করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে গত বছর প্রায় ছয় মাস সাংগঠনিক কার্যক্রম বন্ধ রেখেছিল বিএনপি। এ বছর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় সক্রিয় হয় দলটি। সংগঠনকে শক্তিশালীকে করতে বিভিন্ন স্থানে কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু এরই মধ্যে আগের চেয়েও মারাত্মক আকার ধারণ করে ফিরেছে করোনা সংক্রমণ। ফলে আবারও সাংগঠনিক তৎপরতা বন্ধ রাখতে বাধ্য হয় বিএনপি।
দলটির বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী আক্রান্ত হচ্ছেন, মারাও গেছেন অনেকে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন অভিযোগে একের পর এক মামলা ও গ্রেপ্তার তো রয়েছেই। সামগ্রিক পরিস্থিতি চিন্তায় ফেলে দিয়েছে দলটির নীতিনির্ধারকদের।
বিএনপির নীতিনির্ধারকদের ধারণা ছিল, করোনার টিকা এসে যাওয়ায় সংক্রমণ পরিস্থিতি হয়তো দ্রুতই নিয়ন্ত্রণে আসবে। আর স্বাভাবিক পরিবেশে সাংগঠনিক কার্যক্রম করে দলকে শক্তিশালী করা হবে। সম্প্রতি সে লক্ষ্যে কাউন্সিলের মাধ্যমে মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির কমিটিও করা হয়। এভাবেই কাউন্সিলের মাধ্যমে প্রতিটি জেলা ও মহানগরের কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন করোনা সংক্রমণ গতবারের তুলনা আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। প্রতিনিয়ত আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা রেকর্ড গড়ছে। বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতা থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদেরও আক্রান্তের খবর পাওয়া যাচ্ছে। দলটির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, সেলিমা রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, আহমেদ আযম খান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, বিএনপি নেতা ডা. একেএম আজিজুল হক, ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, সেলিমুজ্জামান সেলিম, রকিবুল ইসলাম বকুল প্রমুখ। ড. মোশাররফের স্ত্রী বিলকিস আক্তার, ডা. জাহিদ হোসেনের স্ত্রী রিফাত হোসেন, সেলিমুজ্জামান সেলিমের স্ত্রী সাবরিনা শুভ্রা এবং হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের স্ত্রী কামরুন নাহার সৃষ্টি, তাদের দুই মেয়ে জান্নাতুন ইসি সূচনা ও অপরাজিতা খানও আক্রান্ত।
দলীয় সূত্র জানায়, গত এক বছরে করোনায় বিএনপির ৪৪০ জন নেতাকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে আছেন- ভাইস চেয়ারম্যান চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, মেজর জেনারেল (অব) রুহুল আলম চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এমএ হক, ঢাকা উত্তর মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আহসান উল্লাহ হাসান, কুমিল্লা বিভাগ সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল আউয়াল খান, বিএনপি নেতা মাওলানা কাসেমী, খন্দকার আহাদ আহমেদ, টিএম গিয়াস উদ্দিন, মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন প্রমুখ।
করোনা সংক্রমণের পাশাপাশি মামলা ও গ্রেপ্তার নিয়েও চিন্তায় আছে দলটি। দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা জানান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতায় হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিতে সহিংসতার ঘটনায় বিএনপি নেতাকর্মীদের নামেও মামলা হচ্ছে। অনেকেই গ্রেপ্তারও হয়েছেন। স্বাধীনতা দিবসে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বিএনপি ২৯ ও ৩০ মার্চ বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আগে তাদের ৩৫ লাখ নেতাকর্মীর নামে মামলা ছিল। নতুন করে আরও ২০ হাজার নেতাকর্মীর নামে মামলা দেওয়া হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগে নতুন নতুন মামলা, গ্রেপ্তারসহ সরকারের নির্যাতন-নিপীড়ন অব্যাহত রয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে করোনা থেকে কিছুটা রক্ষা পাওয়া গেলেও সরকারের নির্যাতন থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় নেই। এরপরও আমরা আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী নেতাকর্মী ও সাধারণ জনগণের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় সম্প্রতি সব সাংগঠনিক কর্মকা- স্থগিত করে বিএনপি। এর আগে গত মাসে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর কর্মসূচিও স্থগিত করা হয়। তবে সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত হলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে সক্রিয় হয়েছে বিএনপির ‘জাতীয় করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ সেল’। ফের তারা কাজ শুরু করেছে। এই সেল চিকিৎসা, টিকার কার্যক্রমসহ দলের ত্রাণ তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করবে। পাশাপাশি সরকারের কোনো তথ্যের গরমিল থাকলে তা তুলে ধরবে।
গত বছর এপ্রিলে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে উপদেষ্টা ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে আহ্বায়ক করে ১৩ সদস্যের এই সেল করা হয়। ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, করোনা পরিস্থিতি খুবই খারাপের দিকে যাচ্ছে। আমাদের পর্যবেক্ষণ সেলের কাজও আবার শুরু হয়েছে। সাংগঠনিক সম্পাদকদের বলা হয়েছে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য। দলের সামর্থ্য অনুযায়ী স্বাস্থবিধি মেনে নেতাকর্মীরা এবারও মানুষের পাশে দাঁড়াবে।
দলের কেন্দ্রীয় সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু বলেন, করোনাকালে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনায় গত বছর মার্চে করোনা শুরুর পর থেকে জুন পর্যন্ত সারাদেশে বিএনপির নেতৃবৃন্দ ৫৪ লাখ ১২ হাজার ৪১৬টি পরিবারকে সহযোগিতা করেছেন। এই সহযোগিতার আওতায় ২ কোটি ১৬ লাখ ৪৯ হাজার ৬৬৪ জন উপকৃত হয়েছে। এ ছাড়া ড্যাব, জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন ও দলের নেতৃবৃন্দ কয়েক লাখ মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সাবান ও পিপিই বিতরণ করেছেন। করোনা এখন ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। এ কারণে আবারও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবেন বিএনপি নেতাকর্মীরা।
করোনা সংক্রমণ শনাক্তের পর গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এই অবস্থা চলে টানা ৬৬ দিন। ওই সময়ও দলীয়ভাবে অসহায় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের আর্থিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে বিএনপি।