বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সামগ্রিকভাবে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে। যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের কৃষি তথা সার্বিক জীবনযাত্রার ওপর। ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যার আধিক্য, আর্থসামাজিক অবস্থার কারণে জলবায়ুর পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বিপদাপন্ন দেশ হিসেবে পরিচিত। জলবায়ু পরিবর্তন এমন একটি বিষয়, যা সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকা-কে প্রভাবিত করতে পারে। পৃথিবী সৃষ্টির আদিকাল থেকে পরিবর্তিত হচ্ছে জলবায়ু। এর প্রভাব পড়েছে পরিবেশ ও মানুষের ওপর। পরিবেশ, মানুষ ও জলবায়ু অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে আন্তঃসম্পর্কযুক্ত। আমাদের কৃষির সঙ্গেও পরিবেশ, আবহাওয়া ও জলবায়ুর সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কৃষিক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। ফলে পরিবর্তিত পরিবেশে বদলে যাচ্ছে এ দেশের খাদ্য ও কৃষিব্যবস্থা। কৃষিতে সূর্যের আলো, তাপমাত্রা, বাতাসের আর্দ্রতার মৌসুমভিত্তিক পরিবর্তনের সঙ্গে ফসলের ধরন, জাত, চাষ পদ্ধতি, উৎপাদনশীলতা নির্ধারিত হয়ে থাকে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাতের সময় ও পরিমাণে তারতম্য ঘটছে এবং এর প্রভাব পড়ছে ফসলের উৎপাদনশীলতার ওপর। এ কারণে দেশে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং হুমকির মুখে পড়ছে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা। বাংলাদেশের কৃষি মূলত আবহাওয়া ও জলবায়ুর ওপর নির্ভরশীল। প্রকৃতিনির্ভর হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির মাত্রাও কৃষি খাতে সবচেয়ে বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অসম বৃষ্টিপাত, বন্যা, ভূমিক্ষয়, জলবায়ু, শুষ্ক মৌসুমে অনাবৃষ্টি, উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি, শীত মৌসুমে হঠাৎ শৈত্যপ্রবাহ, খরা, টর্নেডো, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাসের প্রভাবে প্রাদুর্ভাব ও মাত্রা বৃদ্ধি, আকস্মিক বন্যা ও এ দেশের কৃষিব্যবস্থাকে ক্রমাগত বিপর্যস্ত করে যা মানবকল্যাণ ও জনগোষ্ঠীর টেকসই জীবনযাত্রা এবং খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিরূপ পরিস্থিতির সঙ্গে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার সামঞ্জস্য বিধান করে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে কৃষিকে মুক্ত রাখা বা ঝুঁকি কমানো, দুর্যোগমুক্ত সময়ে শস্য বহুমুখীকরণ পুষিয়ে নেওয়া বিশেষভাবে বিবেচ্য। এ রকম পরিস্থিতিতে দেশের খাদ্য ও কৃষিব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন ও দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস বাস্তবায়ন করতে হলে প্রয়োজন বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত এবং তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন উপযোগী কলাকৌশল ও সার্বিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা প্রাকৃতিক ও মনুষ্য সৃষ্ট কারণ। প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে তাপমাত্রার হ্রাস-বৃদ্ধি, মহাসাগরে উত্তাপ শক্তির পরিবর্তন, সুমদ্র স্রোতের পরিবর্তন, আগ্নেয়গিরির দূষণ, লানিনো এবং এলনিনোর প্রভাব ইত্যাদি। মনুষ্য সৃষ্ট কারণগুলোর মধ্যে- শিল্প বিপ্লবের পর ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্ন থেকে জীবাশ্ম জ্বালানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন, কলকারখানা ও যানবাহনের ধোঁয়া, বন উজাড়, জৈবিক পচন, কৃষিক্ষেত্রে সার ও কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহারসহ বহুবিধ কারণে বায়ুম-লে বিভিন্ন প্রকার গ্যাস, বিশেষ করে কাবন ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড এবং গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় সূর্য থেকে আগত তাপ রশ্মিকে পুনরায় মহাকাশে প্রতিফলিত হওয়ার পথে বাধার সৃষ্টি করে। ফলে পৃথিবী ক্রমাগত উষ্ণ হচ্ছে। আইপিসির (ওহঃবৎ মড়াবৎহসবহঃধষ চধহবষ ড়হ ঈষরসধঃব ঈযধহমব) সমীক্ষা অনুযায়ী বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ তাপমাত্রা বৃদ্ধি। আইপিসির পঞ্চম সমীক্ষা অনুযায়ী, বিশ্ব তাপমাত্রা ১-২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির ফলে ফসল উৎপাদন, পানির প্রাপ্যতা, জীববৈচিত্র্য, তাপপ্রবাহ, অতিবৃষ্টি, উপকূলীয়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদির ওপর প্রভাব পড়েছে। ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা একবিংশ শতাব্দীর শেষে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করবে ও বিশ্ব পানি চক্রে অসমতা পরিলক্ষিত হবে।
আশঙ্কা করা হয়েছে যে, বাংলাদেশে ২০৩০ সাল নাগাদ গড় তাপমাত্রা ১.০ ডিগ্রি, ২০৫০ সালে ১.৪ ডিগ্রি এবং ২১০০ সালে ২.৪ ডিগ্রি বেড়ে যেতে পারে। সম্প্রতি দেশে উষ্ণ ও শৈত্যপ্রবাহের মাত্রা বেড়েছে। বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে শীতকালীন ব্যাপ্তি ও শীতের তীব্রতা দুই-ই কমে আসছে। বেশিরভাগ রবি ফসলেরই স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়ে ফসলের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া শীত মৌসুমে উষ্ণ প্রবাহ দেখা দিলে বেশি সংবেদনশীল ফসল যেমন গমের ফলন খুব কমে যায় এবং উৎপাদন অলাভজনক হয়। শৈত্যপ্রবাহের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কুয়াশাচ্ছন্ন থাকলে অনেক ফসল, বিশেষ করে গমের পরাগায়ন ও গর্ভধারণ (ফার্টিলাইজেশন) না হওয়ায় আংশিক বা সম্পূর্ণ ফসল চিটা হয়ে যায় এবং পোকামাকড়ের উপদ্রব বেড়ে যায়। এ ছাড়া প্রজাতি বৈচিত্র্য কমতে পারে ও প্রজননে ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
ধানের ফুল ফোটা বা পরাগায়নের সময় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার ওপরে গেলে চিটার সংখ্যা বেড়ে গিয়ে শীষে ধানের সংখ্যা কমে যেতে পারে। যা ধানের ফলনকে কমিয়ে দেবে। ধানের প্রজনন পর্যায়ে বাতাসের গড় তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে ধানগাছের অসহনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় ও অতিরিক্ত চিটা হয় এবং ফলনে মারাত্মক প্রভাব পড়ে।
এ কথা অবশ্য স্বীকার্য যে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তবে পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর কৌশল অবলম্বন করতে হবে। বৈরী জলবায়ুর (বন্যা, খরা, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা, অধিক তাপসহিষ্ণু) সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর মতো উচ্চফলনশীল ফসলের নতুন নতুন জাতের উদ্ভাবন ও ব্যবহার এবং এগুলোর চাষাবাদ বাড়াতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে আগাতে হবে। নতুন শস্য পর্যায় ও অভিযোজন কৌশলের ওপর ব্যাপক গবেষণা জোরদার করতে হবে। অভিযোজন কৌশল ও নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে সরকারের নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার সচেতনতা বাড়াতে হবে। লবণসহিষ্ণু, বন্যাসহিষ্ণু, খরাসহিষ্ণু, ঠা-া ও তাপসহিষ্ণু, আলোক সংবেদনশীল ধানসহ বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন করে ভবিষ্যৎ কৃষিকে টেকসই করার জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণ করা প্রয়োজন। পরিশেষে বলা যায়, দেশের প্রতিটি উপজেলায় জলবায়ুঝুঁকি মানচিত্র তৈরি করে কৃষি, খাদ্য ও অবকাঠামোসহ সবগুলো বিষয় নিয়ে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা, গবেষণার মাধ্যমে বৈরী জলবায়ুর সঙ্গে অভিযোজন ক্ষমতাসম্পন্ন কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও তার স্বতঃস্ফূর্ত বাস্তবায়ন ঘটানোর মাধ্যমে আমাদের ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।
ড. শফিকুর রহমান : পরিবেশ গবেষক