শক্তিশালী করতে ঢাকা মহানগর কমিটি ঢেলে সাজানো হচ্ছে- এ আলোচনা বিএনপিতে গত দুবছর ধরেই চলে আসছে। পর্যায়ক্রমে নির্বাচনকালীন ভোট কেন্দ্রভিত্তিক, ওয়ার্ড এবং থানা কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে এ কাজটি করার এক ধরনের নীতিগত সিদ্ধান্ত দলের শীর্ষ নেতৃত্ব নিয়ে রেখেছেন। বর্তমান মহানগর কমিটির শীর্ষ নেতাদের রেখে, নাকি তাদের বাদ দিয়ে নতুন নেতৃত্বে হবেÑ এ ব্যাপারে বারবার সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগেও মহানগর কমিটি গঠন নিয়ে দলের মধ্যে তোড়জোড় শুরু হয়। কিন্তু ভোটের দিন ধানের শীষের পোলিং এজেন্টরা ভোট কেন্দ্রে অনুপাস্থিত থাকায় কমিটি গঠনের বিষয়টি আরও গুরুত্ব পায়। কিন্তু করোনাসহ নানা কারণে গত বছরের ডিসেম্বরের পর সেই আলোচনায় ভাটা পড়ে। আবারও গত কয়েক দিন ধরে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিষয়টি নিয়ে কয়েক নেতার সঙ্গে কথা বললে বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় উঠে আসে।
দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা জানান, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কথায় মনে হয়েছে, তিনিআগস্টের মধ্যেই ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের কমিটি ঘোষণা করতে চান। সে ক্ষেত্রে এমন কাউকে তিনি আহ্বায়ক বা সভাপতি করতে চান, যেখানে সাধারণ সম্পাদক অথবা সদস্য সচিবের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব হওয়ার সুযোগ না থাকে। এ ক্ষেত্রে আগে সভাপতি অথবা আহ্বায়ক ঠিক করে তার সঙ্গে কথা বলেই কেবল সাধারণ সম্পাদক অথবা সদস্য সচিব করা হতে পারে।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর গত বছর দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু উভয় কমিটির একটি খসড়া দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে পাঠিয়েছেন। তারও আগে সিটি নির্বাচনের পরপর দলের স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় দলের নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ‘ভোট কেন্দ্রভিত্তিক’ কমিটি করার পর পর্যায়ক্রমে ওয়ার্ড, থানা এবং মহানগর কমিটি করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এর পর গত ডিসেম্বরে দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের বিএনপির কমিটি গঠন বিষয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে মতামত নেন।
মহানগর বিএনপিকে দুই ভাগ করে সর্বশেষ কমিটি গঠন করা হয় ২০১৭ সালের ১৮ এপ্রিল। দলের যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে দক্ষিণের সভাপতি, কাজী আবুল বাশারকে সাধারণ সম্পাদক করে ৭০ সদস্যের আংশিক এবং উত্তরে এমএ কাইয়ুমকে সভাপতি, আহসান উল্লাহ হাসানকে (প্রয়াত) সাধারণ সম্পাদক করে ৬৬ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়।
দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেন, উভয় কমিটিই আংশিক অবস্থায় মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। সাংগঠনিকভাবে ঢাকা মহানগর কমিটিকে শক্তিশালী করতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দলের বিভিন্ন পর্যায় থেকে নানা প্রস্তাব ও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিজেও ঢাকা মহানগর কমিটি বিষয়ে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তবে এ কমিটি গঠন বিষয়ে কাজের চেয়ে আলোচনাই বেশি হচ্ছে। যার কারণে দিন দিন জটিলতাই বেড়েছে। এ অবস্থায় আবার মহানগরের শীর্ষ পদ পেতে যারা লবিং করছেন তাদের যোগ্যতা ও বিএনপির রাজনীতিতে তার বয়স বিবেচনায় নীতিনির্ধারকরাও বিব্রত হচ্ছেন। ওই নেতা আরও বলেন, যে যা-ই বলুক, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিজেও হিসাব-নিকাশ কষছেন। হিসাব-নিকাশ মিলে গেলেই মহানগর কমিটির বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সিদ্ধান্ত দেবেন।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি অথবা আহ্বায়ক হিসেবে বর্তমান সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেল ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান ও আবদুস সালাম এবং উত্তরে বর্তমান সভাপতি এমএ কাইয়ুম, বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী ও উত্তরে মেয়র নির্বাচন করা তাবিথ আউয়াল হাইকমান্ডের নজরে রয়েছে।
এ ছাড়া সদস্য সচিব অথবা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আলোচনায় আছেন বিএনপি নেতা আমিনুল হক, একেএম মোয়াজ্জেম হোসেন, বজলুল বাসিত আঞ্জু, আব্দুল আলীম নকি, আনোয়ারুজ্জামান আনোয়ার, সাইফুল আলম নিরব এবং দক্ষিণে কাজী আবুল বাশার, হাবিবুর রশিদ হাবিব, রফিকুল আলম মজনু, ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন। এদের বাইরেও আরো অনেকে তদবির করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা মহানগর উত্তরে কমিটি ঘোষণার পরপরই দলীয় নেতাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল দেখা দেয়। মালয়েশিয়া থেকে সভাপতি এমএ কাইয়ুম কীভাবে দলের নেতৃত্ব দেবেন তা নিয়ে সে সময় বিতর্কও ওঠে। ২০১৮ সালে ঘোষিত থানা ও ওয়ার্ড কমিটিতে ‘অযোগ্য ও বিতর্কিতদের’ পদায়ন করায় তা নিয়ে কোন্দল আরও তীব্র আকার ধারণ করে। ৬৬ বিশিষ্ট আংশিক কমিটির ত্রিশজনেরও বেশি নেতা ওই কমিটি থেকে পদত্যাগ করেছিল। এসব নেতাদের পদত্যাগপত্র গৃহীত না হলেও তারা তাদের অনুসারীদের নিয়ে সব সময় পৃথক কর্মসূচি করে আসছেন। এরই মধ্যে গত বছর করোনায় আক্রান্ত হয়ে সাধারণ সম্পাদক হাসান ইন্তেকাল করেন।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সভাপতি এমএ কাইয়ুম বলেন, এত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও আমরা কাজ করে যাচ্ছি। যদি হাইকমান্ড চায় নতুন কমিটি দেবেন আমাদের আপত্তি নেই। তবে ঢাকা সম্পর্কে যাদের জানাশোনা আছে তাদের নেতৃত্বেই যেন কমিটি হয়। এমন কেউ যেন নেতৃত্বে না আসেন যিনি ঢাকার সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। কোনো অলিগলি চেনেন না এমন কাউকে আসা উচিত নয়। আমরা যারা ঢাকায় কাজ করছি, তাদের বিরুদ্ধে মামলা আর মামলা। তারপরও আমরা চেষ্টার কোনো ত্রুটি করছি না। ঢাকা মহানগর বিএনপির সহসভাপতি একেএম মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যাকে যোগ্য মনে করবেন তার নেতৃত্বেই আগামী দিনে ঢাকা মহানগর চলবে।
ঢাকা মহানগরের এ কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে দলের নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটি ও নির্বাহী কমিটির নেতারাও বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একটি অংশ বলছেন, উত্তরে অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব প্রকট, সাধারণ সম্পাদকও মারা গেছেন- এ অবস্থায় উত্তরের কমিটির ওপর বিশেষ নজর দেওয়া উচিত। যেহেতু তাবিথ আউয়াল উত্তরে নির্বাচন করেছেন, সেখানকার নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার বোঝাপড়া ভালো। সে ক্ষেত্রে উত্তরের সভাপতি অথবা আহ্বায়ক দিলে ভালো করবে। দক্ষিণে সোহেল ও বাশারের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। সে ক্ষেত্রে তাদের রেখে দক্ষিণের কমিটি পুনর্গঠন করা যেতে পারে। যদি পরিবর্তন করতেই হয় তা হলে বাশারের স্থলে অপেক্ষাকৃত তরুণ ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশিদ হাবিবকে আনা যেতে পারে। হাবিবও দক্ষিণ বিএনপির প্রথম যুগ্ম সম্পাদক।
অন্যদিকে, দলের অপর একটি অংশ বর্তমান সভাপতি এমএ কাইয়ুম ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আলীম নকির নেতৃত্বে উত্তরের কমিটি এবং চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম ও মেয়র নির্বাচন করা ইশরাক হোসনের নেতৃত্বে দক্ষিণের কমিটি করা যেতে পারে। এ অংশটি ইতোমধ্যে এই নিয়ে কাজও শুরু করে দিয়েছেন। তাদের ধারণা এ কমিটিই অনুমোদন দেবেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
যদিও ঢাকা ও উত্তরাঞ্চলের বেশিরভাগ নেতা সোহেলের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। এসব নেতারা সোহেলের পক্ষে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে ইতিবাচক কথাবর্তা বলেছেন। এসব নেতাদের যুক্তি- দলীয় শীর্ষ নেতৃত্বের আস্থাভাজন সোহেল। স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের নেতৃত্বে অভিন্ন ঢাকার আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন সোহেল, বর্তমানে দক্ষিণের সভাপতিও। সে ক্ষেত্রে সোহেল নেতাকর্মীদের মনোভাবটা ভালো বুঝতে পারবেন।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেল বলেন, দল থেকে আমাদের যে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে তা আমরা পালন করে যাচ্ছি। চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও করোনার কারণে আমরা সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছি। এর মধ্যে আমরা অনেকগুলো ওয়ার্ড ও থানার কমিটি দিয়েছি। হাইকমান্ডের নির্দেশেই বাকিগুলো দেওয়া হয়নি। এখন যদি হাইকমান্ড মনে করে নতুন নেতৃত্বে চলবে ঢাকা মহানগর তা হলে আমরা সেই নির্দেশনা মেনে নেব।
দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেন, মহানগর রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা না থাকলে নেতা যতই বড় হোক তাকে মহানগরের শীর্ষ দুই পদের কোনোটিতেই আনা উচিত হবে না। কারণ, নতুন কাউকে মহানগরের নেতৃত্বে আনা আবার নতুন করে শুরু করা। সেই সময় আর এখন নেই। নতুন করে কাউকে দায়িত্ব দিলে অলিগলি চিনতে চিনতেই সময় পার হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে মহানগর কমিটি যদি করতেই হয়; তা হলে কমিটির ভেতর থেকেই নেতৃত্ব বেছে নেওয়া উচিত। সে ক্ষেত্রে ওয়ান-ইলেভেনের বিষয়টি দলের শীর্ষ নেতৃত্বের মাথায় রাখা উচিত। বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, সংগঠনকে ঢেলে সাজাতে হলে নিচ থেকে কমিটি করে করে ওপরের দিকে আসতে হবে। এ মহানগরের অনেক ওয়ার্ড থানা কমিটি কার্যকর নেই।