রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৫ অপরাহ্ন

শিক্ষার মান ও বাস্তবতা

মাছুম বিল্লাহ
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১
  • ১৪৯ বার

পরীক্ষায় পাস করা মেধা এবং প্রকৃত জ্ঞানচর্চার মধ্যে যে আসলেই বড় পার্থক্য রয়েছে, তার প্রমাণ আমরা দেশে এবং পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই দেখতে পাই। যারা জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত তাদের অনেকেরই একাডেমিক রেকর্ড খুব উজ্জ্বল নয়। তারা জীবনে কিছু করতে চেয়েছিলেন, করতে চেয়েছেন এবং তা পেরেছেন। বহু মানুষের জন্য এবং দেশের জন্য তারা কিছু একটা করেছেন। কিন্তু যারা প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে ভালো ছাত্র হিসেবে, নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছিলেন, তারা শুধু জীবন ধারণের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করেছেন, চারদিকের মানুষের জন্য খুব বেশি কিছু করতে পারেননি। সবাই সবকিছু করবেন না। এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে, যারা প্রচলিত পদ্ধতির পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে তাদের মেধা নেই তা কি বলা যাবে? আমরা আমাদের দেশসহ বিশে^র বহু দেশের রাজনীতিবিদদের দিকে তাকালে কী দেখতে পাই? কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো রাজনীতিবিদদেরই একাডেমিক ট্র্যাকরেকর্ড নেই, অথচ তারা দেশ পরিচালনা করেন। মন্ত্রণালয়ের সর্বস্তরের বাঘা বাঘা কর্মকর্তা, পাবলিক সার্ভেন্ট তাদেরই নেতৃত্বে, তাদেরই গাইডেন্সে কাজ করে থাকেন। তাই বলে শ্রেণী কক্ষে নিয়মিত ক্লাস হবে না বা যারা ক্লাস করবে না তাদের নেতা হিসেবে গণ্য করা হবে- তা বলছি না। শিক্ষার্থীদের মেধার খবর এবং সেটি কোন দিকে ধাবিত হতে চায় তা জানাই হচ্ছে মেধার প্রকৃত মূল্যায়ন। এটি অত্যন্ত কঠিন কাজ। কিন্তু সফল একজন শিক্ষকের তা পারা প্রয়োজন।
২০২০ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় সারা দেশে গড় পাসের হার ৮২.৮৭ শতাংশ, যা ২০১৯ সালে ছিল ৮২.২০ শতাংশ। এ বছর মোট জিপিএ ৫ পেয়েছে এক লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৮ জন, যা গত বছর ছিল এক লাখ পাঁচ হাজার ৫৯৪ জন। এত ভালো ফলের পরও ১০৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কেউ পাস করেনি। এর মধ্যে ছয়টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৪৮টি দাখিল মাদরাসা ও ৫০টি ভোকেশনাল স্কুল। এসব প্রতিষ্ঠানে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ৮১৯ জন। মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে ৪৮টি মাদরাসায় একজন পরীক্ষার্থীও পাস করতে পারেনি তার মধ্যে অন্তত ৯টি মাদরাসা ছিল, যেগুলোর পরীক্ষার্থী ছিল মাত্র একজন করে। অথচ শিক্ষক ছিলেন ১১ জন। এমপিওভুক্তির জনবল কাঠামো অনুসারে মাধ্যমিক স্তরের প্রতিটি বিদ্যালয় ও মাদরাসায় একজন প্রধান শিক্ষক বা সুপারসহ মোট ১২ জন শিক্ষক সরকার থেকে এমপিওভুক্ত হয়ে বেতন পেয়ে থাকেন। এর সাথে আরো চারজন কর্মচারীও এমপিওভুক্ত হন। এমপিওভুক্তি নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলেছেন, ‘শতভাগ ফেল করা এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শাও নোটিশ দেয়া হবে। জবাব সন্তোষজনক না হলে এমপিও বন্ধ থাকবে।’

বলা যায়, শিক্ষকরা যদি গল্প করেও বিভিন্ন বিষয়ের তথ্যগুলো শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীদের জানাতেন তাহলে তো একেবারে ৩৩ না পাওয়ার কথা নয়। প্রতিটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে একটি করে কমিটি থাকে। তাদের দায়িত্ব¡ বা কর্তব্য কী? যখন অর্থের ভাগাভাগির বিষয় থাকে তখন তো বিদ্যালয়ের বা মাদরাসার আঙিনা তারা ছাড়তে চান না। কিন্তু একজন শিক্ষার্থীও যেখানে পাস করল না সেখানে তাদের কোনো কথা শোনা যাচ্ছে না, কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। তাহলে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এলাকার কথিত গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি গঠন করার প্রয়োজন আছে কি? এবার ফেব্রæয়ারি মাসে একটি বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম অতিথি হয়ে। সেখানে দেখলাম, এলাকার যত পাতি নেতা আছেন, সবাই বিদ্যালয়ের স্টেজে, মাঠে, প্রধান শিক্ষকের রুমে। প্রধান শিক্ষককে তাদের সবাই নির্দেশ দিচ্ছেন। অবাক হলাম। বারবার বলেছি যে, তাকে সিদ্ধান্ত নিতে দিন। তিনি কার কথা শুনবেন? বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর যে অবস্থা তাতে প্রতিষ্ঠানগুলোর এগিয়ে যাওয়ার পথ সরু হয়ে আসছে। কে দেখবেন এসব?

আমাদের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কিছু চিত্র দেখা যাক। সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার শহীদ সত্য সমিতি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল মাত্র একজন শিক্ষার্থী। সে ইংরেজিতে ফেল করেছে। উল্লেখ্য, ওই বিদ্যালয়ে ইংরেজি ও গণিতের কোনো শিক্ষকই নেই। রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার আল হুদা আদর্শ দাখিল মাদরাসায় চলতি বছরে ২০ জন দাখিল পরীক্ষার্থী ছিল। তাদের সবাই গণিত, আরবি কিংবা উভয় বিষয়েই ফেল করেছে। প্রতিষ্ঠানটিতে গণিত ও আরবি বিষয়ের কোনো শিক্ষক নেই। এবার ৯ হাজার ১০০টি মাদরাসা দাখিল পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। গতবার মাদরাসাগুলোতে ৮৩ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ এবং এবার পাস করেছে ৮২ দশমিক ৫১ শতাংশ। অতীতে প্রায় প্রতি বছরই মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের পাসের হার অন্য বছরের চেয়ে বেশি ছিল। এটি বোধগম্য নয়।

২০১৫ সালে এই বোর্ডে পাসের হার ছিল ৮৮ দশমিক ২২ শতাংশ। মাদরাসাগুলোর প্রতি মাদরাসা বোর্ড ও মাদরাসা অধিদফতরের নজরদারির অভাবে এমনটি হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ঠাকুরগাঁওয়ের গেদুরা ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় দাখিল মাদরাসা, একই জেলার রানীশংকৈলের সিএস দাখিল মাদরাসা, দিনাজপুরের খানসামার মারগাঁও ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসা, জামালপুরের সূর্যনগর বসুন্ধরা আদর্শ মাদরাসা, মুক্তাগাছা বিন্যাকুড়ি দাখিল মাদরাসা, পটুয়াখালীর বেগম রাবেয়া ইয়াছিন বালিকা দাখিল মাদরাসা, নাটোরের শেখরপাড়া দাখিল মাদরাসা, বাগাতিপাড়া থেকে মাত্র একজন করে পরীক্ষার্থী দাখিল পরীক্ষায় অংশ নিয়েও অকৃতকার্য হয়েছে।

এ ছাড়া ২২ জন পরীক্ষার্থী অংশ নিয়ে সবাই ফেল করেছে ভোলার দৌলতখানের জয়নগর আদর্শ দাখিল মাদরাসা থেকে। একই সংখ্যক পরীক্ষার্থীর সবাই ফেল করেছে যশোরের চৌগাছার মাকাপুর দাখিল মাদরাসা থেকে। ২০ পরীক্ষার্থী নিয়ে ফেল করেছে রাজশাহী ও রংপুরের আরো দুটি মাদরাসায়। দুই পরীক্ষার্থীর মধ্যে দু’জনই ফেল করেছে চারটি মাদরাসায়। আর তিন পরীক্ষার্থী নিয়ে সবাই ফেল করেছে পাঁচটি মাদরাসায়। দিনাজপুর জেলার খানসামা উপজেলার চকরামপুর হাই স্কুলটি ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত। এ বিদ্যালয়ের ১১ জন এমপিওভুক্ত শিক্ষক প্রতি মাসে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন-ভাতা পান। এ বছরের এসএসসি পরীক্ষায় দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এ বিদ্যালয় থেকে অংশ নিয়েছিল মাত্র সাতজন শিক্ষার্থী। তাদের সবাই ফেল করেছে।

একজন শিক্ষার্থীও পাস না করার ঘটনা নতুন নয়। ২০১৯ সালেও ১০৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কেউ পাস করতে পারেনি। এবার দেখা গেছে, দিনাজপুরের একটি বিদ্যালয়ে মাত্র সাতজন শিক্ষার্থীর কেউই পাস করতে পারেনি, অথচ সেখানে শিক্ষক রয়েছেন ১১ জন। মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ৪৮টি মাদরাসার একজন পরীক্ষার্থীও পাস করতে পারেনি। তার মধ্যে অন্তত ৯টি মাদরাসার পরীক্ষার্থী সংখ্যা ছিল মাত্র একজন করে।

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিও নীতিমালা ও জনবল কাঠামো ২০১৮ এর ৭ নম্বর ধারায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, বেতন-ভাতার সরকারি অংশ প্রাপ্তির শর্তাবলি মানতে হবে। সে শর্তাবলিতে বলা হয়েছে, পাবলিক পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীদের ন্যূনতম সংখ্যা প্রতিটি ট্রেড থেকে ৩০ জন এবং পাসের ন্যূনতম হার হতে হবে ৭০ শতাংশ। এই শর্ত পূরণ না হলে ২৯ নম্বর ধারা অনুযায়ী এমপিও স্থগিত, কর্তন ও বাতিলকরণ হবে। যে ৪৮টি মাদরাসা থেকে একজন পরীক্ষার্থীও দাখিল পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি সেগুলোর স্বীকৃতি বাতিল, পাঠদানের অনুমতি স্থগিত এবং ইআইএন নম্বর বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড। প্রাথমিকভাবে মাদরাসাগুলোকে শোকজ করা হয়েছে। মাদরাসাগুলোকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ডাকযোগে মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডে পাঠাতে বলা হয়েছে। যে ছয়টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ৫০টি কারিগরি বিদ্যালয় থেকে একজনও পাস করেনি, সেগুলোর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে, তাও দেখার বিষয়।

দীর্ঘ সাড়ে ৯ বছর অপেক্ষার পর ২০১৯ সালে চার শর্তে দুই হাজার ৭৩০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়েছে, যদিও কিছু প্রতিষ্ঠান এখনো এমপিওর অর্থ পায়নি। প্রায় ৯ হাজার প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন করেছিল। নতুন ঘোষিত প্রতিষ্ঠানগুলো বাদে বর্তমানে ২৬ হাজারের কিছু বেশি এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে পাঁচ লক্ষাধিক শিক্ষক ও কর্মচারী কর্মরত। যেসব প্রতিষ্ঠানের কেউ পাস করেনি, সেগুলোর তুলনায় অনেক নন-এমপিও প্রতিষ্ঠান এবার অনেক ভালো ফল করেছে। কাজেই এমপিওভুক্তকরণ যে, সঠিক কারণ মেনে করা হচ্ছে না তাও এখান থেকে বোঝা যায়। যারা ভালো গ্রেড নিয়ে পাস করেছে আমরা কিন্তু তাদের সবার থেকে আশা করতে পারি না যে, তারা বাংলায় সুন্দর করে কিছু একটা লিখতে পারবে, ইংরেজিতে নিজের সম্পর্কে শুদ্ধ করে দু’চারটি বাক্য লিখতে পারবে, গণিতের ফিগার পরিবর্তন করে দিলে সহজে সমাধানটি করতে পারবে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় প্রায় ২৪ লাখ গ্রাজুয়েট ও মাস্টার্স ডিগ্রিধারী পরীক্ষা দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে লিখিত পরীক্ষায় পাস করেছেন মাত্র ২.৩ শতাংশ প্রার্থী। আমরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখলাম, কিছু কিছু এলাকায় ফল পুরোপুরি নেমে গেছে। কারণ হিসেবে জানলাম, গণিত কিংবা ইংরেজি পরীক্ষার দিন ম্যাজিস্ট্রেট এসে কিংবা ইউএনও এসে হঠাৎ কড়াকড়ি করায় এ অবস্থা হয়েছে। তার মানে কী? যে ফল আমরা দেখি, তা প্রকৃত ফল নয়। আর তা তো প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা থেকেই দেখতে পাচ্ছি।

শিক্ষার্থীদের বিচার করা কঠিন কাজ। এটি তিন বা পাঁচ বছর পর হঠাৎ এক, দুই বা তিন ঘণ্টার পরীক্ষার মধ্য দিয়ে বিচার করা সবসময়ই যুক্তিযুক্ত হয় না। তারপরও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমাদের এর ওপরই নির্ভর করতে হয়। তবে, রাষ্ট্রীয় পরীক্ষা যাই হোক, যেভাবেই হোক, একজন প্রকৃত শিক্ষক কিন্তু শিক্ষার্থীদের গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাদের লুক্কায়িত প্রতিভা আবিষ্কার করতে পারেন, যেটি হচ্ছে প্রকৃত মূল্যায়ন।

লেখক : শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com