এটি এক ফ্যাশনে পরিণত হতে যাচ্ছে যে, কিছু মুসলমানকে যেকোনো একটি শিরোনামে একত্র করে আরএসএস নেতারা পাঠ শেখাচ্ছেন। পাঠদানটাও এমন, যা ক্লাসে ছাত্রদের দেয়া হয়ে থাকে। কোথাও বুদ্ধিজীবী, কোথাও আলেম ও কোথাও ইসলামের ‘দায়ী’ হিসেবে এ মুসলমানরা মোহন ভাগবতের এমন লেকচার শুনছেন, যা বাস্তবতা থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে। কষ্টের বিষয় হচ্ছে, এগুলোকে শান্তভাবে সানন্দে মেনেও নেয়া হচ্ছে। আমরা এ কথা বলছি না যে, আরএসএস এবং মুসলমানদের মাঝে আলোচনা হওয়া উচিত নয়। অবশ্যই হওয়া উচিত। কিন্তু তার ধরনটা যেন একতরফা না হয়। বরং মুসলমান নেতারা সামনাসামনি বসে ভাগবতের ওইসব বিষয় নিয়ে লক্ষ্যপূর্ণ আলোচনা করবেন, যা স্বাধীনতার পর থেকে লাগাতার মুসলমানদের মুখোমুখি হচ্ছে এবং যে ইস্যুগুলো তৈরির ক্ষেত্রে সঙ্ঘ পরিবারের সংগঠনগুলোরই হাত রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে পরস্পরের মাঝে সম্পূর্ণরূপে শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা। কেননা, মুসলমানরা ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে ক্রমাগত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের শিকার হচ্ছেন এবং তাদের মারাত্মকরূপে জানমালের ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করতে হচ্ছে। এখনো যে সময় আরএসএস পরোক্ষভাবে দেশের ক্ষমতায় দখল করে আছে, সে সময় পুরো দেশে মুসলমানরা মারাত্মক আক্রমণ ও আগ্রাসনের শিকার হচ্ছেন। তাদের এ পরিমাণ ধর্মীয় বিদ্বেষের টার্গেট বানানো হচ্ছে যে, তাদের বেঁচে থাকা যেন হারাম হয়ে গেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, উগ্রবাদী হিন্দুদের নির্যাতনের শিকার ওই মুসলমানদেরই নিজেদের অঙ্গনে উগ্রবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য বলা হচ্ছে। সেপ্টেম্বরের শুরুতে মুম্বাইয়ের একটি পাঁচতারা হোটেলে সমবেত মুসলমানদের মোহন ভাগবত একতরফাভাবে এ পাঠই দিয়েছেন। অংশগ্রহণকারীদের ধারণা, এর দ্বারা হিন্দু ও মুসলমানদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝির নিরসন হবে। এর আগে গাজিয়াবাদে এক অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রীয় মুসলিম মঞ্চের কর্মীদের মাঝে মোহন ভাগবত এ কথাগুলোই বলেছিলেন। সেখানেও কারো সাহস হয়নি ভাগবতকে উত্তাপ ইস্যু সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে। এমন ধরনের ঘটনা মুম্বাইতেও ঘটেছে। সেখানে বিদ্যমান কোনো দায়ী, কোনো বুদ্ধিজীবী ও কোনো আলেমের এ ভুলটি ধরিয়ে দেয়ার সুযোগ হয়নি যে, স্বয়ং মোহন ভাগবত হিন্দু সমাজে বৃদ্ধি পাওয়া উগ্রবাদের বিরুদ্ধে কতটুকু সংগ্রাম করছেন?
মোহন ভাগবত এখানেই ক্ষান্ত হননি। বরং তিনি পুনের এক সভায় এ স্পষ্ট মিথ্যা অপবাদও আরোপ করেন যে, ভারতে সন্ত্রাসের মাধ্যমে ইসলাম এসেছে। এখানেও তিনি মুসলিম নেতাদের কাছে উগ্রবাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান অবলম্বনের আবেদন করেন। ভাগবত বলেছেন, ‘ইসলাম সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে ভারতে এসেছে। এটি এক ঐতিহাসিক সত্য।’ এর পাশাপাশি তিনি বলেন, ‘মুসলমানদের বোদ্ধা নেতাদের উগ্রবাদের বিরোধিতা করা উচিত। উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে তাদের কঠিন কথা বলতে হবে।’ মনে হচ্ছে, ভাগবতজী এখনো ভারতে মুসলমানদের আগমনের ইতিহাস অধ্যয়ন করেননি। সম্ভবত এ কারণেই তিনি এক স্বচ্ছ মিথ্যাকে ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে বর্ণনা করে যাচ্ছেন। যদি তিনি কিছু মনে না করেন, তাহলে আমরা বলতে চাইব যে, ইসলাম রাসূলে আরাবি সা:-এর যুগেই সপ্তম খ্রিষ্টীয় শতাব্দীতে ভারতে পৌঁছে। রাসূলুল্লাহ সা:-এর সহচর মালিক বিন দিনার রা: ভারতে আগমনকারী প্রথম মুসলমান যিনি কেরালার পশ্চিম উপক‚লে আগমন করেন। ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে এখানেই ভারতের প্রথম মসজিদ নির্মাণ করা হয়, যা আজো স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। মুসলমান আক্রমণকারীদের নিয়ে যে প্রশ্ন থেকে যায়, সে বিষয়ে ভাগবতজীর মনে রাখা উচিত যে, তারা ইসলাম প্রচারের জন্য এখানে আসেননি। বরং তাদের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন, যা তারা পূর্ণ করেছিলেন। ভারতে ওই আক্রমণকারীদের আগমন হয়েছিল প্রথম মুসলমান আগমনের পাঁচ শ’ বছর পর। তবে এটিও একটি বাস্তবতা যে, মুসলিম বাদশাহদের প্রায় আট শ’ বছরের শাসনকালে এ বিষয়ের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে, তারা এখানে ইসলামের প্রচারের কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন বা জোরপূর্বক কাউকে মুসলমান বানিয়েছেন।
ভারতে মূলত সাম্যনীতি (বর্ণ-গোত্র-জাতপাত নির্বিশেষে সবাই সমান) ও মানবতাবাদী আদর্শের কারণে ইসলাম জনপ্রিয়তা লাভ করে। হিন্দু সমাজে অচ্ছুৎ ও অস্পৃশ্য হওয়ার কারণে পশ্চাৎপদ শ্রেণীর যেসব লোকের বেঁচে থাকা হারাম হয়ে গিয়েছিল, তারা দ্রুত ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কেননা, মুসলমানরা সেই সব লোকের সাথে বসে পানাহার করতেন, ভাগবতজীর সমাজ যাদের ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। বাস্তবতা হচ্ছে, ভারতে ইসলামের সবচেয়ে বেশি উন্নতি হয়েছে সুফিদের মানবতাবাদের মাধ্যমে। তন্মধ্যে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী রহ:, হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া রহ., হজরত কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকী রহ.-এর মতো বুজুর্গদের বড় ভ‚মিকা রয়েছে। আর এ কারণেই আজো তাদের মাজারে উপস্থিত হওয়া লোকদের মধ্যে সংখ্যায় মুসলমানের চেয়ে হিন্দুরা বেশি, যারা এখানে এসে আত্মিক প্রশান্তি লাভ করে। স্বয়ং বিজেপির ফায়ার ব্র্যান্ড (যে নেতা সামাজিক বা রাজনৈতিক কলহের সৃষ্টি করেন, তাকে ‘ফায়ার ব্র্যান্ড’ বলা হয়) নেত্রী উমা ভারতী ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেছিলেন, ‘ভারতকে যে দু’-চারটি শক্তি আধ্যাত্মিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করে রেখেছে, তার মধ্যে একটি শক্তি খাজা আজমিরীর।’
আমরা এ কথা কখনোই বলব না যে, হিন্দু ও মুসলমানদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি দূর করার জন্য আলোচনা হওয়া উচিত নয়। তবে এ আলোচনা ‘গোলটেবিল’ বৈঠকের আকারে হতে হবে। লেকচারের আকারে নয়। কেননা, লেকচার প্রদানকারী শুধু নিজের কথা বলেন এবং অন্যের কথা শোনার প্রতি আগ্রহী নন। আরএসএস তাদের শর্তের আলোকে মুসলমানদের সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে চায়। তাদের সবচেয়ে বড় শর্ত হচ্ছে, ভারতীয় মুসলমানরা নিজেদের ‘হিন্দু’ মনে করবেন। কেননা, তাদের দৃষ্টিতে ভারতে বসবাসকারী প্রতিটি ব্যক্তি, সে যে ধর্মেরই হোক না কেন, মৌলিকভাবে ‘হিন্দু’। মোহন ভাগবত তার বক্তৃতাগুলোতে এ কথার ওপরই বেশি জোর দিচ্ছেন। পক্ষান্তরে মুসলমানদের বক্তব্য, তারা হিন্দু নন বরং তারা ‘হিন্দুস্তানি’ এবং তারা নিজেদের এই পরিচয়ে ততটাই গর্বিত, যতটা গর্বিত মুসলমান হওয়াতে। ভাগবত মুম্বাইতে এ কথাও বলেন যে, “সব হিন্দুস্তানির ডিএনএ একটাই। আমাদের সবার পূর্বপুরুষ একই। আমরা সবাই ভারতমাতার সন্তান। যার জন্ম ভারতে হয়েছে, সে হিন্দু। তার জাত, ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও ধর্ম যাই হোক না কেন।” প্রথমত ভাগবতজীকে এটা স্পষ্ট করা উচিত যে, তিনি সব হিন্দুস্তানিকে ‘হিন্দু’ প্রমাণ করতে কেন উঠে পড়ে লেগেছেন? যেখানে হিন্দুস্তানের অধিবাসীদের সারা পৃথিবীতে ইন্ডিয়ান বা হিন্দুস্তানি বলা হয়, সেখানে এ ব্যাপারে তার আপত্তি কেন? এখন আসুন, এ ব্যাপারে আরএসএসের প্রতিষ্ঠাতা সাভারকারের দৃষ্টিভঙ্গির দিকে ফিরে যাই, যিনি ‘হিন্দু’ শব্দের আসল ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন। তিনি তার বিখ্যাত ‘হিন্দুত্ব’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘হিন্দু সেই, যে হিন্দুস্তানকে পবিত্র ভ‚মি স্বীকার করে’। বাহ্যত মুসলমানরা স্বদেশভ‚মি হিসেবে হিন্দুস্তানকে ভালোবাসে এবং এমনটি করা ইসলামী শিক্ষারই একটি অংশ। কিন্তু যখন স্বদেশকে ‘পবিত্র’ আখ্যায়িত করে তার উপাসনা করার প্রশ্ন ওঠে, তখন এটি ইসলামে বৈধ নয়। কেননা, ইসলামে উপাসনা (ইবাদত) শুধু আল্লাহরই করা হয়। আর মাটি বা ভ‚খণ্ডের উপাসনা করা শিরক বা অংশীদারিত্বের অন্তর্ভুক্ত। ধর্ম ও দেশের ভালোবাসার প্রশ্নে এ দর্শনকে রইসুল আহরার মাওলানা মুহাম্মাদ আলী জওহার লন্ডনের গোলটেবিল বৈঠকে বেশ প্রামাণ্য আকারে উপস্থাপন করেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার কাছে একটা সংস্কৃতি আছে। একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা আছে। একটি জীবনের তত্ত¡ আছে। আর ইসলাম এসব কিছুর মিশ্রণ। যেখানেই আল্লাহর বিধান পালনের বিষয় সংশ্লিষ্ট, সেখানে আমি প্রথমেও মুসলমান, দ্বিতীয়তেও মুসলমান এবং শেষেও মুসলমান। অর্থাৎ মুসলমান হওয়া ছাড়া আর কিছুই নই। কিন্তু যেখানে হিন্দুস্তান প্রসঙ্গে প্রশ্ন আসে, যেখানে হিন্দুস্তানের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন আসে, অথবা যেখানে হিন্দুস্তানের কল্যাণের প্রশ্ন দেখা দেয়, সেখানে আমি প্রথমেও হিন্দুস্তানি, শেষেও হিন্দুস্তানি। হিন্দুস্তানি হওয়া ছাড়া আর কিছুই নই।’
মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুম্বাই উর্দু নিউজ ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২১ হতে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট