প্রত্যেক প্রেসিডেন্টই পৃথক; তিনি কী করবেন, বাইরে থেকে না যায় পরামর্শ দেওয়া, না যায় নিয়ন্ত্রণ করা। দি অ্যান্ড অব পাওয়ার গ্রন্থের মুখবন্ধে লিখেছেন হ্যারি রবিনস হ্যালডেম্যান, যিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের বিতর্কিত ও পদচ্যুত প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের চিফ অব স্টাফ। জো বাইডেন এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পÑ দুজন দুই মাত্রার ব্যক্তিত্ব, দুজন পৃথক প্রেসিডেন্ট। ট্রাম্পকে আজ টা-টা-বাই-বাই জানাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, স্বাগত জানাচ্ছে বাইডেনকে।
নভেম্বরের নির্বাচনে ‘আগে আমেরিকা’র বদলে ‘সামনে আচ্ছা দিন’কে বেছে নিয়েছিলেন মার্কিন ভোটাররা। সেই ‘সুদিন’ শুরু হচ্ছে দেশটির ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রবীণ ডেমোক্র্যাট নেতার শপথগ্রহণের মধ্য দিয়ে। বাইডেনের এ যাত্রা তাই নতুন আশা নিয়ে পুরো মার্কিন মুল্লুকেরই যাত্রা। সুদিন-পিয়াসী এ যাত্রার পানে নতুন আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে সারা বিশ্বও।
জয় নিশ্চিত বুঝেই ৭ নভেম্বর বাইডেন বলেছিলেন- ‘আমেরিকার আত্মাকে ফেরাতে আমি এ নেতৃত্ব দিতে চেয়েছি। জাতির মেরুদ- মধ্যবিত্তরা যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে, এ জন্য আমি প্রেসিডেন্ট হতে চেয়েছি। আমি এ দায়িত্ব পেতে চেয়েছি যেন দেশের ভেতর নিজেদের মধ্যে ঐক্য ফেরাতে পারি, এবং একই সঙ্গে বিশ্বদরবারে আমেরিকাকে মহিমান্বিত করে তুলতে পারি।’
বাইডেনের এ কথা থেকেই বোঝা যায়, ট্রাম্পের আমলে আমেরিকার আসল চরিত্র ঠিক ছিল না; দেশটি ছিল বিদ্বেষের বিষে আক্রান্ত এবং বহির্বিশ্বে তেজহীন।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কতটা জনগণের হবে? এ প্রশ্ন রয়েই যায়। কারণ এই বাইডেনই আট বছর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পুরো দুই মেয়াদে। তাদের দ্বিতীয় মেয়াদেই কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষত সিরিয়ায় উগ্রপন্থা ও জঙ্গিবাদের উত্থান ও চূড়ান্ত বিকাশ হয়েছিল; ওই সংকটের পেছনে তাদের নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়ে বিতর্কও কম হয়নি।
সুতরাং ট্রাম্পের (অনেতা) বিদায় আর বাইডেনের (সুনেতা) আগমন হলেও প্রশ্ন রয়েই যায়Ñ আমেরিকা কি আদৌ আচ্ছা দিনের দেখা পাবে? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমনটি বলেছিলেনÑ ‘কাহারো জগতে সূর্যোদয় আছে, আঁধারের অপগমন ও আলোকের আগমন আছে, কিন্তু প্রভাত নাই।’
ট্রাম্প যে বাস্তববাদী বিশেষত বিজ্ঞানমনস্ক ছিলেন না, করোনা ভাইরাস মহামারী মোকাবিলায় তার পদক্ষেপ-হস্তক্ষেপগুলো সে কথাই বলে। বাইডেনের নীতি বিজ্ঞানবান্ধব হবে তো? এমন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটির জ্যোতি পদার্থবিজ্ঞানী প্রিয়ম্বদা নটরাজন নভেম্বরে এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘হবে বৈকি। বিজ্ঞানের ওপর আঘাত আর আসবে না। দেখুন গত কয়েক দশকে বিজ্ঞানবিদ্বেষ এই দেশে বেশ বেড়েছে। আমি আশাবাদী, [বাইডেনের জয়ের ফলে] বিজ্ঞানকে অবজ্ঞা করার সংস্কৃতি দূর করতে আমরা সবাই মিলে কাজ করতে পারব।’
৩ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ৫৯তম আসর বসেছিল। ৫৩৮ ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে ট্রাম্পের রথ থেমে যায় ২৩২ ভোটে, বাইডেন পান ৩০৬টি; জয়ের জন্য দরকার ছিল ২৭০ ভোট। ট্রাম্পের চেয়ে বাইডেন ৭০ লাখের বেশি জনপ্রিয় ভোট পেয়েছেন। এটি আমেরিকার নির্বাচনী ইতিহাসে সর্বোচ্চ ব্যবধান।
বাইডেনের জয়ে রেকর্ড গড়েন তার রানিং মেট কমলা হ্যারিস। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই ডেমোক্র্যাট নেতা দেশটির ইতিহাসে প্রথম নারী, প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ এবং প্রথম এশীয়-আমেরিকান ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিচ্ছেন। কমলার সঙ্গে শেকড়ের মিল থাকা, ম্যাপিং দ্য হেভেনস (স্বর্গের মানচিত্র) গ্রন্থের লেখক নটরাজন আমাদের সময়কে বলেছেন, ‘আমি খুব গর্বিত। সব সময়ই মনে হতো, (যুক্তরাষ্ট্রে) প্রথম যে নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট কিংবা প্রেসিডেন্ট হবেন, তিনি হবেন রক্ষণশীল দলের কোনো নেতা। অত্যন্ত আনন্দিত যে, সেই আশঙ্কা সত্যি হলো না।’
কিন্তু সত্যি কি সব আশঙ্কা উবে গেছে আমেরিকার আকাশ থেকে? মনে হয় না। ট্রাম্প যুগের অবসান বিষয়ে লিখতে গিয়ে ‘ছায়া হয়ে তবু নাশে রইব’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ লেখক যেমনটি বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে এবং সার্বিকভাবে মার্কিন সমাজে, বিদ্বেষ-বিভাজনের যে সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছেন তিনি, সহসা সে দাগ মুছে যাওয়ার নয়। দৃশ্যমান না থাকলেও দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যাবেন না ডোনাল্ড ট্রাম্প।’
বাইডেন বলেছেন, ‘বিদ্বেষের বদলে ভালোবাসা, বিভাজনের বদলে ঐক্য এবং কল্পনার বদলে বিজ্ঞান- এ বোধ হোক আমাদের এগোনোর পথ।’ কিন্তু রাজনীতি বিশ্লেষক রিক গ্ল্যাডস্টোন মনে করেন, ৭৮ বছর বয়সী এ নেতার সামনে বহু কঠিন পরীক্ষা। সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হলোÑ যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার। চার দশকের মধ্যে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক সবচেয়ে খারাপ হয়েছে। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ইউরোপীয় মিত্ররাও। ইরান পারমাণবিক জ্বালানি সমৃদ্ধকরণ আবার শুরু করেছে, এবং পারমাণবিক অস্ত্রাগার নিয়ে উত্তর কোরিয়ার আস্ফালন আরও বেড়েছে। আছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও শরণার্থী সংকট। এবং সর্বোপরিÑ করোনা মহামারী।
এক রকম ভুল সময়ে নৌকার হাল ধরতে হচ্ছে বাইডেনকে। ভুল বলা ঠিক হলো না। কারণ উল্টো স্রোতে বা প্রতিকূলে যে মাঝি নৌকা চালিয়ে কূল রক্ষা করতে পারেন, তিনিই তো আসল মাঝি। বাইডেনকে এখন সেই পরীক্ষা দিতে হবে।
বাইডেন নিজেও সে কথা জানেন। এ জন্য জয়ের পর পরই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছিলেনÑ ‘সামনে আমাদের কঠিন পথ, কিন্তু আমি অঙ্গীকার করছি : আমি আমেরিকার সব মানুষের প্রেসিডেন্ট হবÑ কে আমাকে ভোট দিয়েছে আর কে দেয়নি, সে বড়ো কথা নয়। আপনারা আমার ওপর যে আস্থা রেখেছেন, আমি সেই ভরসার প্রতিদান দেব।’
আমেরিকা প্রভাতের দেখা পাক। এবারের শপথ অনুষ্ঠান মার্কিন প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ওয়াশিংটন ডিসিতে। এ অনুষ্ঠানের একমাত্র বাধ্যবাধকতা হলো, প্রেসিডেন্ট-নির্বাচিত যিনি, তিনি প্রেসিডেনশিয়াল শপথ পাঠ করবেন। শপথে বলা হয়, ‘আমি শপথ করছি যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমি বিশ্বস্ততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করব। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানকে সুরক্ষা, সংরক্ষণ ও মর্যাদা ধরে রাখার জন্য আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাব।’ জো বাইডেন এই শপথ পাঠ করার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব শুরু করবেন।
বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ সময় আজ বুধবার রাত সাড়ে দশটার দিকে শপথ অনুষ্ঠান শুরু হবে। ট্রাম্পের উগ্র সমর্থকদের হামলার আশঙ্কায় এবার শপথ অনুষ্ঠানেও বাড়তি সতর্কতা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে শপথ অনুষ্ঠানে অংশীজনেরা (প্রায় ২০০ জন) উপস্থিত থাকবেন। প্রথা ভেঙে এবার শপথ অনুষ্ঠানে থাকছেন না বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
এ ছাড়া সাধারণ জনতা প্রেসিডেন্টের শপথ দেখতে সরাসরি উপস্থিত হন। বারাক ওবামার বেলায় উপচে পড়া ভিড় দেখা গিয়েছিল। কিন্তু এবার বাইডেনের দল জনতাকে অনুরোধ করেছে, তারা যেন ক্যাপিটল অভিমুখে ভিড় না জমায়। বাইডেন বরাবরই মাস্ক পরার ব্যাপারে জোর দিয়েছেন। কিন্তু গত জুনে তিনি জানিয়েছিলেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তিনি মাস্ক না পরে শপথ নেবেন। এ ব্যাপারে সর্বশেষ অন্য কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।