বারাক হোসেন ওবামা। মার্কিন ইতিহাসের প্রথম অশ্বেতাঙ্গ রাষ্ট্রপতি। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের এই যুগে পশ্চিমে ওবামা উদারনৈতিক গণতন্ত্রের কণ্ঠ হিসেবে পরিচিত। সাম্প্রতিক ওবামার আত্মজীবনী আ প্রমিজড ল্যান্ড বাজারে এসেছে। বিক্রির প্রথম দিনেই রেকর্ড গড়েছে। আত্মজীবনীতে ওবামা তাঁর রাজনৈতিক জীবনের নানা গল্প সাজিয়েছেন। কিন্তু ওবামার এই গল্প সবার জন্য সুখকর ছিল না। এই গল্প যেভাবে মার্কিন সমাজে ট্রাম্পের বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিকার হিসেবে কাজ করছে, সেভাবেই মধ্যপ্রাচ্যের নব্য উপনিবেশবাদবিরোধী গণতন্ত্রমনাদের বিষাদের চাদরে ঢেকে দিয়েছে।
আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়ার গণমানুষের কাছে ওবামা গণতন্ত্রের কণ্ঠ হিসেবে নয়, বরং একজন পরিপক্ব যুদ্ধবাজ হিসেবে পরিচিত।
আত্মজীবনীরূপে প্রকাশিত হলেও আ প্রমিজড ল্যান্ড ওবামার শাসন আমলের একটি রাজনৈতিক দলিল। বহির্বিশ্বে মার্কিন আধিপত্যবাদকে ক্ষুণ্ন করতে পারে—এমন সব বিতর্কিত বিষয়কে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে এই রাজনৈতিক দলিলে। সংক্ষিপ্ত কিন্তু বর্ণনা আকারে পুতিন থেকে শুরু করে আঙ্গেলা ম্যার্কেল, সারকোজি, ডেভিড ক্যামেরন, মনমোহন সিং, এরদোয়ানসহ আরও অনেকের নাম উঠে এসেছে। অস্বাভাবিকভাবে বাদ পড়েছে নরেন্দ্র মোদির নাম। পারস্য উপসাগরের দেশগুলোর সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্কের কথা, ‘আরব বসন্ত’ এবং মধ্যপ্রাচ্যের নানান জটিল বিষয়ও স্থান পেয়েছে। আত্মজীবনীতে ওবামা কথার বাহার ফুটিয়েছেন। তবে বাহারি ওবামা অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে যতটা সফল ছিলেন, ততটাই দেউলিয়া ছিলেন মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ থামাতে।
পরিবর্তনের আশা জাগিয়ে নির্বাচন জিতলেও আদতে বুশ সিনিয়র এবং জুনিয়রের যুদ্ধযাত্রার ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন ওবামা। বুশ জুনিয়র যেভাবে আফগানিস্তান ও ইরাক জ্বালিয়েছিলেন, ওবামা ঠিক একইভাবে সিরিয়া ও লিবিয়া জ্বালিয়েছেন। ফারাক শুধুই সময়ের, ব্যক্তির এবং ইস্যুর।
চিন্তাশীল পাঠকদের স্মরণে থাকার কথা, ২০০৯ সালে আফগানিস্তান ও ইরাকে মার্কিনদের চাপিয়ে দেওয়া মিথ্যা যুদ্ধের দাবানলের মধ্যে ওবামা ক্ষমতায় এসেছিলেন। প্রতিজ্ঞা করেছিলেন মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ থামানোর আর পরিবর্তনের। আর এই পরিবর্তনের সূচনাকল্পে ২০০৯ সালের গ্রীষ্মে ছুটে গিয়েছিলেন কায়রোতে। কায়রোর ভাষণে ‘মুসলিম বিশ্বের’ সঙ্গে মার্কিনদের নতুন শুরুর ঘোষণা দিয়েছিলেন ওবামা। চারদিকে রব উঠেছিল, এই বুঝি মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্র এল, শান্তি ফিরল বলে। কিন্তু গণতন্ত্র আসেনি। এসেছে নতুন নতুন যুদ্ধ। তথাকথিত ‘আরব বসন্তের’ নামে সিরিয়া ও লিবিয়ার মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে গৃহযুদ্ধ। আজ প্রায় এক যুগ পর নিরপেক্ষতার পাটাতনে দাঁড়িয়ে ‘আরব বসন্তের’ অলিগলি বিশ্লেষণ করলে প্রথাগত পশ্চিমের বয়ান থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি চিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়।
তাত্ত্বিকভাবে এই ভিন্ন চিত্রের একটি অংশ খ্যাতিমান নৃবিজ্ঞানী টিমোথি মিচেল তাঁর কার্বন ডেমোক্রেসি: পলিটিক্যাল পাওয়ার ইন দ্য এজ অব অয়েল গ্রন্থে এবং প্রখ্যাত মুসলিম চিন্তাবিদ তারিক রামাদান তাঁর ইসলাম অ্যান্ড দ্য আরব অ্যাওকেনিং গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও উভয় গ্রন্থই প্রত্যক্ষ মাঠকর্মের দরুন রচিত হওয়ার ফলে ভেতরের খবর উঠে এসেছে। দারুণভাবে মিচেল ও রামাদানের ওঠানো অনেক প্রশ্নের জবাব মিলেছে ওবামার এই রাজনৈতিক দলিলে।
‘অর্ধ শতাব্দীকাল বা তার বেশি সময় ধরে মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রে আমেরিকার বিদেশনীতির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, তেলের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলোর (শুরুর দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পরবর্তী সময়ে ইরান) প্রভাব বিস্তারকে রোধ করা’ (পৃষ্ঠা, ৬৩৪)।
টিমোথি মিচেল তাঁর বইয়ে ‘আরব বসন্তকে’ ‘বসন্ত’ বলতে নারাজ। মিচেল ‘আরব বসন্তকে’ মধ্যপ্রাচ্যে তেল উৎপাদন এবং আন্তর্জাতিক তেলবাজারে পেট্রলের অবাধ সরবরাহের কঠিন সমীকরণ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছেন। একই সঙ্গে মিচেল বিক্ষোভের সচ্ছলতা এবং একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে দ্রুত বিস্তারের পরিক্রমা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। মিচেলের প্রশ্ন কীভাবে বিক্ষোভ মিসর, লিবিয়া, তিউনিসিয়া ও বাহরাইনের মতো দেশে আগুনের গতিতে ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু বৃহৎ তেল উৎপাদনকারী দেশ সৌদি আরব, কাতার, ওমান, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিক্ষোভ দ্রুত ছড়ায়নি। অন্যদিকে, তারিক এ ঘটনাকে আরবদের ‘জাগরণ’–এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। পাশাপাশি তিনি গুগল, ফেসবুকসহ নানান মার্কিন কোম্পানির দিকে ইশরা করেছেন, যারা নির্দিষ্ট একটি অঞ্চলে বিক্ষোভ ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করেছিল। পরিষ্কারভাবে না হলেও মিচেল ও তারিকের প্রশ্নগুলোর সম্ভাব্য উত্তর পাওয়া যাবে ওবামার আত্মজীবনীতে। ওবামা লিখেছেন, ‘অর্ধ শতাব্দীকাল বা তার বেশি সময় ধরে মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রে আমেরিকার বিদেশনীতির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, তেলের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলোর (শুরুর দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পরবর্তী সময়ে ইরান) প্রভাব বিস্তারকে রোধ করা’ (পৃষ্ঠা, ৬৩৪)।
ওবামার এই বিবৃতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিননীতির একটি স্পষ্ট ব্যাখ্যা। যেখানে গণতন্ত্র নয়, বরং মার্কিন-ইসরায়েল স্বার্থই মুখ্য। আর এই স্বার্থ বাস্তবায়ন হয় গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নারী অধিকার এবং ইরান ও রাশিয়া ঠেকানোর নামে। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসের স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন ভাষণে ওবামা তিউনিসিয়ার বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু ওবামা এই একাত্মতা সিরিয়া ও বাহরাইনের বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে করেননি। আবার বিক্ষোভকারীদের দাবি আমলে নিয়ে হোসনি মোবারককে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে যেতে বললেও আসাদের বিষয়ে নীরব ছিলেন। লিবিয়ায় ন্যাটোর নেতৃত্বে বিমান হামলা শুরু করলেও সিরিয়ায় আসাদের বন্দুক থেকে বিক্ষোভকারীদের রক্ষায় মার্কিনরা শ্মশানের নীরবতা পালন করেছিল। মূলত, যেখানে মার্কিনরা ‘টেকসই মিত্র’ পেয়েছে, সেখানেই বিক্ষোভ দ্রুত ছড়িয়ে দিয়ে আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ জব্দ করেছে। তারিক তাঁর গ্রন্থে ‘টেকসই মিত্রের’ বিষয়টি বিস্তারিত আলাপ করেছেন। আদতে ২০০৬ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকেই মার্কিনরা হোসনি মোবারকের বিকল্প এবং নানা অবরোধে নিশ্চল লিবিয়ার তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণে গাদ্দাফিকে উৎখাতের পথ খুঁজছিল। মিসরে সৌদি ও আমিরাত এবং লিবিয়ায় ডেভিড ক্যামেরন ও নিকোলাস সারকোজি বিকল্প খুঁজতে মার্কিনদের সহায়তা দিয়েছেন।
পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ওবামা পশ্চিমে পঠিত হলেও আন্তর্জাতিক, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ওবামা একজন গণতন্ত্রের সংহারক হিসেবে ইতিহাসে পঠিত হবেন।
এই তথাকথিত ‘বসন্ত’–পরবর্তী সময় ছিল বেশ মর্মান্তিক, যা মধ্যপ্রাচ্যে নব্য উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সম্ভাবনাকে হত্যা করেছে। ওবামা যখন হোসনি মোবারককে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে যেতে আহ্বান জানান, তখন এই আহ্বানের পরিণতি নিয়ে আমিরাতের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদ ওবামার সঙ্গে আলাপ করেন। আলাপে যদি মোবারকের পর মুসলিম ব্রাদারহুড ক্ষমতায় আসে, তাহলে উপসাগরীয় প্রায় সব দেশে রাজতন্ত্রের পতন ঘটবে বলে জায়েদ হুঁশিয়ার করেছিলেন ওবামাকে। মার্কিনরা তাদের চিরকালীন মিত্রদের হারাবে। পরের ঘটনা সবার জানা। মার্কিন-আমিরাত-ইসরায়েল বলয়ের ক্রমাগত উসকানিতে সিসি নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে জেলে হত্যা করে বিদায় করেছেন। ওবামা থেকে প্রাপ্ত সাহসকে সিরিয়া ও লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে এবং তিউনিসিয়া ও তুরস্কে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের চেষ্টায় ব্যবহার করেছেন ক্রাউন প্রিন্স বিন জায়েদ। সর্বশেষ ইসরায়েলি দখলদারদের সঙ্গে সমঝোতা করে ফিলিস্তিনিদের দখলদারবিরোধী আন্দোলনকে পর্যুদস্ত করেছেন।
মজার বিষয় হলো আত্মজীবনীতে ওবামা মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্রের হত্যাকারী আমিরাতের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদকে ‘তরুণ পরিশীলিত এবং সম্ভবত আরব উপদ্বীপের সর্বাধিক কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন নেতা’ (পৃষ্ঠা, ৬৪৭) হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। পাঠকেরা নিশ্চয়ই বুঝে নিয়েছেন যে এখানে গণতন্ত্র নয়, বরং মার্কিন মিত্রতাই প্রধান।
পশ্চিমের নানান গুণীজন ওবামাকে গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে দেখেন। শ্বেতাঙ্গ–অধ্যুষিত মার্কিন রাজনীতিতে ওবামা পরিবর্তন এনেছেন। কিন্তু কর্মে সেই পরিবর্তন মার্কিন মুলুকেই সীমাবদ্ধ ছিল। পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ওবামা পশ্চিমে পঠিত হলেও আন্তর্জাতিক, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ওবামা একজন গণতন্ত্রের সংহারক হিসেবে ইতিহাসে পঠিত হবেন। পঠিত হবেন সিরিয়া ও লিবিয়ার গৃহযুদ্ধের অন্যতম কারিগর, আধুনিক মিসরের ইতিহাসে প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে হত্যাকারী সিসির উসকানিদাতা, আফগানিস্তানে ড্রোনের মাধ্যমে নির্বিচারে হাজার হাজার মানুষকে খুনের দায়ে। বারাক ওবামা, হিলারি ক্লিনটন, সুসান রাইস, সামান্থা পাওয়ার, কন্ডোলিসা রাইস ও কলিন পাওয়েল বারবার প্রমাণ করেছেন, সন্ত্রাসের কোনো ধর্ম, লিঙ্গ কিংবা বর্ণ নেই। সন্ত্রাস সন্ত্রাসই।
রাহুল আনজুম: আন্তর্জাতিক রাজনীতিবিষয়ক গবেষক।