পৌষের কাছাকাছি রোদমাখা এই দিনগুলোতে হয়তো আপনি পাহাড় থেকে জঙ্গল, সমুদ্র থেকে শৈল শহর বেড়ানোর পরিকল্পনা করছেন। হতে পারে, এরই মধ্যে হয়তো বেরিয়েই পড়েছেন ছুটির দুর্দান্ত আমেজে। কিংবা হতে পারে, নিতান্ত অলস আমেজে একটি ঝুঁটিওয়ালা পাখি দেখে দেখে কাটিয়ে দিচ্ছেন আস্ত একটি বিকেল। অঘ্রাণের চুরি যাওয়া খাটো বিকেলে তা খুবই সম্ভব। বেমানানও নয় মোটেই। অঘ্রাণের এই হিম হিম বেলায় এমন আমেজ খুব মানানসই। কিন্তু অসংগতিটা কোথায়, জানেন? আপনার জীবন মসৃণ, স্নিগ্ধ ছন্দময় ঠিকই; কিন্তু আপনারই ভূগোলের আরেক প্রান্তের অসণিত-অসংখ্য মানুষের জীবন চূড়ান্ত রকম ছন্দহীন। ভাবছেন, এ নিছক ভৌগোলিক দুর্ঘটনা। হ্যাঁ, এমনটা আপনি বলতেই পারেন, যখন তা ইয়েমেনের অ্যাডেন শহরের সামরিক কেন্দ্রে সরকারি বাহিনীর ৪৮ জনের আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনা ঘটে, যখন তুরস্কের ইস্তাম্বুলের ফুটবল স্টেডিয়ামে বোমা হামলায় ৩৫ জন মারা যায়, শতাধিক আহত হয়, যখন রুশ রাষ্ট্রদূত নিহত হন রক্ষীর হাতে, কায়রোর গির্জায় বোমা বিস্ফোরণে মারা যায় অন্তত ২৫ জন, সোমালিয়া কিংবা নাইজেরিয়ায় আত্মঘাতী হামলার ঘটনা ঘটে, বার্লিন কিংবা প্যারিসের বাস্তিল স্কয়ারে জনবহুল এলাকায় ঢুকে পড়ে ট্রাক, ক্রাইস্ট চার্চে মসজিদে হামলা হয়। কিন্তু যখন আপনার বাড়ির পাশে শ্রীলঙ্কায় আত্মঘাতী হামলার ঘটনা ঘটে, তখন কি আপনি একে নিছক ভৌগোলিক দুর্ঘটনা বলে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেন? পৃথিবী কিন্তু মোটেই এত নিশ্চিন্ত নির্ভার মন্তব্য করার মতো পরিস্থিতিতে নেই। মধ্য ইউরোপ বা মধ্যপ্রাচ্য, এমনকি বাড়ির কাছের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়ও যখন-তখন ঘটছে এ ধরনের আতঙ্কবাদী ঘটনা।
সন্ত্রাসবাদ নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁরা বলছেন, সন্ত্রাস ডিসেমিনেটেড হয়ে যায়নি; বরং তা খণ্ড খণ্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বে। হতে পারে, আপনার মস্তিষ্ক ইস্পাতের মতো। গবেষকদের এই মন্তব্যও আপনি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারেন। ভাবতে পারেন, ‘খলিফা’ আবু বকর আল-বাগদাদি নিহত হওয়ার পর আইএস বলে কিছু কি আর আছে? তাহলে আপনাকে মনে করিয়ে দিই, বিগত কয়েক বছরে বড়সড় সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়তো অনেকটা কমে এসেছে; কিন্তু পরিবর্তে এসেছে অন্য ধারার সন্ত্রাসবাদ। আক্রমণের পন্থাও বদলেছে। বেড়েছে আত্মঘাতী আঘাতের সংখ্যা। আর আইএস যে সিরিয়া থেকে ঘাঁটি সরিয়ে উত্তরে সাহারা ও দক্ষিণে সুদানে ঘাঁটি গাড়ছে সেটা আপনার জানা খবরই। সঙ্গে এ-ও মনে করিয়ে দিই, আল-কায়েদাও কিন্তু নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে একেকটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যার সঙ্গে একীভূত হয়ে যাচ্ছে এখন। ভেবে দেখুন, ঠিক এই মুহূর্তে বিক্ষোভে জ্বলছে ইরাক, মিসর, সুদান, আলজেরিয়া, মরক্কো, তিউনিশিয়া, লেবানন। হ্যাঁ, এখন আপনি একে কাউন্টার ক্রুসেড বলতে পারেন, ১ শতাংশ মানুষের হাতে ৯৯ শতাংশ সম্পদ থাকার বিরুদ্ধে বিপ্লব বলতে পারেন। বিশ্বজোড়া অসাম্য তো আছেই। সর্বোচ্চ সম্পদশালী ১ শতাংশ নাগরিকের বিত্ত জাতীয় সম্পদের ৪০ শতাংশ এবং নিচের সারির ৮০ শতাংশের বিত্ত মোটে ৭ শতাংশ। এটা ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সম্পদের হিসাব। এরপর পৃথিবী অতিক্রম করেছে আরো পাঁচটি বছর। অসাম্য আরো বেড়েছে। সম্পদ আরো কুক্ষিগত হয়েছে অল্পসংখ্যক ধনীর হাতে। বলা যায়, বিক্ষোভ-বিপ্লবের জন্য পরিবেশ ক্রমেই অনুকূল হয়ে উঠছে। আর তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর অবস্থা তো আরো করুণ। সেখানকার নাগরিকদের না আছে সামাজিক নিরাপত্তা, না পূরণ হয়েছে নাগরিকের ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা। জানি, এ সমস্যা প্রায় প্রত্যেকের জানা। তবে কি জানেন, প্রতিটি মৃত্যুই অশান্তির আগুনে ঘৃতাহুতি জুগিয়ে যায়। একটি হত্যা আরেকটি হত্যার পথ খুলে দেয়। যুদ্ধবাদী হয়ে ওঠে পৃথিবী। কী হবে এই যুদ্ধে? শেষ পর্যন্ত কী লাভ হয় এই যুদ্ধে? আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনা ঘটিয়ে কি অধিকার আদায় হবে? কিংবা রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াইয়ে জেতা যাবে? নিজের দেশের অভ্যন্তরে এমন ধ্বংসাত্মক কাণ্ড ঘটিয়ে কার কী-ই বা লাভ হয়? হতে পারে আমরা খুব সরলভাবে চিন্তা করি বলে এসব প্রশ্ন মাথায় আসে। কিন্তু একটা কোনো ব্যাখ্যা তো চাই। একে তো নিছক ধর্মীয় উন্মাদনা, অশিক্ষা কিংবা কুসংস্কারও বলা যাচ্ছে না। কারণ অনেক মেধাবী উচ্চশিক্ষিত তরুণ, যারা ব্যক্তিগত জীবনে খুব একটা ধর্মাচার মানে বলে শোনা যায় না, তেমন তরুণরাও তো জড়িয়ে পড়ছে এসব কাজে।
দুই.
ভাবুন, যে ফ্রান্সকে আমরা ছবির দেশ, কবিতার দেশ বলে এত ভালোবাসি, এত মূল্য-মর্যাদা দিই, সেই ফ্রান্সের মুসলিমদের কাছে কিন্তু ফ্রান্স মোটেও এত কাব্যিক, এত রোমান্টিক, এত মসৃণ দেশ নয়। তারা ভাবে, ফরাসি বিপ্লবের মূল ভাব-দর্শন সাম্য, স্বাধীনতা ও বন্ধুত্ব থেকে আজ কত দূরে সরে এসেছে ফ্রান্স। তারা বরং খুঁজছে ফরাসি বিপ্লবকে চ্যালেঞ্জ করা যায় এমন বিপ্লব। ঠিক যে পৃথিবীর সব দেশে সংখ্যালঘুরা নানা সমস্যায় থাকে। পৃথিবীর কোনো দেশই দাবি করতে পারবে না যে তাদের দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর অন্যায়-অবিচার ঘটে না। প্রতিটি দেশেরই সংখ্যালঘুরা, অভিবাসীরা, বহিরাগতরা, কিঞ্চিৎ হলেও আড়ষ্ট, ভীত, সন্দেহবাদী। তাদের সন্দেহ দূর করার জন্য সংখ্যাগুরুরা উল্লেখযোগ্য কিছু করেও না। সেটা আরেক পরিসরের আলোচনা। কিন্তু পবিত্র কোরআনের ভুল ব্যাখ্যা করে বিশ্বের দেশে দেশে তরুণ সম্প্রদায়কে যারা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে, তাদের মগজে ভাইরাস ঢুকিয়ে দিচ্ছে; সেই ভাইরাসওয়ালাদের মোকাবেলা করার পথ আমাদের সত্যিই জানা নেই। আমাদের দুঃখ হয়, খুবই দুঃখ হয় এ জন্য যে আমাদের প্রচুর বন্ধু আছেন, যাঁরা পাঞ্জাবি-টুপি পরেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে গিয়ে আদায় করেন, যেকোনো বিচারে তাঁরা সর্বোচ্চ পরোপকারী ও ভালো মনের মানুষ। ভাবি, যেকোনো সন্ত্রাসবাদী ঘটনায় যখন মুসলিমদের কাঁধেই দায় পড়ে, তখন কী রকম প্রতিক্রিয়া হয় তাঁদের। সন্ত্রাসবাদী সন্ত্রাসবাদীই, তার কোনো ধর্ম নেই—এমন আপ্তবাক্য শুধু বক্তৃতা আর বিবৃতিতে আছে, বাস্তবে নেই। বাস্তবে রিচ্যুয়ালিস্ট মুসলিমদের নানাভাবে অপদস্থ হতে হয়। ইউরোপের বিমানবন্দরে, বিশেষ করে আমেরিকায় যাত্রীদের মধ্যে মুসলিম নাম দেখলে তাঁকে হেনস্তা করা তো ইমিগ্রেশন বিভাগ এক রকম দায়িত্বই মনে করে। আর মুসলিম হিসেবে বৈষম্যের শিকার তো হনই। একেক সময় রীতিমতো অপমানিত হতে হয়। ইউরোপ-আমেরিকার পুলিশের আমরা কত প্রশংসাই না করি। অথচ শুধু মুসলিম নাম দেখে অকারণে পুলিশ মেরে ফেলেছে এমন ঘটনাও আছে। ইউরোপ-আমেরিকাবাসীর হাতে এমন হতমান-অপমান দেখে স্বাভাবিকভাবেই মনে নানা ভাবনা জন্ম নেয়। মুসলিমদের ঠিক কতটা বিপদে ফেলে দিয়েছে এই জিহাদিরা। স্বীকার করি, তাদের সম্পর্কে খুব কমই জানি। তবে এটুকু তো জানি যে ইসলামের কোনো ধর্মাচারের সঙ্গে সন্ত্রাসের পোস্তদানা পরিমাণ সম্পর্কও নেই। যে বিদ্রোহী বিস্ফোরক বেল্টে বোতাম টিপে নিজেকে হত্যা করে, সে তো আমাদেরই ভাই, আমাদেরই বোন, আমাদেরই মতো মানুষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী ছয় দশক পৃথিবীতে কিছুটা শান্তি-সহিষ্ণুতার পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। এখন আবার নানামুখী যুদ্ধের উন্মাদনায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছে পৃথিবী। নানা ধারায় শক্তি সঞ্চয় করে উঠছে কিছুসংখ্যক যুদ্ধবাদী। আমরা তাদের মনস্তত্ত্বের গভীরে কেন ঢুকতে পারছি না? কেন দুই পক্ষের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান তৈরি হচ্ছে? পক্ষ কি আসলে দুটোই? আক্রমণের একটি প্যাটার্নের সঙ্গে অন্যটির মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে কি আমরা ধরে নেব, এই মিল না থাকাটাই একটা প্যাটার্ন? সন্ত্রাসবাদকে বোধ হয় আর গ্লোবাল সমস্যার তকমা দেওয়া যুক্তিসংগত হবে না। জিহাদকেন্দ্রিক সন্ত্রাসবাদের অবশিষ্টাংশ মিলেমিশে যাচ্ছে একেকটি দেশের ভূমিজ ক্ষোভ-বিক্ষোভের সঙ্গে। তা নিয়ে যথেষ্ট ভাবার বিষয় আছে; কিন্তু যতটা প্রয়োজন, ভাবনা কি সেই পরিসরে হচ্ছে?
লেখক : কথাসাহিত্যিক