজব নামের এই গ্যাং শিরোমণিরা যার যার এলাকায় জাঁদরেল হয়ে উঠছে। তাদের ফেসবুক গ্রুপ থাকে, আলাদা নাম, বিশেষ পোশাকও থাকে। আজব নানা শব্দও উচ্চারিত হয় তাদের মুখে।
কিশোর গ্যাং কালচার আলোচনায় আসে ২০১৭ সালে রাজধানীর উত্তরায় দুই গ্রুপের বিরোধের জেরে স্কুলছাত্র আদনান নিহত হওয়ার পর। এরপর ঢাকার বাইরেও কিশোর গ্যাংয়ের একাধিক গ্রুপ গড়ে ওঠে। সম্প্রতি এক রাতে রাজধানীর উত্তরখান এলাকায় সোহাগ নামের এক কিশোর ওই চক্রের সদস্যদের হাতে খুন হয়। ওই রাতে দক্ষিণখান রাজাবাড়ি খ্রিষ্টানপাড়া রোডের ডাক্তারবাড়ি মোড়ে কিশোর গ্যাং ‘দি বস’র হৃদয়, রাসেলসহ বেশ কয়েকজন সদস্য আড্ডা দিচ্ছিল। ওই সময় একই রাস্তা দিয়ে যাওয়া একটি রিকশার চাকা থেকে কাদা ছিটকে হৃদয়ের গায়ে লাগলে সে ক্ষিপ্ত হয়ে রিকশাচালককে মারধর করতে থাকে। একজন অসহায় রিকশাচালককে সমবয়সী একজন ছেলেকে মারতে দেখে সোহাগ এগিয়ে আসে। সোহাগের প্রতিবাদে হৃদয় ও রাসেল ক্ষিপ্ত হয়ে ফোন করে তাদের গ্যাংয়ের অন্য সদস্য নাদিম, সানি, মেহেদী, সাদ, সাব্বিরসহ বেশ কয়েকজনকে ডেকে আনে এবং সবাই মিলে সোহাগের ওপর চড়াও হয়। নাদিমের ++++কাছে থাকা ধারালো ছোরা নিয়ে কাটার রাসেল সোহাগের পেটে উপর্যুপরি আঘাত করে পালিয়ে যায়। পরে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। ওই মামলায় দক্ষিণখান থানাধীন মোলারটেক থেকে রাসেল ওরফে কাটার রাসেল ও মো: হৃদয়কে গ্রেফতার করেছে র্যাব। এর আগে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ পাঠানটুলী এলাকায় আহাদ আলম শুভ মিয়া নামের এক যুবককে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে একটি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।
এলাকার এক যুবককে চড়-থাপ্পড়ের প্রতিশোধ নিতেই শুভকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ ও শুভর স্বজনরা। এছাড়া ফতুলার গাবতলীতে ওয়াসিফ গাউসিল উৎস নামের এক কিশোর রামদা হাতে নিয়ে প্রতিপক্ষকে ধাওয়া করে। এলাকার একটি ভিডিও ফুটেজে এ ঘটনা ধরা পড়ে। এছাড়া নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় কিশোর গ্যাংয়ের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ চলাকালে আত্মরক্ষার্থে শীতলক্ষ্যা নদীতে ঝাঁপ দেয় বন্দরের কদমরসুল কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র মিহাদ ও বন্দরের বিএম ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্র জিসান। পরে স্থানীয়দের সহযোগিতায় ওই দুই কিশোরের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে ফতুল্লার দেওভোগ আদর্শনগর কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা শরি হোসেন নামের এক ব্যবসায়ীকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে। নিহত শরিফের বাবা আলাল মাতব্বর জানান, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য শাকিল ও লালনসহ কয়েকজন শত্রুতার জেরে তার একমাত্র ছেলেকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। তথাকথিত এ-ই কিশোরদের এ ধরনের কা- এখন কেবল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জে নয়, দেশের প্রায় সব জেলা শহরে দোর্দ-প্রতাপে চলছে।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন সমাজের ভেতর এরা দাপটের সাথে আরেক সমাজ কায়েম করে চালিয়ে যাচ্ছে সব ধরনের অপকর্ম। দীর্ঘদিনের প্রচলিত সংস্কৃতি, ভাষা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, আচার-আচরণের বিপরীতে সিনেমেটিক শক্ত অবস্থান এই গ্যাংদের। মারামারি, খুনাখুনি, ছিনতাই, চুরি, পাড়া বা মহলার রাস্তায় মোটরসাইকেলের মহড়া, মাদক এবং ইয়াবা সেবন ও কারবার, চাঁদাবাজি, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করায় যত বাহাদুরিতে তাদের শেষ নেই। কোন গ্যাং কোন গ্যাংয়ের চেয়ে এগিয়ে, এ নিয়ে তাদের মধ্যে চলে প্রতিযোগিতাও। পুলিশের ক্রাইম অ্যানালাইসিস বিভাগের মাস দুয়েক আগের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকাতেই রয়েছে অন্তত ৫০টি কিশোর গ্যাং। ছোট-বড় মিলিয়ে বর্তমানে এ সংখ্যা শতের কাছাকাছি। বিভিন্ন জেলা শহরে পাড়া বা মহলাভিত্তিক গ্যাংও এখন ক্রিয়াশীল। বিরোধের পাশাপাশি আন্তঃমিল ও সম্মিলনও হয় তাদের। কার বা কাদের মদদে গড়ে উঠছে এ ধরনের গ্যাং? জবাব এক কথায় মিলবে না। তবে, নমুনা বলছে, বর্তমানে ভার্চুয়াল মিডিয়ার সহজলভ্যতায়, তারকাখ্যাতি, হিরোইজম, ক্ষমতা, বয়সের অপরিপক্বতা, অর্থলোভ, শিক্ষাব্যবস্থার ঝুঁকি এবং পারিবারিক বন্ধনের দুর্বলতা তাদের এই বিকারের পথে আনতে বড় ভূমিকা রেখেছে। এ বিষয়ে, বিশ্লেষক মহলও বলছেন, আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, আকাশ সংস্কৃতি ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা বা তথ্যপ্রযুক্তি কিশোরদের অপরাধপ্রবণতা বাড়ার অন্যতম কারণ। তথ্য-প্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণে শিশু-কিশোরদের নৈতিক স্খলন হচ্ছে। বিশেষ করে শহরের শিশু-কিশোররা পরিবার থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। এর ফলে তারা মাদকাসক্ত হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও দেশের অনেক এলাকায় রাজনৈতিকভাবে কিশোরদের ব্যবহারের প্রবণতার কারণেও তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টিকটক এবং লাইকি বিভিন্ন ধরনের কিশোর গ্যাংয়ের পদচারণা সামনে এগিয়ে নিচ্ছে।
‘কিশোর গ্যাং’ কালচারের উত্থানকে কেউ কেউ ভিন্নভাবেও দেখছেন। তাদের তত্ত্ব হচ্ছে, সব অপরাধ সংঘটনের পেছনেই কিছু ‘ট্রিগার ফ্যাক্টর’ কাজ করে। অপরাধী যে অপরাধ করছে তা সে অপরাধ ভেবেও করতে পারে আবার না ভেবেও করতে পারে।
কিশোর গ্যাং নিয়ে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ কিছু প্রাথমিক কাজ করেছে বলে শোনা যায়। তাদের একটি প্রতিবেদনের ভাসা ভাসা তথ্যে বলা হয়েছে, গত বছর কিশোর গ্যাংয়ের বিবাদে খুন হয়েছেন পাঁচ কিশোর। আর এ বছরের প্রথম আট মাসেই করোনার মধ্যেও খুনের তালিকায় যোগ হয়েছে আরো সাত কিশোর। বহু কথিত ‘কোমলমতি’ কিশোর শিক্ষার্থীদের হাতে ক্ষুর ও আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার, সহপাঠী খুন, মাদকাসক্তি এবং বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী অপরাধী অপতৎপরতা ঘটে চলেছে।
বেশ কিছুদিন আগে কুমিল্লায় এজাতীয় একটি ঘটনা সংবাদপত্রে প্রকাশ পেলে যথেষ্ট চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। সেই ধারাবাহিকতা চলেছিল বেশ কিছুদিন ধরে নানা সন্ত্রাসী তৎপরতায়। তখন থেকেই সংবাদমাধ্যমে কিশোর গ্যাং শব্দগুলোর প্রচলন। অল্প কয়েক বছরের মধ্যে মহামারীর মতোই কিশোর সন্ত্রাসের অভাবিত বিস্তার ঘটে রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরে। শুরুতে কেন্দ্রীভূত ছিল স্কুল শিক্ষার্থীদের অংশবিশেষের মধ্যে- এখন এর বিস্তার ঘটেছে অশিক্ষার্থী কিশোরদের মধ্যেও, এমনকি বস্তিবাসীর মধ্যেও। দিনমজুর বস্তিবাসীর সন্তান থেকে অভিজাত পরিবারের কিশোররা এখন এসব অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। আগেই বলেছি মাদকের কথা। সুস্পষ্ট কথায় দল বেঁধে মাদক সেবন থেকে মারামারি, এমনকি হত্যাকা-; আর পাড়ায় বা মহলায় কিশোরী ও তরুণীদের উত্ত্যক্ত করা তো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ফলে কখনো দেখা যায় প্রতিক্রিয়ায় উত্ত্যক্ত কিশোরীর আত্মহত্যা।
সাধারণ বিচারে এর কারণ হিসেবে বলা হয়, সামাজিক অবক্ষয়ের কথা, মূল্যবোধ ও আদর্শগত অভাবের কথা। সুস্পষ্ট ভাষায় দায়ভার নির্ধারণ করতে চাইলে প্রথম অভিযোগের দ-টা নেমে আসে পরিবারের ওপর। পারিবারিক শিক্ষার অভাব, শৈশব থেকে সনতানদের আদর্শনিষ্ঠ, সৎপথে পরিচালনায় অভিভাবকদের উদাসীনতা একটি প্রধান কারণ। বিত্তবান বা মধ্যবিত্ত ও অনুরূপ পরিবারে অভিভাবকরা ব্যস্ত নিজ নিজ কাজে বা অবসর-বিনোদনে। তারা ভুলে থাকেন যে সন্তানদের, প্রচলিত ভাষায় ‘মানুষ’ করে গড়ে তোলার দায় তাদের কাজ ও কর্তব্যের অংশ। সে দায় পালিত না হলে আদর্শহীন শিশু-কিশোর শিক্ষায়তনে বা বাইরে সঙ্গীদের কুপ্রভাবে পথভ্রষ্ট হয়, নিষিদ্ধ পথের টানে অপরাধজগতের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে।
দ্বিতীয় দায়িত্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের, যদিও সেটা সময় বিচারে আংশিক, তবু গুরুত্বপূর্ণ নজরদারির বিচারে। শ্রেণিকক্ষের বাইরে শিক্ষার্থীরা কী করছে সেদিকে লক্ষ রাখার দায় অবশ্যই শিক্ষকদের। প্রহার নয়, শাস্তি নয়, সন্তানতুল্য মায়া-মমতা ও দরদ দিয়ে প্রাথমিক পর্যায়েই পথভ্রষ্টদের সঠিক পথে নিয়ে আসা তাদের দায়িত্ব।
মহামারীর কারণে মার্চ থেকে গত আট মাস ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কিশোর-কিশোরীদের লেখাপড়ার চাপ নেই। এই অফ চান্সে তাদের মধ্যে পাড়া-মহল্লা, অলিগলিতে আড্ডা দেয়ার প্রবণতা বেড়েছে কি-না, প্রশ্নটি আমলে নেয়ার মতো। এটা করোনার সাইড ইফেক্ট হয়ে থাকলে ভবিষ্যতে এর মাধ্যমে বড় ধরনের অপরাধমূলক ঘটনার শঙ্কা থেকেই যায়। এ ব্যাপারে পরিবার ও সমাজের সঙ্গে রাষ্ট্রেরও দায় অনেক। কোনো রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় ঘুস, অনিয়ম আর দুর্নীতির অবস্থা ভয়াবহ আকার ধারণ করে তাহলে সেখানে আপনি ভালো সমাজ আশা করতে পারেন না।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট