তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল দিন দিন বেড়েই চলছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগে। আধিপত্য বিস্তার, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে হার না মানার মনোভাব, ক্ষমতার দাপট, ভাগাভাগিসহ নানা ইস্যুতে অন্তর্কোন্দলে জড়িয়ে পড়ছে টানা একযুগ ক্ষমতায় থাকা এ দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে সংঘর্ষে জড়িয়ে নিহত ও মারাত্মক আহত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বসুরহাটে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহত হয়েছেন সাংবাদিক মোজাক্কির এবং গত মঙ্গলবার নিহত হন দলীয় কর্মী মো: আলাউদ্দিন। এসব ঘটনায় দেশজুড়ে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। বসুরহাটের ঘটনা দলটির হাইকমান্ডকে বেশ বিব্রতকর ও অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
যদিও বসুরহাটের সংঘর্ষের ঘটনার পর থেকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা অনেকটাই নিশ্চুপ রয়েছেন। শুধুমাত্র দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলছেন। সংঘর্ষের পর ওই এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত সেখানে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। এলাকাবাসীর মধ্যেও আতঙ্ক কাজ করছে। সংঘর্ষে জড়িতদের কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়াতে সেখানে অতিরিক্ত পুলিশও মোতায়েন রয়েছে। তবে কয়েক দিনের ব্যবধানে একজন সাংবাদিক এবং একজন দলীয় কর্মী নিহত হলেও দায়ীদের বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়নি দলটি। তবে দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলছে, বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জা হলেন ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই। একরামুল করিম চৌধুরীও নোয়াখালীর রাজনীতিতে অনেক প্রভাবশালী। দুইজনের সমর্থিত গ্রুপের মধ্যে এ ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় শীর্ষ নেতাদের কেউই এ বিষয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে চাইছেন না। নিজস্ব এলাকা হওয়ায় বিষয়টি দেখভাল করছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক নিজেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, এটা দলের সাধারণ সম্পাদকের এলাকা। এখানে অন্য নেতাদের হস্তক্ষেপ মানায় না। ওই নেতা বলেন, গত কয়েক মাস ধরে সেখানে দুই গ্রুপের মধ্যে বাকযুদ্ধ ও উত্তেজনা চলে আসছে। শুরু থেকেই যদি কেন্দ্র থেকে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হতো তাহলে প্রাণহানির মতো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়ানো যেত।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বসুরহাট পৌরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে একটি গ্রুপিং তৈরি হয়। তখন থেকে ওই এলাকায় নেতাকর্মীদের মধ্যে কয়েক দফা সংঘর্ষও হয়েছে। এর আগে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে সাংবাদিক মুজাক্কির নিহত হন। বসুরহাট পৌরসভার নির্বাচনকে সামনে রেখে মেয়র আবদুল কাদের মির্জা কয়েকজন প্রভাবশালী এমপি ও নেতার দুর্নীতি, টেন্ডারবাজিসহ নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ড তুলে ধরে বক্তব্য দেন। ওই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে তার সাথে নোয়াখালীর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় এমপি একরামুল করিম চৌধুরীর মধ্যকার দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য চলে আসে। বসুরহাটে মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে আবদুল কাদের র্মির্জা গ্রুপ এবং একরামুল করিম চৌধুরী সমর্থিত মিজানুর রহমান বাদলের গ্রুপ। নোয়াখালীর বসুরহাট ছাড়াও চট্টগ্রাম, মাদারীপুর, ঝিনাইদহ, পটুয়াখালী, বগুড়া ও মুন্সীগঞ্জসহ বেশকিছু জেলাতেই অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে বিরোধ প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। গত রোববার মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলায় ৭ মার্চ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ হয়।
এতে পাঁচজন আহত হন। এর আগে পাল্টাপাল্টি কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে রাজৈর আওয়ামী লীগে মূলত বিভাজন সৃষ্টি হয়। কয়েক দফায় হাতাহাতি ও সঙ্ঘাতের ঘটনা ঘটে। গত ৪ মার্চ ঝিনাইদহ জেলার শৈলকূপার সারুলিয়ায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ২৫টি বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়। গত ১৩ মার্চ বগুড়ার সোনাতলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন উপলক্ষে স্থানীয় দিগদাউড় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভাকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। সংঘর্ষের আশঙ্কায় স্থানীয় মহিচরণ দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে ১৪৪ ধারা জারি করে সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করে প্রশাসন। মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার মিরকাদিমে গত ৪ মার্চের সংঘর্ষের পর ৫ মার্চ প্রতিপক্ষের হামলায় ফিরোজ (৩৫) নামে স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক কর্মী নিহত হন। গত রোববার রাতে চট্টগ্রামের বায়েজিদ থানাধীন আরেফিন নগর মুক্তিযোদ্ধা কলোনি এলাকায় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ছাত্রলীগ কর্মী মোহাম্মদ ইমন নিহত হন।
গত ২১ ফেব্রুয়ারি পটুয়াখালীর বাউফলে পাবলিক মাঠ এলাকায় আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও নাজিরপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ইব্রাহিম ফারুকসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। কিছুদিন আগে ডিএসসিসির সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন ও বর্তমান মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের মধ্যকার অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগে বিরোধ প্রকাশ্য চলে আসে। ওই ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজনৈতিক অঙ্গন। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনা অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন দলটির সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, কোম্পানীগঞ্জের ঘটনায় যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। কাউকে ছাড় দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। যারাই জড়িত থাকুক, তাদের পরিচয় না দেখে আইনের আওতায় আনা হবে। ঘটনার বিচারের জন্য তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, রিপোর্ট এলে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে।
এ প্রসঙ্গে প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন নয়া দিগন্তকে বলেন, কোম্পানীগঞ্জে যে ঘটনা ঘটেছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক, বেদনায়ক ও দুর্ভাগ্যজনক। দলের কিছু কিছু ব্যক্তির এ ধরনের কর্মকাণ্ডের কারণে আমাদের সংগঠন মাঝে মাঝে বিব্রত ও অস্বস্তিতে পড়ে। আমি বিশ্বাস করি, দলের প্রধান এ বিষয়ে অবগত আছেন এবং সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখানে দুটো দিক আছে। প্রথমত এটা সাধারণ সম্পাদকের এলাকার সমস্যা। ঘটনাটির সাথে যিনি জড়িত তিনি আপন ভাই। এটা অত্যন্ত স্পর্শকাতর ব্যাপার।
দ্বিতীয়ত আবার যিনি সাধারণ সম্পাদকের ভাই তিনি হয়তো মনে করেন যত যাই কিছু করি না কেন কেউ আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। এটা আমার কাছে মনে হয়। তা না হলে তার এতটা বেপরোয়া হওয়ার কথা নয়। আবার সেই ভাইকে রক্ষা করার জন্য তিনি হয়তো যা যা করার সেটা করবেন এটাও স্বাভাবিক। অ্যাডভোকেট হুমায়ুন বলেন, দলীয় প্রধান দলের কোনো বিশৃঙ্খলাকারীকে কখনোই ছাড় দেন না। শৃঙ্খলার ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত কঠোর। এ ঘটনা তিনি হয়তো পর্যবেক্ষণ করছেন। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলেও আমার মনে হয় না তিনি ছাড় দেবেন।