দল গঠিত সুবর্ণজয়ন্তীর জাতীয় কমিটি থেকে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির দুই নেতা, আরেকজন অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা ও একজন যুগ্ম মহাসচিব নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন। তাদের মধ্যে স্থায়ী কমিটির এক নেতা পদত্যাগ করেছেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। এক নেতা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যাননি, আর কয়েকজন গিয়েও সম্মান পাননি। তবে নিজেদের গুটিয়ে রাখার সবচেয়ে বড় কারণ- খালেদা জিয়াকে যথাযথ মর্যাদা না দেওয়া। এ বিষয়টি দলের ভেতরে যে বিস্ফোরণ তৈরি হয়েছে তার তীব্রতা বাড়ছেই।
দলের নীতিনির্ধারকরা জানিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় খালেদা জিয়া পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি ছিলেন; তাই তিনিও একজন মুক্তিযোদ্ধা বলে মনে করে বিএনপি নীতিনির্ধারকরা। কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানের ব্যানারে তার ছবিই ছিল না, যা অনেকের মাঝে ক্ষোভ তৈরি করেছে। কীভাবে এটা সম্ভব তা ভেবেই আশ্চর্য হয়েছেন অনেকে।
অনেকে মনে করেন, বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নাম রাখা যাবে না বলেই তাকে খুশি রাখতে বেগম জিয়ার নামটিও বাদ দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে বিএনপি ও তার সমমনা দলের মধ্যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হলেও তারেক রহমানের অনুসারীরা বিষয়টিকে স্বাভাবিক বলেই মনে করছেন।
ব্যানারে ছবি না থাকার বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয়সহ তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড় করে চলছে। অনুষ্ঠানের পর ক্ষোভ প্রকাশ করে বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘বদলে যাওয়া এ এক অন্য রকম বিএনপি। সব আছে, সবাই আছে, শুধু নেই বেগম খালেদা জিয়ার ছবি ও নামটি। এই ঘোর দুষ্কালেও অনেকেই ছিলেন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন অনুষ্ঠানমালার শুভ উদ্বোধন উপলক্ষে লেকশোর হোটেলে আয়োজিত এই জাঁকালো অনুষ্ঠানে। তবে বিএনপির আমন্ত্রণ পেয়েও সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতারা এবং দাওয়াত না পাওয়ায় জামায়াত নেতারা ছিলেন অনুপস্থিত।’
জানা গেছে, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ব্যানারে দলের চেয়ারপারসনের নাম না থাকায় ক্ষুব্ধ হয়ে স্থায়ী কমিটির এক সদস্য সুবর্ণজয়ন্তীর কমিটি থেকে নিজের নাম সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এরই মধ্যে পদত্যাগপত্রও দিয়েছেন। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অনুষ্ঠানই বর্জন করেছেন। তাকে এখন পর্যন্ত কোনো অনুষ্ঠানে-ই দেখা যায়নি। জানতে চাইলে রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘আমি দলের অন্য সাংগঠনিক কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত।’
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, ম্যাডামের ছবি কেন সুবর্ণজয়ন্তীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ব্যানারে ছিল না তা আমরাও জানি না। আমরা যারা তৃণমূলের নেতাকর্মীদের নিয়ে রাজনীতি করি তারা অনেকেই জানতে চাচ্ছেন। কিন্তু তার কোনো জবাব দিতে পারছি না। তবে বিষয়টি জানার চেষ্টা করছি।
একাধিক নেতা জানান, দলের গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতাকেই সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। কোনো কোনো নেতা আমন্ত্রণপত্র পেয়েছেন অনুষ্ঠানের ঠিক আগে।
এক নেতা বলেন, তাকে এমনভাবে আমন্ত্রণপত্র দেওয়া হয়েছে যা রীতিমতো অসম্মান বোধ করেছেন। তাই অনুষ্ঠানেই যাননি। ওই নেতা বলেন, আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় তৃতীয় সারির একটি চেয়ারেও বসেছেন। গুরুত্বহীন আসনে ছিলেন স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য মির্জা আব্বাস। যদিও এ নিয়ে ওই দুই নেতার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্যের সঙ্গে যোগযোগ করলে তিনি বলেন, সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানের সব কর্মসূচিতেই দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের পাশে চেয়ারপারসন ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানেরও ছবি থাকার কথা ছিল। ব্যানারে কেন ছিল না আমাদের জানা নেই। এটা সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও সদস্য সচিব আবদুস সালাম বলতে পারবেন।
এ বিষয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব ও বিএনপি চেয়ারপাসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম গণমাধ্যমকে বলেছেন, জিয়াউর রহমান মানেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। বাংলাদেশ মানেই জিয়া। তাই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে শুধু জিয়াকে ফোকাস করতে চেয়েছি। এ কারণে দলীয় চেয়ারপারসনের ছবি ব্যবহার করা হয়নি। একই কারণে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ছবিও ব্যবহার করা হয়নি। তা ছাড়া এ কর্মসূচিকে আমরা সার্বজনীন করতে চেয়েছি, দলীয় নয়। এ কারণে জিয়ার ছবি ব্যবহার করেছি।
সালামের এ বক্তব্য প্রসঙ্গে বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, ওয়ান ইলেভেনে এরাই তো ষড়যন্ত্র করেছিল। তারা তো খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে মাইনাস করে জিয়াউর রহমানকে সামনে রেখেই এগোতে চেয়েছিলেন।
ওই নেতা আরও বলেন, সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন কমিটিতে এমন এক নেতা রয়েছেন ওয়ান-ইলেভেনে নিজে বিএনপির চেয়ারম্যান হতে চেয়েছিলেন। ওই নেতার নেতৃত্বে দল গঠনের লক্ষ্যে ৬০ নেতার নাম সংবলিত তালিকা তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদের কাছে পাঠিয়ে ছিলেন। যে চিঠি পরবর্তী সময়ে ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) হাতে কোনো মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি তো তাদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তার শঙ্কা সেই ফর্মুলা নতুন করে শুরু হয়েছে। যেহেতু তারেক রহমান বাইরে, ম্যাডামও চিকিৎসার জন্য বাইরে- এ অবস্থায় ফাঁকা মাঠে বিশেষ কারণ দেখিয়ে সেই প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে বলে ওই নেতার ধারণা। একজন যুগ্ম মহাসচিব বলেন, তার ধারণা ম্যাডাম চিকিৎসার জন্য বাইরে গেলে এ সুবর্ণজয়ন্তীর কোনো কোনো নেতা সক্রিয় হবেন ওয়ান-ইলেভেনের প্রক্রিয়ায়।
তবে জাতীয় কমিটির নেতারা জানান, বছরব্যাপী কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে লেকসোর হোটেলের প্রবেশমুখে খালেদা জিয়ার ছবি সংবলিত ফেস্টুন দেওয়া হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরুতে চেয়ারপারসনের জন্য দোয়া চাওয়া হয়। তার নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানানো হয়। অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়ার ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র তুলে ধরা হয়, যেখানে তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন, গণতন্ত্র ও দেশের জন্য তার আন্দোলন সংগ্রাম সুনিপুণভাবে তুলে ধরা হয়। অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে দলের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা সরণিকার উদ্বোধন করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া বিএনপির একজন যুগ্ম মহাসচিব বলেন, ব্যানারে ম্যাডামের ছবি থাকবে না এটা মেনে নেওয়া কঠিন।
এক নেতা বলেন, আমিও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। ব্যানারে দলীয় প্রধানের ছবি না দেখে অনেককেই বলতে শুনেছি, তা হলে কি বিএনপি খালেদা জিয়াকে ভুলেই গেছে। তার ছবি ব্যানারে যদি পরিকল্পিতভাবে বাদ দেওয়া হয়, সেটা এক জিনিস, আর যদি অপরিকল্পিতভাবে হয়ে থাকে তা হলে তা অমার্জনীয় অপরাধ। এর জন্য দলের স্থায়ী কমিটি জাতীয় কমিটির কাছে কৈফিয়ত তলব করতে পারেন। তিনি আরও বলেন, কারাগারে যাওয়ার পর ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) সম্মানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একটি চেয়ার খালি রাখা হতো। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্তত সে রকম করেও একটি চেয়ার খালি রাখা যেত।
তবে স্থায়ী কমিটির দুই সদস্যের কঠোর অবস্থান ও দলের নেতাকর্মীদের সমালোচনার মুখে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের বছরব্যাপী সব অনুষ্ঠানের ব্যানারে দলের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ছবি রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রতিটি অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের আমন্ত্রণ জানানোরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জাতীয় প্রেসক্লাবে দ্বিতীয় দিনের কর্মসূচি ‘স্বাধীনতা পতাকা উত্তোলন দিবসের’ আলোচনাসভার ব্যানারেও তিনজনের ছবি ব্যবহার করা হয়।