শনিবার বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অনির্ধারিত কয়েকটি বিষয়ে কিছুটা উত্তাপ ছড়িয়েছে। অনেক দিন ধরে স্থায়ী কমিটির সভায় ফলপ্রসূ তেমন কোনো আলোচনা না হলেও গত সভায় গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় উঠে আসে। সভার এক পর্যায়ে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীর আলোচনাসভাকে কেন্দ্র করে কয়েকটি বিষয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। দলের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল বৈঠকে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীর কর্মসূচি নির্ধারণ নিয়ে আলোচনায় উঠে আসে সাম্প্রতিক নানা ঘটনা, দল হিসেবে বিএনপির সঠিক দায়িত্ব পালন না করার বিষয়টিও।
সভার এক পর্যায়ে কর্মসূচি নির্ধারণ করতে গিয়ে জিয়াউর রহমানের নিহত হওয়ার দিনকে এক প্রভাবশালী সদস্য মৃত্যুবার্ষিকী বলে উল্লেখ করায় উত্তেজনা তৈরি হয়, যা প্রায় বৈঠকজুড়েই চলে। দলের এক ভাইস চেয়ারম্যান ও যুগ্ম মহাসচিবের কাছে বিষয়টি জেনে স্থায়ী কমিটির একাধিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাদের কেউ বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে স্থায়ী কমিটির সদস্যরা দলের অন্য যেসব নেতার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন; তাদের কাছ থেকে বিষয়টির বিস্তারিত জানা গেছে। এর আগে একাদশ জাতীয় সংসদ
নির্বাচনে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ছাড়া নির্বাচনে অংশ নেওয়া না-নেওয়াকে কেন্দ্র করে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে উত্তাপ ছড়িয়েছিল। ওই সময় খালেদা জিয়াবিহীন নির্বাচনে যাওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান (দল থেকে পদত্যাগ করেছেন) ও গয়েশ্বরচন্দ্র রায়সহ কয়েকজন।
জানা গেছে, স্থায়ী কমিটির বৈঠকের আগে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে বিএনপির উদ্যোগে ভার্চুয়াল আলোচনার আয়োজন করা হয়। ওই কর্মসূচিতে দলের স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী তিন সদস্যকে প্রথমে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। বিষয়টি জানাজানি হলে এ নিয়ে দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। অনুষ্ঠান শুরুর মুহূর্তে ওই তিন নেতাকে আলোচনাসভায় আমন্ত্রণ জানানো হয়।
গত এপ্রিল মাসে সরকার লকডাউন ঘোষণা করলে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিতে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত করে। কিন্তু সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম গ্রেপ্তার হলে জাতীয় প্রেসক্লাবে সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম, নারীনেত্রী নিপুণ রায়চৌধুরী ও সাংবাদিক নেতা রুহুল আমিন গাজীসহ কারাবন্দি নেতাকর্মীর মুক্তির দাবিতে মহিলা দলের উদ্যোগে কর্মসূচি পালন করে।
এই কর্মসূচির প্রসঙ্গ টেনে গত শনিবার স্থায়ী কমিটি বৈঠকে আলোচনা হয়েছে বলে একজন ভাইস চেয়ারম্যান জানিয়েছেন। ওই নেতা বলেন, স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এক নেতা বলেছেন, লকডাউনে ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ সারাদেশে নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার অব্যাহত রয়েছে। রোজিনা ইসলামের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে আমরা সভা করছি, ভালো কথা। আমাদের তো দলীয় নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতেও কর্মসূচি করা উচিত। এ সময় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অনেক নেতা তাকে ফোন দিয়েও কর্মসূচির কথা বলেছিলেন। এক পর্যায়ে দায়িত্বশীল এক সদস্য বলেন, আমরা তো বিবৃতি দিচ্ছি। করোনার কারণে আমাদের তো সাংগঠনিক কর্মসূচি স্থগিত। এ পর্যায়ে এক নেতা বলেন, কমিটি গঠন প্রক্রিয়া স্থগিত আছে। রাজনৈতিক কর্মসূচি তো স্থগিত নয়। নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারে শুধু বিবৃতি দিয়ে দায়িত্ব পালন শেষ হয়ে যায় না। আমরা সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের মুক্তির দাবিতে যদি প্রেসক্লাবে কর্মসূচি করতে পারি তা হলে নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে পারব না কেন?
প্রভাবশালী ওই নেতা বলেন, ভার্চুয়াল কর্মসূচি করে কোনো লাভ হয় না। জবাবে অপর নেতা বলেন, তা হলে বিভিন্ন দিবসে ভার্র্চুয়াল কর্মসূচি করা হয় কেন? আপনারাই তো বলেন, ভার্চুয়াল কর্মসূচিতে ‘ভিউ’ বেশি হয়। এ সময় দলের এক সিনিয়র সদস্যও নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে কর্মসূচির পক্ষে কথা বলেন।
১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে চট্টগ্রামে নির্মমভাবে নিহত হন। তারপর থেকে জিয়াউর রহমানের নামের আগে ‘শহীদ’ এবং নিহত তারিখে ‘শাহাদাত’বার্ষিকী পালন করে আসছে। কিন্তু গত শনিবার স্থায়ী কমিটির সভায় দলের গুরুত্বপূর্র্ণ এক নেতা ৩০ মে উপলক্ষে কর্মসূচি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মৃত্যুবার্ষিকী বলেন। দলের স্থায়ী কমিটির অন্য এক নেতা তাৎক্ষণিক এর প্রতিবাদ করেন। দলের আরেক সিনিয়র নেতা প্রতিবাদকারী নেতাকে সমর্থন দিয়ে বলেন, আমরা তো জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী পালন করি, মৃত্যুবার্র্ষিকী নয়। এর পর ওই নেতা শাহাদাতবার্ষিকী বলতে বাধ্য হন। এখান থেকেই শুরু হয় স্থায়ী কমিটিতে উত্তেজনা।
অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, জিয়াউর রহমানের নিহতের দিনটিকে পালন করতে প্রথমে দুই দিনের কর্মসূচি দেওয়ার চিন্তা করেন দুই-এক নেতা। স্থায়ী কমিটিতে সেই অনুযায়ী প্রস্তাবও দেওয়া হয়। এ বিষয়টি নিয়ে কিছুটা বাদানুবাদ হয়েছে সভায়।
বৈঠকে এক নেতা বলেন, ‘রণাঙ্গনের বীরর মুক্তিযোদ্ধা বীরউত্তম জিয়াউর রহমানের এবার ৪০তম শাহাদাতবার্ষিকী। তাই চল্লিশ দিনের কর্মসূচি নেওয়া উচিত।’ এ সময় এক নেতা বলেন, এতদিন কর্মসূচি কীভাবে করা সম্ভব? তখন প্রস্তাবকারী নেতা বলেন, আওয়ামী লীগ যদি শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য বছরব্যাপী কর্মসূচি করতে পারে আমরা কেন পারব না? এ সময় এক নেতা প্রস্তাব দিয়ে বলেন, ১৯৭৮ সালের ৩ জুন সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিয়াউর রহমান জয়লাভ করেন। দলের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর কমিটির উদ্যোগে এই কর্মসূচি করা যেতে পারে। পরে এই প্রস্তাব গৃহীত হয়। এর দায়িত্ব দেওয়া হয় দলের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ড. মোশাররফ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘১৯৭৮ সালের ৩ জুন প্রথমবারের মতো সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন জিয়াউর রহমান। এর আগে সিস্টেমটা ছিল পার্লামেন্ট থেকে নির্বাচন। এ বিষয়টি সামনে এনে কর্মসূচি দেওয়ার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।’
দলের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা যায়, জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে খালেদা জিয়া তিনদিনব্যাপী ঢাকা শহরে দুস্থদের মাঝে খাবার বিতরণ করতেন। এবার সিনিয়র নেতাদের উপস্থিতিতে এ কর্মসূচি করা যেতে পারে। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ প্রস্তাব দেওয়া হয়। দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা প্রস্তাবের জবাবে বলেন, এত নেতা কোথায় পাবেন? তখন প্রস্তাবকারী নেতা বলেন, স্থায়ী কমিটির বাইরে দলের ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম মহাসচিব, উপদেষ্টা এরা নেতা নন? সবাইকে কাজে লাগাতে হবে। ঢাকা মহানগরের উত্তর ও দক্ষিণ কমিটির সঙ্গে বসে স্পট ঠিক করার প্রস্তাব দিলে তা গৃহীত হয়। রবিবার গুলশান কার্যালয়ে ঢাকা মহানগর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্পট ও নেতাদের নাম চূড়ান্ত করেন।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সভাপতি হাবিব-উন নবী খান সোহেল বলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে অনেকেই কর্মসূচি পালন করতে চায়। কিন্তু করোনার কারণে আমরা ১৫টি স্পটে দুস্থদের মাঝে খাবার ও বস্ত্র বিতরণ করব।
উত্তরের কত স্পটে এই কর্মসূচি হবে, সে ব্যাপারে আজকালের মধ্যে চূড়ান্ত হবে বলে উত্তর বিএনপির দপ্তর জানিয়েছে।
এদিকে একটি সূত্র জানিয়েছে, বিভিন্ন সূত্র দিয়ে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে। এই নিয়ে বৈঠকে নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এ প্রসঙ্গে দলের এক নেতা জানান, তার সঙ্গে চিকিৎসকদের কথা হয়েছে। তারা বলেছেন, ম্যাডামের আরও উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। তাকে দেশে রেখে এর বেশি চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব নয়। তাকে সুস্থ করতে হলে বিদেশে উন্নত চিকিৎসা জরুরি। কোভিডপরবর্তী জটিলতায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার হার্ট ও কিডনি আক্রান্ত হওয়ায় চিকিৎসকরা তার শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত বলে গত শুক্রবার জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ ছাড়াও বিএনপি চেয়ারপারসন পুরনো রোগ আথ্রাইটিস, ডায়াবেটিসের জটিলতায় ভুগছেন। তিনি বলেন, যেখানে এসব রোগের অত্যাধুনিক সরঞ্জাম আছে যা দিয়ে এই ধরনের চিকিৎসা সম্ভব সেটি বাংলাদেশের হাসপাতালে সম্ভব নয়। এই জন্য চেয়ারপারসনের পরিবারের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করা হয়েছিল।