বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন গতরাতে নাটকীয়ভাবে কোভিড-১৯ বিধিনিষেধ টিয়ার-৪ ঘোষণা দিয়েছেন। এতে বৃটেন জুড়ে ১৭ মিলিয়ন মানুষের ক্রিসমাস বাতিল হয়েছে। ভাইরাস সংক্রমণের বাড়তি ঝুঁকি এড়াতে প্রধানমন্ত্রী এই পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। মহামারি মোকাবেলায় লন্ডনসহ সাউথ ইস্ট ইংল্যান্ডে আজ থেকেই কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।
নতুন ঘোষণায় জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। ইতিপূর্বে নর্দার্ণ আয়ারল্যান্ড ছয় সপ্তাহের লকডাউন এবং ওয়েলস তিন সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করেছে। তখন লকডাউন না দিয়ে বরিস জনসন বলেছেন, ইংল্যান্ডে তৃতীয় লকডাউন এড়ানো যাবে বলে তিনি আশাবাদী। কিস্তু শেষ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রীর ইউ-টার্ন ‘অসঙ্গতি এবং বিভ্রান্তিকর’ বলে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। এনিয়ে বহু মানুষের মধ্যে ক্রোধের সৃষ্টি হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে।
সমালোচকরা বলছেন, গত সপ্তাহে বিভিন্ন অঞ্চলে ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা সতর্ক করেছেন যে, এনএইচএস ইতিমধ্যে উল্লেখযোগ্য চাপের মধ্যে রয়েছে। রয়্যাল কলেজ অব ইমার্জেন্সি মেডিসিনের প্রেসিডেন্ট ডা. ক্যাথরিন হেন্ডারসন বলেছেন, ভাইরাস আটকানোর জন্য ইংল্যান্ড এবং স্কটল্যান্ডকে ‘যা কিছু প্রয়োজন’ করা দরকার। তিনি মূলত ‘সম্পূর্ণ লকডাউন’ বুঝাতে চেয়েছেন। তখন শিথিলতা দেয়ায় সরকারের ঘোষণার আলোকে লক্ষ লক্ষ মানুষ ইতিমধ্যে উৎসবের পরিকল্পনা করেছেন, ভ্রমণ বুক করেছেন এবং পুনর্মিলনের জন্য খাবার কিনেছেন। এখন ক্রিসমাসের ঠিক ছয় দিন আগে সব কিছু বাতিল করে দেয়া হয়েছে। আর এটাই তাদের ক্ষোভের প্রধান কারণ।
নতুন ঘোষণা মোতাবেক বিনোদন ও সেবা সার্ভিস এবং অ-অপরিহার্য দোকানগুলি বন্ধ করতে বাধ্য করা এবং ক্রিসমাস দিবসে বাধ্যতামূলক ‘বাড়িতে থাকার’ আদেশসহ ভ্রমণে বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। এছাড়া জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সকল কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। অথচ নির্মাণ শ্রমিক এবং সেখাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কর্মক্ষেত্রে যাওয়ায় কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকছে না। এধরণের সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক ও অমানবিক মনে করেন কেউ কেউ।
বরিস জনসন বড়দিন পারিবারিকভাবে উৎযাপন করার কথা বলেছেন। তবে বাসার বাইরে কোনো উৎসব বা সমাবেশ করা যাবে না বলে ঘোষণায় জানিয়েছেন। করোনা ভাইরাস মহামারি মোকাবেলায় সাউথ ইস্ট ইংল্যান্ডে আজ থেকেই কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। টিয়ার-৪ যেসব এলাকায় ঘোষণা করা হয়েছে সেখানে বাইরে থেকে প্রবেশ না করার আহবান জানিয়েছেন বরিস জনসন। এই কড়াকড়ি দুই সপ্তাহের জন্য ঘোষণা করা হয়েছে। আগামী ৩০শে ডিসেম্বর এটি আবারো পর্যালোচনা করে দেখা হবে।
বরিস জনসনের জন্য এটা স্পষ্টভাবে অস্বস্তিকর। তবে মি. জনসন জাতিকে বলেছেন, গতকাল ভাইরাস সংক্রমণের ভয়াবহতার যে রিপোর্ট উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে তার সামনে আর কোন ‘বিকল্প’ ছিল না। কারণ গত সপ্তাহে লন্ডনে নতুন ৬০ শতাংশ রোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। ফলে এখনই এই পদক্ষেপ নিতে হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী জনগণের প্রতি আবেদন জানিয়ে বলেন, আপনারা ‘স্থানীয়ভাবে থাকুন’। পরিকল্পনা মতো হয়ত আমরা ক্রিসমাস উৎযাপন করতে পারব না। আমি জানি বছরের এই সময়টিতে লোকেরা কতটা আবেগ নিয়ে দাদা-দাদির কাছে যায়। নাতি-নাতনি এবং পরিবারকে একত্রে দেখতে পাওয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং আমি বুঝি এটি অনেক হতাশার কারণ হবে। তবে আমাদেরকে অবশ্যই বিজ্ঞান দ্বারা পরিচালিত হতে হবে। আপনাদের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি যে, আমার পক্ষে কোনও বিকল্প নেই। তথ্য প্রমাণে দেখা গেছে, ভাইরাস দ্রুত ছড়াবে। হাজার হাজার মানুষ তাদের জীবন হারাবেন। মি. জনসন অবশ্য বলেছেন, আমি আশাবাদী যে, আমরা শীঘ্রই এই ভাইরাস থেকে মুক্তি পাবো।
এদিকে চিফ মেডিকেল অফিসার প্রফেসর ক্রিস হুইটি বলেন, বিপদ হল দেশজুড়ে চলাফেরা করা লোকেরা ভাইরাসের ‘বীজ’ ছড়াচ্ছেন। চিফ সায়েন্স অফিসার প্যাট্রিক ভ্যালেন্স বলেছেন, আশাব্যঞ্জক সংবাদ হল এখন পর্যন্ত সাড়ে ৩ লাখ মানুষকে ভ্যাকসিন প্রথম ডোজ দেয়া হয়েছে। ভাইরাস যাতে সহজে ছড়িয়ে না পড়ে তাই এটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
নতুন টিয়ার-৪ নিয়মটি মূলত ইংল্যান্ডে নভেম্বরে যে টিয়ার-৩ সাউথ ইস্ট অঞ্চল হিসেবে লকডাউনের অধীনে ছিল। সাউথ ইস্ট এর মধ্যে রয়েছে কেন্ট, বাকিংহামশায়ার, বার্কশায়ার, সারে (ওয়েভারলি বাদে), গোসপোর্ট, হাভান্ট, পোর্টসমাউথ, রথার এবং হেস্টিংসক। এটি সমস্ত লন্ডন (৩২টি বারা/শহর) এবং ইস্ট ইংল্যান্ড (বেডফোর্ড, সেন্ট্রাল বেডফোর্ড, মিল্টন কেন, লুটন, পিটারবারো, হার্টফোর্ডশায়ার, এসেক্স (কোলচেস্টার, উটলসফোর্ড এবং টেন্ডারিং বাদে) এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে।
গতরাতে ওয়েলসের প্রথমমন্ত্রী মার্ক ড্রেকফোর্ড বলেছেন, ২৮শে ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা না করে আজ থেকে টিয়ার-৪ লকডাউন কার্যকর হবে। লন্ডন এবং সাইথ ইস্ট অব ইংল্যান্ডে যে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমরা ওয়েলসের জন্য সতর্কতার স্তর টিয়ার-৪ বিধিনিষেধকে সামনে আনার কঠিন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি। এর অর্থ হবে অপ্রয়োজনীয় খুচরা দোকান, ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের পরিষেবা, জিম এবং অবসর কেন্দ্র এবং আতিথেয়তা ট্রেডিং বন্ধ থাকবে।
উল্লেখ্য, যুক্তরাজ্যের করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের পরিমাণ গত শনিবার ২৭,০৫২ জন বেড়েছে। এর অর্থ মোট সংক্রমণের সংখ্যা দুই মিলিয়নে চলে গেছে। নতুন আরও ৫৩৪ জন মারা গেছেন। গত শনিবারের চেয়ে ১৪ জন বেশি এবং গতকালের চেয়ে ৪৫ জন বেশি মারা গেছেন। মোট মৃত্যুর সংখ্যা ৭৬,২৮৭ জনে দাঁড়িয়েছে।