ঢেউ উঠেছিল দক্ষিণ চীন সাগরের কাছে উহানে। চীন থেকে ইতালি, ব্রিটেন হয়ে গোটা ইউরোপ পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল। তারপর এশিয়ায় শুরু হয় সেই ঢেউয়ের আঘাত হানা। ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে ঢেউ আছড়ে পড়েছে দুই শতাধিক দেশে। পৃথিবীর কোনো শক্তি এ ঢেউয়ের আঘাত আটকাতে পারেনি। প্রতিষেধক আবিষ্কারের আশার বাণী শুনতে শুনতে ঝরে গেছে ১৭ লাখ প্রাণ।
পৃথিবীর মানুষ বিচলিত, বিপর্যস্ত। থমকে গেছে জীবনের সব নিয়মিত কর্মযজ্ঞ। বদলে গেছে স্বাভাবিক নিয়ম-কানুন ও গতি-প্রকৃতি। সমূহ বিপদ জেনেও জীবনের তাগিদে নিজ নিজ জীবিকা সচল রেখে বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছা মানুষকে ঘরের বাইরে বের করে ফেলেছে। মানুষ একদিকে মৃত্যু ভয়ে জর্জরিত, অন্যদিকে নিয়ন্ত্রণহীন ও বেপরোয়া চলাফেরা সবকিছুকে এলোমেলো করে দিচ্ছে।
অনেক দেশ নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ইতোমধ্যে টিকা আবিষ্কারক একাধিক দেশের সঙ্গে চুক্তি সই করেছে। বাংলাদেশও টিকা ক্রয়ের উদ্যোগ নিয়েছে। যদিও নিু আয়ের দেশ হওয়ায় আমাদের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বিনামূল্যে টিকা পাওয়ার আশ্বাস রয়েছে, তথাপি কবে তারা সেটা দিতে পারবে সেই আশায় কালক্ষেপণ না করে আমরা নিজ উদ্যেগে টিকা সংগ্রহের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। যারা আগে সরবরাহ করতে পারবেন, তাদের টিকা আমরা আগে সংগ্রহ করব বলে ধারণা করা হচ্ছে।
করোনার প্রভাবে জীবন-জীবিকার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে বিশ্বব্যাপী স্বাভাবিক জীবনের সবকিছুই ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে সম্পাদনের চেষ্টা চলছে। এ প্রচেষ্টায় আমরাও পিছিয়ে নেই। কিন্তু এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে আমরা হোঁচট খাচ্ছি পদে পদে। বিশেষ করে আমাদের নাগরিকদের অসম সামাজিক অবস্থা ও বৈষম্যমূলক আয়বিন্যাস এবং ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে শিক্ষাক্ষেত্রে ভার্চুয়াল পদ্ধতির প্রচলন দায়সারা গোছের বলে প্রতীয়মান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনও খুলে দেয়া যায়নি।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভার্চুয়াল ক্লাস ও পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা করা হলেও বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে সেগুলোর যথার্থতা নেই। সরকারি কলেজগুলোতেও একই অবস্থা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভার্চুয়াল ক্লাস নেয়ার প্রক্রিয়া চললেও পরীক্ষা নেয়ার কোনো ব্যবস্থা এখনও নেয়া যায়নি। এক মাঠ জরিপে দেখা গেছে, নানা সমস্যায় ৩০-৪০ ভাগ শিক্ষার্থী এ সুযোগের আওতায় আসতে পারছে না। একটা শক্ত অবকাঠামো ছাড়া হঠাৎ করে অনলাইন শিক্ষা গোঁজামিল দিয়ে সেশন পার করার নামান্তর মনে হচ্ছে।
এদিকে সারা পৃথিবীর সবকিছু ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে রূপান্তরিত হয়ে গেলে দরিদ্র দেশগুলো উন্নত দেশগুলোর তুলনায় আরও পিছিয়ে পড়বে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, করোনার প্রভাবে ধনীরা আরও বেশি ধনী হবে এবং দরিদ্র দেশের জনগোষ্ঠী আরও বেশি দরিদ্র হবে।
করোনার প্রভাবে যেমন বেকারত্ব বেড়েছে, তেমনি পেশার আমূল পরিবর্তন আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশগত পরিবর্তন সূচিত করে চলেছে। ভারতে ক্রিকেটার হয়েছেন ট্যাক্সিচালক, আমাদের দেশে সিনেমার নায়ক হয়েছেন মুদি দোকানদার। ভিক্ষুকদের বেড়েছে জীবন-যন্ত্রণা। আগে হাতে থালা নিয়ে দশ বাড়ি ঘুরলেই তাদের পেট ভরত। এখন বাড়ি বাড়ি ঘুরে তারা দরজা পর্যন্ত যেতে পারে না। সরকারি সাহায্য তাদের অনেকের নাগালে পৌঁছে না। বিশেষ করে পঙ্গু ও অক্ষম ভিক্ষুকদের মরণদশা চলছে। তাদের কেউ খোঁজখবর নিতে পারে না।
মাস্ক না পরার কারণে জরিমানা করা হচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়। কিন্তু অনেকের নতুন মাস্ক কেনার টাকা নেই। তাই জরিমানা না করে দরিদ্রদের জন্য প্রতিটি বাসে, অফিসে, বাজারে, শপিংমলের দরজায় বিনা পয়সায় একটি বিশেষ রঙের মাস্ক প্রদানের ব্যবস্থা রাখা উচিত। এ মাস্ক পরলে যেন বোঝা যায় তিনি বিনা পয়সার মাস্ক পরিধান করেছেন। তাহলে কেউ একদিন ভুল করে মাস্ক না পরে বাইরে বের হলেও ধরে নেয়া যায় তিনি লজ্জায় পরবর্তী সময়ে নিজের কেনা মাস্ক পরে বের হবেন।
সরকার তো বটেই, বিত্তবান দানশীল ব্যক্তি ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত এ মুহূর্তে বিভিন্ন জায়গায় বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণ শুরু করা। কারণ সংক্রমণ ও মৃত্যুর এ ঢেউ কবে থামবে তা কেউ জানে না। যেসব দেশ ভেবেছিল, তাদের দেশ থেকে করোনা বিদূরিত হয়েছে, তারা ২য় ও ৩য় পর্যায়ের ঢেউয়ের আঘাতে আবার সংক্রমিত হয়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন। সংক্রমণ শুরু হওয়ায় উত্তর কোরিয়া ও ভিয়েতনামের ভুল ভেঙে গেছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় আবার স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
ভারতে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃত্যু। সেখানে টেস্ট সংখ্যা বেশি হওয়ায় প্রকৃত পরিস্থিতি জনগণ জানতে পারছে। প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় আমরা দিন কাটাচ্ছি আতঙ্কে। আমাদের দেশের মানুষ স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা করে না।
বেপরোয়া বাংলাদেশিরা সারা জীবন বন্যা-সাইক্লোনে নদী-সমুদ্রের ঢেউ সামলে দিন গুজরান করতে অভ্যস্ত হলেও করোনার ২য় ও ৩য় পর্যায়ের ঢেউয়ের আঘাতের সঙ্গে আত্তীকরণ করে টিকে থাকতে পারবে তো?
ড. মো. ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান
fakrul@ru.ac.bd