“খ্রিষ্টপূর্ব সমগ্র পাশ্চাত্যে প্রবল প্রতাপ নিয়ে রোম ছিল এক সমৃদ্ধ সভ্যতা।
কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস অনুসন্ধানকারীদের কাছে রোম এক অন্ধকার এলাকার নাম। বস্তুত রোমান সভ্যতা সীমাহীন শক্তি অর্জন করেছিল। সমরবিদ্যা ও এর প্রয়োগ সাধনে লাভ করেছিল প্রকৃত উন্নতি। উপরন্তু গ্রিকদের বিপুল জ্ঞানের উত্তরাধিকার তারা পেয়েছিল সরাসরি, অতি সহজে।
কিন্তু এর পরও রোমান সভ্যতা হাজার বছরের আয়ুষ্কালে একজনও
বৈজ্ঞানিকের জন্ম দিতে পারেনি”
গ্রিক দর্শন ও গণিত নিয়ে পাশ্চাত্যের কত গর্ব! কিন্তু ‘গ্রিকদের জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিতশাস্ত্র ছিল বিদেশ থেকে আমদানি করা। এগুলো আবার গ্রিক সংস্কৃতির সাথে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারেনি। গ্রিকরা পদ্ধতিকরণ, কতগুলো দৃষ্টান্ত থেকে সাধারণ শ্রেণিবদ্ধকরণ এবং হির্ডারি গঠনে নিপুণ ছিল। কিন্তু ধৈর্যসহকারে অনুসন্ধান করা, নিশ্চিত জ্ঞান আহরণ করা, দীর্ঘকাল ধরে বিস্তারিতভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং পরীক্ষণ-নিরীক্ষণ পদ্ধতি অনুসরণ সর্বতোভাবে গ্রিক মেজাজের পরিপন্থী ছিল। পুরনোকালে বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম সীমাবদ্ধ ছিল হেলেনীয় আলেকজান্দ্রিয়াতে। আমরা যাকে বিজ্ঞান বলে আখ্যায়িত করি, তা জিজ্ঞাসু মন, নতুন অনুসন্ধান পদ্ধতি, পরীক্ষণ, নিরীক্ষণ পদ্ধতি এবং গণিত শাস্ত্রের অগ্রগতির ফলে ইউরোপেই বিকাশ লাভ করে। সেই মন ও পদ্ধতি ইউরোপকে সরবরাহ করেছিল আরবরা। রবার্ট ব্রিফল্টের এ বক্তব্য কেবল তারই নয়, ঐতিহাসিক অসংখ্য সূত্রে সমর্থিত। গুস্তাব লি বো তার বিখ্যাত ‘লা সিভিলাইজেশন ডেস অ্যারাবস’ গ্রন্থে স্পষ্ট স্বীকার করেন, ইউরোপে বিজ্ঞান জীবন পেয়েছে আরবিবাহিত মুসলিম শিক্ষার প্রভাবেই। আরবরাই ফেরি করেছে বিজ্ঞানচেতনা।
আরবদের এ বিজ্ঞান চেতনার উৎস কি? অনেকেই এর উৎস খোঁজেন প্রাচীন জাতিগুলোর বিবিধ বিজ্ঞানে। এ আসলে ভুল। মুসলিমদের বিজ্ঞানচেতনার উৎস ইসলামেই নিহিত। ঐতিহাসিক রোম ল্যান্ডের বয়ান শুনুন, ইসলামে বিজ্ঞানচেতনার গোড়ায় আছে আল্লাহর সৃষ্ট জগতকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার বাসনা, বস্তু জগতকে আত্মিক জগতের মতোই গুরুত্বদান, আরব মনের বাস্তবতাবাদ এবং অদম্য কৌতূহল। ইসলামের ধর্ম এবং বিজ্ঞান আলাদা পথ ধরে অগ্রসর হয়নি। বস্তুত প্রথমটা দ্বিতীয়টাকে উৎসাহ জুগিয়েছে।
রোম ল্যান্ড জানান, এটা অনস্বীকার্য যে মুসলিমগণ পাশ্চাত্যের মতো বিজ্ঞানকে ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হতে দেয়নি। বস্তুত ইসলামই বিশ্বকে নিয়ে গবেষণার উৎসাহ জুগিয়েছে। খ্রিষ্টান জগতের মতো বিজ্ঞান ও ধর্মের সঙ্ঘাত এখানে ছিল না। ধর্মীয় আবেগ নিয়েই বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালানো হতো। এর লক্ষ্য ছিল বুদ্ধিবৃত্তিকদের ইসলামের আস্তিকতা এবং গৌরব প্রতিষ্ঠা। ইসলামী বিজ্ঞান তাই কখনো অমানবিক হয়নি, যেমনটা হয়েছে পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান।
ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের অনেকেই একেবারে অন্যায়ভাবে মুসলমানদের জ্ঞান-বিজ্ঞানে গ্রিকদের শাগরেদ হিসেবে অভিহিত করেন। তারা মুসলমানদের বিজ্ঞানচেতনার গুরু হিসেবে গ্রিকদের কৃতিত্ব দেন। বেরন কারা ডি ভাক্স বিখ্যাত ‘দি লিগ্যাসি অব ইসলাম’ গ্রন্থে মুসলমানদের অবদানের কথা স্বীকার করলেও তাদের প্রাচীন গ্রিকদের অনুকারীর অধিক মর্যাদা দেননি। বার্ট্রান্ড রাসেল ‘দ্যা হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলোসফিতে আরবদের বলেছেন, গ্রিক বিজ্ঞানের নিছক বাহক, অনুবাদক। অনুবাদের মাধ্যমে তারা কেবল গ্রিক বিজ্ঞানকে ইউরোপ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন। কিন্তু বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও ঐতিহাসিক সমীক্ষায় এ তথ্য ভুল প্রমাণিত।
বার্ট্রান্ড রাসেল নিজেই আবার কবুল করেছেন, আরবদের সময় পর্যন্ত বিজ্ঞান দুই ধারায় বিকাশমান ছিল- ১. আমাদেরকে এর যোগ্য করে তোলা যে আমরা বস্তুকে জানব। ২. আমাদের বস্তুনিচয় ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা। আর্কিমিডিসের একমাত্র ব্যতিক্রম ছাড়া গ্রিকদের আকর্ষণ ছিল কেবল প্রথম ধারার প্রতি।
বস্তুত এ এক সিদ্ধ সত্য যে, প্রাচীন গ্রিসের যা কিছু কীর্তি-উন্নতি-উৎকর্ষ, তার সবই দর্শন ও শিল্পকলার এলাকাতেই সীমাবদ্ধ। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তার অবদান এতই অপ্রতুল যে, আর্কিমিডিসের খ্রিষ্টপূর্ব ২২২ অব্দে, শহরতলির বালুকাবেলায় কোনো জটিল জ্যামিতিক সমস্যায় মগ্ন অবস্থায় এক রোমান সৈন্য যাকে হত্যা করেছিল- একমাত্র ব্যতিক্রম ছাড়া গ্রিস আর কোনো বৈজ্ঞানিক সন্তান প্রসব করতে পারেনি।
খ্রিষ্টপূর্ব সমগ্র পাশ্চাত্যে প্রবল প্রতাপ নিয়ে রোম ছিল এক সমৃদ্ধ সভ্যতা। কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস অনুসন্ধানকারীদের কাছে রোম এক অন্ধকার এলাকার নাম। বস্তুত রোমান সভ্যতা সীমাহীন শক্তি অর্জন করেছিল। সমরবিদ্যা ও এর প্রয়োগ সাধনে লাভ করেছিল প্রকৃত উন্নতি। উপরন্তু গ্রিকদের বিপুল জ্ঞানের উত্তরাধিকার তারা পেয়েছিল সরাসরি, অতি সহজে। কিন্তু এর পরও রোমান সভ্যতা হাজার বছরের আয়ুষ্কালে একজনও বৈজ্ঞানিকের জন্ম দিতে পারেনি।
ব্রিফল্ট স্পষ্ট করেন, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এবং চেতনায় ইউরোপে আমরা যাকে বিজ্ঞান বলে জানি, বিজ্ঞানে অনুসন্ধানের সেই নবচেতনা, নতুন পরীক্ষা পদ্ধতি, পর্যবেক্ষণ এবং অঙ্কশাস্ত্রের উন্নয়ন, পরিমাপ পদ্ধতি প্রভৃতি গ্রিকদের কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিল। ইউরোপে এই নবচেতনা ও পদ্ধতি আরবরাই প্রবর্তন করে।
আর্নল্ড জে টয়েনবি খোলাসা করেন, আরবীয় দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকদের মাধ্যমেই গ্রিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমৃদ্ধ সম্পদ আধুনিক যুক্তিবাদের জনকদের এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার পথিকৃৎ রজার বেকনের হাতে পৌঁছেছিল। ইউরোপীয় বৈজ্ঞানিক জাগরণের গুরু রজার বেকন, ফ্রান্সিস বেকন আরবীয় বৈজ্ঞানিকদেরই শিষ্য ছিলেন। আলেকজান্ডার ভন হামবোল্টের মতে, আরবীয়রা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সত্যিকার জনক হিসেবে আখ্যায়িত হবেন। বর্তমানে যে সত্য আমরা স্বীকার করে নিতে অভ্যস্ত।
গুস্তাব লি ভো আরো অগ্রসর হয়ে লিখেন, আজকের জগতকে রূপান্তরিত করেছে সেই মুসলিম গবেষণা পদ্ধতি, যা ইউরোপে অনুপ্রবেশ করেছে। মুসলিমরা অনুসন্ধানের নতুন নতুন ক্ষেত্র খুলেছে। তারা ধৈর্য, সাহস, মুক্তমন এবং বাস্তবমুখী প্রজ্ঞা নিয়ে সামনে অগ্রসর হয়েছে।
শ্রদ্ধাভাজন কর্তৃত্বের চাপ, যেমন টলেমির, তাদেরকে কদাচিৎ ভীত করেছে। তারা সব সময় একটি থিউরি নিয়ে পরীক্ষা চালাতে আগ্রহী ছিল। পরীক্ষণ-নিরীক্ষণ কাজে তারা কোনো দিন ক্লান্ত হয়নি। তারা তাদের ধর্মীয় চেতনা দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল। কিন্তু কোনো গোঁড়ামি তাদের বৈজ্ঞানিক গবেষণার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
কলাবিজ্ঞানের কর্ষণে মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রত্যেক শহর অন্য শহরকে অতিক্রম করার চেষ্টা করত। প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও প্রধানরা সুলতানের পদাঙ্ক বাণী শ্রবণের জন্য কর্ডোভা, বাগদাদ ও কায়রোতে ভিড় জমাত। এমনকি খ্রিষ্টানরা ইউরোপে সুদূর প্রত্যন্ত সীমা থেকে মুসলমানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বিদ্যালাভের জন্য আসতেন।
এভাবে ইসলামী সভ্যতার আলো সিসিলি, স্পেন হয়ে ক্রমে ছড়িয়ে পড়েছিল ইউরোপজুড়ে। ধীরে ধীরে আলোকিত হয়ে উঠল অন্ধকার ইউরোপ। পশ্চিম ইউরোপের জ্ঞানপিপাসু ও বিদ্যানুরাগীরা এই সময়ে স্পেনের বিদ্যালয়গুলোতে এসে সমবেত হতে লাগল। স্পেনের মুসলমানদের প্রতিবেশী হিসেবে মুজারাবরা ইউরোপে আরব স্পেন-বিজ্ঞানের হস্তান্তর ও প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অন্যদের তুলনায় তারা অধিকতর প্রভাবিত হয়েছিল। অগ্রসর খ্রিষ্টান তরুণরা তাদের নিজেদের ভাষার চেয়ে আরবি ভাষায় অধিকতর দক্ষতা ও শুদ্ধতার সাথে মতামত প্রকাশ করতে পারত।
গোঁড়া খ্রিষ্টবাদ মুসলিম বিজ্ঞানের প্রতি ইউরাপীয়দের আগ্রহের প্রতিবাদ করে। কারণ এ আগ্রহের মাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলছিল। হাজার হাজার তরুণ মুসলিমকে শিষ্যত্ব অর্জনের জন্য মুসলিম বিশ্বের বড় বড় নগরীর জামেয়াগুলোয় ভিড় করছিল।
কর্ডোভার আলভারো (Alvaro) মুসলিম বিদ্যাচর্চার প্রতি তাদের আগ্রহের জন্য তাদের বিরুদ্ধে তিক্তভাবে অভিযোগ উত্থাপন করেন। Haisterbach এর cassar খ্রিষ্টান তরুণদের সম্পর্কে বলেন যে, তারা জ্যোতিষতত্ত্ব সম্পর্কে অধ্যয়নের জন্য টলেডোতে গিয়েছিলেন। সেন্ট ভিক্টর (st. victor) এর nM (Huge) মুসলিম দর্শনের প্রতি অধিক আগ্রহের জন্য সেভিলের বিশপকে ভর্ৎসনা করেন। (এস এম ইমামুদ্দীন- কালচারাল হিস্ট্রি অব মুসলিম স্পেন- পৃ. ১৮৭) আরব বিজ্ঞান ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ ও আরবি- ল্যাটিন শিক্ষা বিস্তারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠিত হয়। টলেডো ও সেভিলের আরবি-ল্যাটিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আরব বিজ্ঞান ইউরোপে বিস্তার করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্যালেন্সিয়া (Palencia) সামাঙ্কা (slamanca) এবং লেরিডা (lerida) বিশ্ববিদ্যালয় যথাক্রমে ১২১৪ সালে অষ্টম আলফন্সো, ১২১৫ সালের অষ্টম আলফন্সো এবং ১৩০০ সালে নবম জায়েমী প্রতিষ্ঠা করেন। ১২৫৪ সালে সেভিলে আরবি ল্যাটিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন দশম আলফন্সো। টলেডোতেও প্রতিষ্ঠিত হয় অনুরূপ ইউনিভার্সিটি। যাতে ছিল সমৃদ্ধ এক অনুবাদকেন্দ্র। আরবি পণ্ডিতদের বিজ্ঞানকে ইউরোপে সম্প্রচারের ক্ষেত্রে টলেডো পালন করে মূল ভূমিকা।
এতে আরবিভাষী বহু মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিষ্টান পণ্ডিত নিয়োজিত ছিলেন। ১৫৫৪ সালে দশম আলফন্সো মুহাম্মদ আল রিকোতির মাধ্যমে মার্সিয়া ও সেভিলে প্রতিষ্ঠা করেন আরবি-ল্যাটিন বিশ্ববিদ্যালয়। এতে মুসলিম বিজ্ঞান, দর্শন ও সাহিত্য পড়ানো হতো। দশম শতকে ইউরোপ আরব মেধার ছায়া গ্রহণ শুরু করে। ইউরোপে তখন মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রধান প্রচারক সিলভেস্টার এর পোপ গার্বেট (মৃ. ১০০৩ খ্রি.) তিনি আরব জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, দর্শন ইত্যাদিতে পারদর্শী হন স্পেনের মাদরাসায়। ইউরোপে রোমক সংখ্যা নির্দেশক জটিল চিহ্নের পরিবর্তে আরবি সংখ্যা নির্দেশক চিহ্ন প্রবর্তন করেন তিনি। একাদশ শতকে কনস্টান্টিনাস আফ্রিকানাস ইউরোপে ছড়াতে থাকেন মুসলিম বিজ্ঞান। মুসলিম বিশ্বে তিনি ৩০ বছর ভ্রমণ করে সংগ্রহ করেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাঠ ও গ্রন্থাবলি। ইউরোপে ফিরে স্যালেরনোতে মুসলিমদের অনুকরণে তৈরি করেন চিকিৎসা কলেজ আর ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করতে থাকেন আরবি থেকে অনুবাদের একটি প্রতিষ্ঠান। ১১৩৫ থেকে ১২৮৪ সাল অবধি এখান থেকে জন্ম নেন অসংখ্য অনুবাদক ও প্রচারক। যাদের প্রধান কাজ ছিল আরবীয় বিজ্ঞানকে ইউরোপীয় বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এর শিক্ষাদান।
বিভিন্ন কারণে এই সময় অনেক মুসলমানও ইউরোপ গমন করেছিলেন। সভ্যতা-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানরা অনেক অগ্রসর- ইউরোপ এটা বুঝল এই যোগাযোগের ফলে। তারপর যখন জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রগামিতা ও চিত্তের মুক্তির প্রয়োজন উপলব্ধি করতে পারল, ল্যাটিন ভাষায় মুসলিম গ্রন্থসম্ভার অনুবাদ করে মুসলমানদের সাথে সংযোগকে তারা আরো প্রগাঢ়, পরিণতিমুখী করে তুলল। এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকার নিবন্ধকার লিখেছেন, এই সময় মুসলমানদের কাছে লক্ষাধিক গ্রন্থসমৃদ্ধ বহু পাঠাগার ছিল।
অনুবাদের মাধ্যমে এগুলো ইউরোপের হাতে চলে যেতে লাগল। বিশপ রেমন্ডের ধারাবাহিকতায় বাথ এর এডেলার্ড, ক্রিমোনার জেরার্ড, সেভিলের জোহন, ভমিনিকো গঞ্জালেস, ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের মাইকেল স্কট, চেস্টারের রবার্ট, তিভোলি এর ইটালীয় প্লেটো, মাইকেল স্কোটাস, হারমানাস টিউলোনিকাস প্রমুখের হাত দিয়ে ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ, আল বেরুনী, জাহরাভি, খাওয়ারিজমীদের গ্রন্থাবলি ইউরোপে ভাষান্তরিত হয়। এগুলো ছড়িয়ে পড়ে ইতালি, জার্মানি, মধ্য ইউরোপ ও ব্রিটেনে। মিরাবিলিস নির্দেশ দেন খ্রিষ্টান স্কুলগুলো ছেড়ে শিক্ষার্থীরা যেন আরবি বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। এর ফলাফল হয় সুদূরপ্রসারী। ইউরোপে তৈরি হয় জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ একটি প্রজন্ম যাদের মধ্যে শুধু ফ্রান্সিস বেকন ও রজার বেকন ছিলেন না, ছিলেন সেকালের আলোকময় অধিকাংশ প্রতিভা। তাদের অনুবাদ, রচনা ও আন্দোলন বুদ্ধিবৃত্তিক ও বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের তরঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। ইউরোপে রেনেসাঁ সংগঠনের পিছনে এগুলোই ছিল সক্রিয় বারুদ। গুস্তাব লি বো, রবার্ট ব্রিফল্ট, ডি এইচ রবার্টস, মন্টোগোমারি উ-এর মতো সত্যসন্ধ গবেষক এখন স্পষ্টভাবে কবুল করেছেন যে, আরবদের গবেষণা ও আবিষ্কারের বদৌলতেই বিজ্ঞানময় আধুনিক যুগের সূচনা ইউরোপ করতে পেরেছিল।
লেখক : কবি, গবেষক