রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৫৯ পূর্বাহ্ন

নতুন একটি সামাজিক চুক্তির জন্য

ড. মাহবুব উল্লাহ্
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২০
  • ৫২৩ বার

প্রিয় পাঠক, আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, আমি কয়েকটি কলাম রচনা করতে গিয়ে লিখেছিলাম ন্যায্যতা অর্জনের জন্য সিদ্ধান্ত হতে হবে অজ্ঞানতার অন্ধকারের মধ্যে। বিষয়টি শুনতে অদ্ভুত মনে হয়। অজ্ঞানতার অন্ধকার বলতে কী বোঝায় সেটা দৃষ্টান্ত দিয়ে বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছি।

পাঠক হয়তো ইতোমধ্যে ভুলেই গেছেন আমি আসলে কী ব্যাখ্যা দিয়েছিলাম। এটা খুবই স্বাভাবিক। মানুষ যা পড়ে বা শোনে তার ৭০ শতাংশই ভুলে যায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। এগুলো নিয়ে অনেক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল হিসেবেই বলা হচ্ছে, একদিন গত হতে না হতেই মানুষ অনেক কিছু ভুলে যায়। এ ধারণাটি যে কত প্রয়োজনীয় তা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়।

১৯৭১ সালে মার্কিন রাজনৈতিক দার্শনিক জন রলসের ‘A Theory of Justice’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। জন রলস্ এ গ্রন্থে বলেছেন, বিচার হতে হবে ন্যায্যতা বা পক্ষপাতহীনভাবে। বিচার সম্পর্কে তার এ মতবাদ সামাজিক চুক্তি তত্ত্বের মধ্যে পড়ে। সামাজিক চুক্তির তত্ত্ব আসলে খুব পুরনো।

এর সূচনা হয়েছে দার্শনিক প্লেটোর লেখায়। পরবর্তীকালে হবস্, লক্ ও রুশো এ ধারণাটি সম্পর্কে বৃহত্তর পরিসরে আলোচনা করেছেন। আমরা যে আইনের শাসনের কথা বলি, একটি ভূখণ্ডের বাসিন্দারা পরস্পরের মধ্যে একমত হয়ে যা কিছু করার প্রতিজ্ঞা করেন তা আসলে একটি সামাজিক চুক্তি।

এর দ্বারা সব পক্ষই উপকৃত হন। মানুষের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার চেয়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টা অনেক বেশি ফলদায়ক। জন রল্স সামাজিক চুক্তি সংক্রান্ত তার ভাষ্যে যা কিছু বলেছেন সেটা আসলে চিন্তাভাবনা নিয়ে এক ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পূর্বশর্ত হল মানুষকে তার সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে অবহিত না করে অথবা যাকে বলা হয় ‘মূল অবস্থান’ (Original Position), এর মধ্যে অবস্থান করেই সামাজিক চুক্তি বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

জন রল্স মনে করেন, এভাবেই ন্যায়বিচারের নীতিগুলো প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব এবং সব যুক্তিবাদী মানুষ এ ব্যাপারে একমত হবেন। ধরে নেয়া যাক একদল আগন্তুক একটি দ্বীপের মধ্যে বিপদগ্রস্ত অবস্থায় পতিত হল। তাদের উদ্ধার করার জন্য কেউ আসবে না, এ ব্যাপারেও তারা নিশ্চিত। এখন তারা কী করবে? তারা এ নির্জন দ্বীপকেই স্থায়ী বসবাসের স্থান হিসেবে বেছে নেবে এবং প্রথম থেকেই এখানে একটি নতুন সমাজ গড়ে তোলার জন্য একমত হবে। নির্জন দ্বীপে যারা ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্যে পতিত হয়েও বেঁচে গেছে এবং একটি জনমানবহীন দ্বীপে পৌঁছেছে, তারা সবাই স্বীয় স্বার্থ অর্জনের জন্য চেষ্টা চালাবে। তবে তারা এটাও বোঝে যে সম্মিলিতভাবে বা সবাই মিলে পারস্পরিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে কাজ না করলে লাভবান না হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

অর্থাৎ তাদের একটি সামাজিক চুক্তিতে পৌঁছতে হবে। প্রশ্ন হল, তারা কীভাবে ন্যায্যতার নীতির ভিত্তিতে এ চুক্তি সম্পাদন করবে? নিয়ম-কানুন কী হবে? তারা যদি সত্যিকার অর্থে নৈতিক ও পক্ষপাতহীন সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাহলে তাদের হাজারও রকমের নিয়ম-কানুন রচনার চেষ্টা অবিলম্বে পরিহার করতে হবে।

দৃষ্টান্তস্বরূপ একটি নিয়মের কথা বলা যায়, যেমন- তোমার নাম যদি রহিম হয় তাহলে তুমি সবার শেষে খাবার খাবে। এ ধরনের নিয়ম না যুক্তিসঙ্গত, না পক্ষপাতিত্বহীন। হয়তো এমনও হতে পারে- যার নাম রহিম তার জন্য এ ব্যবস্থা সুখপ্রদ।

এ রকম পরিস্থিতিতে জন রল্সের সুপারিশ হল অজ্ঞানতার অবগুণ্ঠনের জাল ছড়িয়ে দেয়া। এর ফলে জীবনে যা ঘটবে তার কোনো কিছুই অগ্রিম জানা যাবে না। যেমন আমরা কারা, কখন আমাদের জন্ম হয়েছে? এর পরই আমরা ভাবব কী ধরনের নিয়ম-কানুন আমাদের জীবনযাত্রার জন্য সহায়ক হবে।

জন রল্স প্রায়ই বলতেন, এমন সব আইন-কানুন করতে হবে, যা সব দলমতের লোকজন যুক্তিসঙ্গত মনে করে এবং এর মধ্যে কোনো পক্ষপাতিত্ব থাকে না। মানুষের জাত, শ্রেণি, ধর্মীয় বিশ্বাস, প্রকৃতি প্রদত্ত প্রতিভা অথবা প্রতিবন্ধিত্ব ধরনের বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়া হবে না। আমি যদি না জানতে পারি সমাজে আমার অবস্থান কী হবে, তাহলেই কেবল যুক্তিসঙ্গত ব্যক্তিগত স্বার্থ আমাকে বাধ্য করবে এমন একটি সমাজের জন্য ভোট দিতে, যার ফলাফল হিসেবে সবাইকে ন্যায্যতার দৃষ্টিতে দেখা হবে।

বাংলাদেশ তার জন্মের ৪৯ বছর অতিক্রম করেছে। অচিরেই ৫০ বছর বা অর্ধশতাধিক অতিক্রম করবে। এতগুলো বছর একটি জাতির জন্য বিশাল সময়। কিন্তু আমাদের অর্জনগুলো পার করা সময়ের সঙ্গে আনুপাতিকভাবে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সমস্যা ও সংকট দিনে দিনে বাড়ছে। এগুলোর প্রকৃতি এমন যে, এর যে কোনো একটা ভেঙে পড়লে পুরো সমাজটাই ভেঙে পড়বে। গণতন্ত্রের জন্য এ দেশের মানুষ রক্ত দিয়েছে।

কিন্তু গণতন্ত্র দিনে দিনে বিবর্ণ হয়ে পড়ছে। যেসব প্রতিষ্ঠান একটি জাতিকে টিকিয়ে রাখা এবং সমৃদ্ধ করার জন্য ভূমিকা পালন করে সেগুলোও অত্যন্ত ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। সাধারণ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল ও কলেজ, বিদেশে পুঁজি পাচার, ব্যাংকগুলোর করুণ অবস্থা, খেলাপি ঋণের দাপট, শেয়ার মার্কেটের বিপর্যয় এবং দুর্নীতি বাংলাদেশকে ভয়াবহ সংকটের মধ্যে ফেলেছে।

এ দেশে কিছু ভালো কাজ হয়নি এমন নয়। খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে, পোশাকশিল্পে বড় রকমের সাফল্য অর্জিত হয়েছে এবং দেশের মানুষ বিদেশে গিয়ে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে দেশে টাকা পাঠাচ্ছে। এছাড়া কিছু কিছু শিল্পের ক্ষেত্রেও সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাচ্ছে। এসব শিল্পের মধ্যে রয়েছে চামড়াশিল্প, টাইলসশিল্প ও ঔষধশিল্প। এগুলোর ক্ষেত্রে বিরাট সম্ভাবনা নিহিত রয়েছে।

একটি সংবাদপত্রে পড়লাম, সরকার নিদারুণ অর্থ সংকটে পড়েছে। এ কারণে সরকার কৃচ্ছ্রসাধন নীতি গ্রহণ করতে চায়। এ দেশে সংকট ও সমস্যা সময় থাকতে বিচার বিবেচনা করা হয় না। সংকট যখন অচলাবস্থার সৃষ্টি করে কেবল তখনই আমাদের ঘুম ভাঙে।

এ রকম ঘুম ভাঙা পরিস্থিতিতে নীতিনির্ধারণে অগোছালো পরিস্থিতি দেখা দেয়। কৃচ্ছ্র নীতি অনেক আগেই নেয়া উচিত ছিল। বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনে কৃচ্ছ্র নীতির কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে কিছুই করা হয়নি। শিক্ষার মান বিপজ্জনকভাবে অবনত হয়েছে।

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো শিক্ষাব্যবস্থা আরও ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে করোনা দুর্যোগের কারণে। এইচএসসির মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হচ্ছে না, এসএসসিও অনিশ্চিত। এর ফলে জ্ঞানশূন্যতা আরও বাড়বে।

বাংলাদেশ এখন যে অবস্থায় উপনীত হয়েছে, তা থেকে মুক্ত হতে না পারলে সমগ্র জাতি মহাসংকটের কবলে পড়বে। এ সংকট থেকে মুক্ত থাকার জন্য প্রয়োজন নতুন একটি সামাজিক চুক্তি। যে কোনো দেশের জন্য সামাজিক চুক্তির দলিল হল সে দেশের সংবিধান। আমাদের সংবিধান এতবার কাটছাঁট হয়েছে যে এখন আর এ সংবিধানকে চেনা যায় না।

সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান মুছে ফেলার ফলে নির্বাচন এখন প্রহসনে পরিণত হয়েছে। মানুষ নির্বাচনব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করছে। তারা ভোট কেন্দ্রে যেতেও চাইছে না। পরিস্থিতি এতই হতাশাজনক যে, সরকারদলীয় সমর্থকরাও ভোট কেন্দ্রে যেতে অনীহা প্রকাশ করছে।

জাতির জন্য এ পরিস্থিতি একটি অশনিসংকেত! সামগ্রিক সংকট দূর করার জন্য সর্বপ্রথম যে কাজটি করা প্রয়োজন সেটা হল সব ব্যক্তি ও দলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন। এটাই হল নতুন সামাজিক চুক্তি। এরপরও অনেক কাজ করতে হবে। সময়ের কাজ সময়মতো না করলে পর্বতপ্রমাণ খেসারত দিতে হবে।

জন রলস যে Original Position-এর কথা বলেছেন, সেটি নিশ্চিত হতে পারে সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সরকারের মাধ্যমে। এ সরকার হতে পারে একটি জাতীয় সরকার অথবা একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এসব করার পর নির্বাচনের জন্য একটি সমতল মাঠ তৈরি করার জন্য প্রয়োজন দলীয় প্রভাবমুক্ত একটি জনপ্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান।

এসব পদক্ষেপকে কেন্দ্র করে অনেক প্রশ্ন উঠতে পারে। দুনিয়ায় এমন কোনো কাজ নেই যা বিতর্কের ঊর্ধ্বে। তবে বিতর্কগুলোকে কমিয়ে আনাই ভালো কিছু অর্জনের জন্য সহায়ক। আমরা যেন এমন একটি নীতিতে উপনীত হতে পারি যাকে দার্শনিক বেনথাম বলেছেন, Greatest good for the greatest number.

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com