বিরোধ নিষ্পত্তি করে দলকে শক্তিশালী করার জন্য আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশনার পর নড়াচড়া শুরু হয়েছে তৃণমূল আওয়ামী লীগে। বিরোধপূর্ণ এলাকায় দলীয় সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানেরও নির্দেশ দেন তিনি। যেসব এলাকায় বিরোধ বেশি সেখানে দ্রুততম সময়ে সম্মেলন দেওয়ার সিদ্ধান্তও আসে দলীয় হাইকমান্ড থেকে। গত বৃহস্পতিবার দলের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক থেকে এমন বার্তা তৃণমূলে পৌঁছার পর বিরোধপূর্ণ এলাকায় সমঝোতার পথ খুঁজছেন নেতাকর্মীরা।
স্থানীয় নেতারা বলছেন, দলের সভাপতি শেখ হাসিনা সব সময় বলে থাকেন- তৃণমূলই আওয়ামী লীগের শক্তি। সেই ভাবনা থেকেই তিনি তৃণমূলের প্রতি এই নির্দেশনা দিয়েছেন। সব নেতাকর্মীর প্রতি সুদৃষ্টি রেখেই তৃণমূল আওয়ামী লীগে সাংগঠনিক কার্যক্রম চলবে এবং দলকে সংগঠিত করতে হবে।
কার্যনির্বাহী কমিটি সূত্রে জানা গেছে, নোয়াখালী, বরিশাল, মাদারীপুর, নরসিংদী, রংপুর, নাটোর, পাবনা ও ঢাকা মহানগরসহ বেশ কিছু এলাকায় অভ্যন্তরীণ বিরোধ চরমে। এসব এলাকায় বেশ কয়েক বছর ধরে একাধিক গ্রুপ বিভাজিত হয়ে দলীয় রাজনীতি চলছে। এক গ্রুপের অনুসারীরা অন্য গ্রুপের ছায়াও দেখেন না এমন পরিস্থিতিও আছে কোনো কোনো জেলায়। এসবের সূত্র ধরে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে বরিশাল, নোয়াখালী ও নাটোরসহ দেশের বেশকিছু জেলায়। এমপি বনাম স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিরোধ তো প্রায় সারাদেশেরই চিত্র; কিন্তু দলের কার্যনির্বাহী কমিটি থেকে দলীয় হাইকমান্ড কঠোর বার্তা দেওয়ায় তৃণমূলের নেতাদের অবস্থান থেকে সরে দাঁড়ানোর পরিস্থিতি না হলেও তাদের স্বর নিচু হতে শুরু করেছে। আওয়ামী লীগের বিরোধপূর্ণ জেলাসহ অন্যান্য জেলার নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
রাজশাহী বিভাগের নাটোর জেলার এক নেতা আমাদের সময়কে বলেন, নাটোরের রাজনীতিতে অস্থিরতা অনেকদিন ধরে। সভাপতি আবদুল কুদ্দস ও সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শিমুলের দ্বন্দ্ব চরমে ছিল। এর সূত্র ধরেই প্রতিনিয়ত নাটোরের রাজনীতিতে নানা শঙ্কা বিরাজ করে; কিন্তু দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশের একদিন পরই চিত্র অনেকটা বদলেছে। নেতাকর্মীদের কথাবার্তাতেও পাওয়া যাচ্ছে পরিবর্তনের সুর। তিনি জানান, এইতো কদিন আগেও জেলা সভাপতিকে এলাকা ছাড়ার হুমকি দিয়েছিলেন সাধারণ সম্পাদক। আগামী ৬ নভেম্বর নাটোর জেলায় সম্মেলনের কথা উঠতেই নেতাদের ভাষ্য পরিবর্তন হতে শুরু করেছে।
বক্তব্যে ভিন্নতা পাওয়া গেছে নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল কুদ্দুস এমপিরও। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘এত বড় দলে বিরোধ থাকবেই। বিরোধ কোথায় নেই। এখানে বিরোধ আছে, সময়মতো ঠিক হয়ে যাবে।’
নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শিমুল আমাদের সময়কে বলেন, ৭ নভেম্বর সম্মেলন হবে- এটা শুনতেছি। এখনো আনুষ্ঠানিক চিঠি পাইনি। তিনি বলেন, নেত্রী চাইলে সম্মেলন হবে এবং আমরা গর্জিয়াসভাবেই সেটি করব। নেত্রী শেখ হাসিনা যা-ই ডিসাইড করবেন এর জন্য আমি প্রস্তুত। দলীয় কোন্দলের কথা অস্বীকার করে শিমুল এমপি বলেন, আমার সঙ্গে কারও কোনো বিরোধ নেই।
নাটোরের অদূরে পাবনাতেও দলীয় বিরোধ চরমে। সেখানে গত পৌরসভা নির্বাচনে অন্তত ২০ জন বিদ্রোহী প্রার্থী হন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শর্তসাপেক্ষে ক্ষমা পাওয়ায় তাদের মধ্যেও স্বস্তির সুর লক্ষ করা গেছে। এ ছাড়া পাবনার আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দৃশ্যমান কোন্দলেরও অবসান হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
এক নেতা আমাদের সময়কে বলেন, পাবনার সম্মেলন ৭ নভেম্বর হবে- এমন খবরে এলাকার রাজনীতিতে নতুন মেরুরণ হতে পারে বলে আলোচনা চলছে সর্বত্র; বইছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তবে বেশিরভাগ মানুষ নতুন নেতৃত্বের পক্ষে।
কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলার রাজনীতিতে দ্বন্দ্বের প্রসঙ্গ উঠে আসে; কিন্তু রংপুর জেলার সভাপতি মমতাজউদ্দিন আহম্মেদ আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের জেলায় কোনো দ্বন্দ্ব নেই। ৮ উপজেলা নিয়ে রংপুর জেলা গঠিত। এর একটি ছাড়া বাকিগুলোর সম্মেলন হয়ে গেছে। কমিটি অত্যন্ত শক্তিশালী হয়েছে এবং বিচক্ষণ নেতা এসেছেন। এখানকার রাজনীতি অত্যন্ত সুন্দর।
কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে সবেচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে মাদারীপুরের রাজনীতির গ্রুপিং নিয়ে। ওই এলাকায় আওয়ামী লীগের তিন কেন্দ্রীয় নেতা- দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খান এমপি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ও প্রচার সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপের মধ্যে মতবিরোধ আছে। একজন অন্যজনের বিরুদ্ধে দলীয় ফোরামে অভিযোগও তুলে ধরেছেন। প্রত্যেকের বক্তব্য শোনার পর নেত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে মিলেমিশে রাজনীতি করার নির্দেশনা দেন। আগামী ১২ সেপ্টেম্বর রাজৈর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলার চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা শাজাহান খানের স্মরণসভা। মাদারীপুর জেলা ও রাজৈর উপজেলার উদ্যোগে স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হবে। এই স্মরণসভায় দলের কেন্দ্রীয় তিন নেতা উপস্থিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম আমাদের সময়কে বলেন, রাজৈর উপজেলার ত্যাগী নেতা শাজাহান খান মারা গেছেন অনেকদিন হলো। আমি ইতিপূর্বে তার কবর জিয়ারত করেছি। পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছি। ১২ সেপ্টেম্বর স্মরণসভা হবে। সেখানে একজন নম্র-ভদ্র-ত্যাগী এই নেতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে কিছু কথা বলতে পারব- এটা ভেবে ভালো লাগছে।
জানা গেছে, শাজাহান খান মারা গেছেন প্রায় এক বছর হয়ে গেল। এখন পর্যন্ত স্থানীয় এমপি ও তার অনুসারীদের উদ্যোগে কোনো স্মরণসভা হয়নি। এমনকি দলের এমন ‘ত্যাগী’ নেতার কবরও জিয়ারত করেননি তারা। তবে এই স্মরণসভা তাদের জন্য পরীক্ষা। সেখানে উপস্থিত না হলে নেত্রীর নির্দেশনা উপেক্ষিত হবে- এই ভেবে সবাই উপস্থিত হতে পারেন।
রংপুর বিভাগের লালমনিরহাট জেলায় দলীয় বিরোধ চরমে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট সফুরা বেগম রুমীর সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও এমপির দ্বন্দ্ব রয়েছে। দ্বন্দ্ব এতটাই চরমে যে, তাকে স্থানীয় কোনো আয়োজনে আমন্ত্রণও জানানো হয় না। বৃহস্পতিবার কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে এরকম পরিস্থিতি তুলে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন সফুরা। লালামনিরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহার হোসেন এমপি আমাদের সময়কে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগে অভ্যন্তরীণ কোন্দল অনেকদিন ধরে। তবে এক বছর ধরে এই দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করেছে। দলীয় এই দ্বন্দ্বের জের ধরে বেশকজন নিহতও হয়েছেন, আহত হয়েছেন শতাধিক নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরী এমপি ও ওবায়দুল কাদেরের ভাই বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জার দ্বন্দ্ব বছরজুড়েই দেখেছে সবাই। এর অবসানের লক্ষ্যে সম্প্রতি সেখানে আগের কমিটি ভেঙে আহ্বায়ক কমিটি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। একরামুল করিম চৌধুরীর বিরোধী অবস্থানে জেলার সভাপতি ও সুবর্ণচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ খায়রুল আনম চৌধুরী সেলিমও।
গত সপ্তাহজুড়ে নোয়াখালী আওয়ামী লীগের দ্বিধা-বিভক্তি কেন্দ্র করে হামলা-পাল্টাহামলা হয়। এর সূত্র ধরে সেখানে দফায় দফায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। গতকালও নোয়াখালীতে বিরূপ পরিবেশ ছিল। তবে কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকের পর কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে বর্তমানে নোয়াখালীর পরিবেশ কিছুটা শান্ত। অধ্যক্ষ খায়রুল আনম চৌধুরী সেলিম আমাদের সময়কে বলেন, নোয়াখালীর দ্বিধা-বিভক্তি দূর হয়নি। তবে বর্তমান পরিস্থিতি কিছুটা ভালো।’
বরিশাল মহানগর ও জেলার রাজনীতিতে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব অতঃপর মীমাংসা হয়। তবু সেখানের রাজনীতি দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে আছে। সেখানকার কোনো নেতা নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে রাজি হননি। স্থানীয় এক নেতার ভাষ্য- নেত্রী শেখ হাসিনার হুশিয়ারি এখানে পৌঁছলে বরিশালে কোনো দ্বন্দ্ব থাকবে না।