বিতর্ক যেন ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে তাড়া করেই ফিরছে। তাকে ঘিরে সর্বশেষ বিতর্ক কয়েকদিন আগে তার কলকাতায় যাওয়ার ঘটনা নিয়ে।
ক্রিকেটে তার নিষেধাজ্ঞার অবসানের পর স্বাস্থ্যবিধি না মেনে ঢাকায় সুপার-শপ উদ্বোধন, বেনাপোল সীমান্তে ভক্তের হাত থেকে মোবাইল ফোন ফেলে দেয়া, কিংবা মুসলমান হয়ে কী করে পূজার উদ্বোধনে গেলেন, পরে আবার সেই ঘটনার জন্য আবার কী করে ক্ষমা চাইলেন ক্রিকেট পিচে রানের মতো একের পর এক বিতর্কের জন্ম দিয়ে চলেছেন তিনি। কিন্ত এ বিতর্ক শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নেই, তা ছড়িয়েছে ভারতেও।
হিন্দুত্ববাদীরা প্রশ্ন তুলছে, পূজা মণ্ডপে যাওয়ার পরে সাকিব ক্ষমা চাইলেন কেন?
তবে এসব বিতর্ক হতই না যদি পরেশ পাল নামের এক রাজনৈতিক নেতা সাকিবকে কলকাতায় আমন্ত্রণ না জানাতেন।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে অনেকেই মন্তব্য করছেন, ‘পরেশ পালকে কোরবানির ঈদে গরু জবাই করার দাওয়াত দেয়া হোক’, অথবা ‘পূজার উদ্বোধনে একজন মুসলমানকে যিনি নিয়ে গেছেন, তাকে ঈদে গরু জবাই করার দাওয়াত দিলে তিনি কি আসবেন?’
তবে পরেশ পাল বলছেন, ‘আমি তো কোরবানির ঈদের আগে বাংলাদেশে গেলে জবাই করার গরু কিনতে মুসলমান বন্ধুদের নিয়ে গরুর হাটে গিয়েই থাকি। এ আর নতুন কথা কি! আর বাংলাদেশে যেতে আমার দাওয়াত লাগবে নাকি, ওটা তো আমার জন্মভিটা। আমাদের আদি বাড়ি ছিল বরিশাল, আর জন্মেছি মামার বাড়ি বাগেরহাটে।’
আদি বাড়ি বরিশাল, মামার বাড়ি বাগেরহাট
ভারত ভাগ হওয়ার এক বছর আগে জন্ম নেয়া পরেশ পালের পরিবার উদ্বাস্তু হিসেবে জন্মভিটা ছেড়ে ভারতে চলে এসেছিলেন। তখন থেকেই পূর্ব কলকাতার কাঁকুড়গাছি এলাকায় তাদের বসবাস। বেড়ে ওঠা, রাজনীতি সবকিছুই ওই এলাকা ঘিরেই।
পরে কংগ্রেসি ঘরানার রাজনীতি করলেও একেবারে ছোটবেলা থেকে তিনি বড় হয়েছেন বামপন্থী দল আরএসপি-র নেতা মাখন পালের কাছে।
পরেশ পালের রাজনৈতিক জীবন খুব কাছ থেকে দেখা কলকাতার সিনিয়র সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরী বলেন, আরএসপি-র মাখন পালকে নিজের বাবার মতো মনে করেন পরেশ পাল।
তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদ সদস্য সুখেন্দু শেখর রায় বলেন, পরেশই সম্ভবত ভারতে প্রথম গণ-বিবাহের ধারণাটা চালু করের প্রায় ৪০ বছর আগে। এছাড়াও তার আরেকটা বড় উদ্যোগ সুভাষচন্দ্রের জন্মদিনকে কেন্দ্র করে একমাস ধরে সুভাষ মেলা করা। আর ১০-১২ বছর ধরে ইলিশ উৎসব করছেন তিনি। এছাড়াও বড় করে কালীপূজো তো করেনই।
কাঁকুড়গাছি-বেলেঘাটা এলাকার বাসিন্দাদের একাংশ অবশ্য বলছেন, পরেশ পালের উদ্যোগে হওয়া ওই বাৎসরিক গণ-বিবাহের ইতিবাচক একটা দিক থাকলেও বেশ কিছু নারী পুরুষ প্রতিবছরই ওই গণ-বিয়ে করেন। গণ-বিবাহে সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানোর জন্য এটা করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেলেঘাটা এলাকার এক বাসিন্দা জানান, ‘এলাকার রিকশাচালক, বিধবা নারীদের নিয়ে গিয়ে ওই অনুষ্ঠানে বিয়ে দেয়া হয়। তাদের সারাদিনের খাবার দেয়া হয়। কিন্তু অনেক বিয়েই তিন থেকে চার দিনের বেশি টেঁকে না বলেই আমরা জানি। উনি সবসময়েই চমক দিতে পছন্দ করেন।’
তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা সুখেন্দু শেখর রায়ও বলেছেন, ‘রাজনীতি হোক বা সামাজিক কাজকর্ম, চমক দেয়াটাই পরেশের স্বভাব। এই যে সাকিব আল হাসানকে নিয়ে বিতর্ক, সেখানেও তিনি চমকই দিতে চেয়েছিল বোধ হয়। অন্য অনেক পূজা কমিটি ভারতের ক্রিকেটারদের দিয়ে উদ্বোধন করান তার মাথায় কাজ করেছে আমি ভারতের ক্রিকেটার কেন আনব? বাংলাদেশের স্টার ক্রিকেটার নিয়ে আসব। তিনি এমনই।’
তবে এলাকায় কান পাতলে শোনা যায় ওইসব ‘ইতিবাচক’ সামাজিক কাজের জন্য বেলেঘাটা-কাঁকুড়গাছি অঞ্চলের ধনী বাসিন্দাদের কাছ থেকে বড় রকমের চাঁদা আদায় করেন তিনি।
২০১৬ সালে সর্বশেষ বিধানসভা নির্বাচনের আগে নিয়মমাফিক যে আয়ের হিসাব নির্বাচন কমিশনে জমা দিতে হয়, সেখানে দেখা যাচ্ছে যে তিনটি বাসভবনসহ পরেশ পালের স্থাবর সম্পত্তি আছে ৬৮ লাখ টাকার এবং ব্যাংক আমানত, গাড়ির মতো অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় ৪০ লাখ টাকা।
লাকার অনেক বাসিন্দা মনে করেন, আয়ের উৎস যাই হোক না কেন, তিনি দল-ধর্ম নির্বিশেষে এলাকাবাসীর জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।
পরেশ পাল বলছিলেন, ‘আমি ওই সব হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ বুঝি না, মানি না। হাতের আঙ্গুল কাটলে সবারই তো লাল রক্ত বেরবে।’
আবার তার ব্যাপারে অন্য কথাও শোনা যায়।
বেলেঘাটার এক বাসিন্দা বলেন, ‘পরেশ পাল দলমত নির্বিশেষে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন বলে যে কথাটা চালু আছে, তা অনেকটাই অসত্য। বহু বামপন্থী কর্মী পরেশ পালের সহচরদের অত্যাচারে হয় পাড়া ছাড়া হয়ে আছে অথবা রাজনীতি থেকে সরে গেছে। তার কোনো কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলে মার খেয়েছে, এমন উদাহরণও আছে অনেক।’
কলকাতার সিনিয়র সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরী জানান, ‘পরেশদার একটা টীম আছে যারা ২৪ ঘণ্টাই এলাকায় তৎপর থাকে। যেকোনো মানুষ বিপদে পড়লে তারা এগিয়ে যায়। এ ব্যাপারে খুব সংগঠিত পরেশদা। এটা কিছুটা সম্ভবত শিখেছে প্রয়াত তৃণমূল কংগ্রেস নেতা অজিত পাঁজার কাছ থেকে। তিনিও যেমন নিজের নির্বাচনী এলাকার খুঁটিনাটি তথ্য রাখতেন পরেশদার টীমটাও সেরকম। বেলেঘাটা অঞ্চলে তার এমনই প্রভাব, যে একবার তো স্বয়ং মমতা ব্যানার্জীকেও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছিলেন তিনি।’
মমতাকে চ্যালেঞ্জ করে জয়ী
তৃণমূল কংগ্রেস থেকে সাময়িকভাবে বেরিয়ে গিয়ে পৌরসভা নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জীর অফিসিয়াল প্রার্থীর বিরুদ্ধে নিজের প্রার্থী দাঁড় করিয়ে জিতিয়ে এনেছিলেন পরেশ পাল।
তারপরে যদিও আবারো তৃণমূল কংগ্রেসেই ফিরে গেছেন পরেশ পাল। প্রথমে কংগ্রেস দলের হয়ে বিধানসভার সদস্য হন ১৯৯৬ সালে। পরের বারও তিনি জয়ী হন। মাঝের পাঁচ বছর বাদ দিয়ে ২০১১ সাল থেকে পরপর দু’বার বেলেঘাটার এমএলএ তিনি।
‘বিধানসভায় পরেশ পালকে কোনো বক্তৃতা দিতে বা কোনো বিষয় উত্থাপন করতে দেখিনি আমরা। তিনি নিজের এলাকা নিয়ে পড়ে থাকে আর নানারকম অদ্ভুত আইডিয়াআসে তার মাথায়। বামফ্রন্টের প্রতীকী মৃত্যু ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জী একবার ব্রিগেড ময়দানে। সেই যে বিরাট ঘণ্টা বানানো হয়েছিল, সেটাও ছিল পরেশদার আইডিয়া।’
জয়ন্ত চৌধুরী বলেন, ‘একবার কলকাতায় মশাবাহিত রোগ বাড়ছে বলে ধর্মতলায় প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে রাস্তায় বিশাল একটা মশারী টাঙ্গিয়ে দিল। আরেকবার গরু-ছাগল নিয়ে গিয়ে পথ অবরোধ করেছিল।’
দীর্ঘ দিন রাজনীতি করলেও মন্ত্রীও যেমন হননি, তেমনই দলের গুরুত্বপূর্ণ পদও পাননি।
তৃণমূল নেতা সুখেন্দু শেখর রায়ের কথায়, ‘তিনি বোধ হয় চায়ও না ওসব। এলাকার বাইরে বেরিয়ে রাজনীতি বা সামাজিক কাজ করতে কখনই খুব একটা চায় না পরেশ।’
কিন্তু সেই পরেশ পালই এখন সাকিব আল হাসানকে কালীপূজার উদ্বোধনে নিয়ে এসে শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, বাংলাদেশেও আলোচিত নাম হয়ে উঠেছেন।