গ্যাস, সয়াবিন তেল, আটা, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, টমেটো, চিকেন, চায়ের কাপ, প্লাস্টিক কাপ থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি দ্রব্যের মূল্য সাম্প্রতিক সময়ে আড়াই গুণের বেশি বেড়েছে। নিউইয়র্ক থেকে ওয়াশিংটন ডিসি হয়ে টেক্সাস-ফ্লোরিডা-মিশিগান-ক্যালিফোর্নিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত সকল স্থানেই অকল্পনীয় হারে মূল্য বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জনমণে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। করোনা মহামারি থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার পরিক্রমায় এমন পরিস্থিতি তৈরী হওয়ায় স্বল্প এবং মাঝারি আয়ের মানুষেরা নিদারুণ কষ্টে নিপতিত হয়েছেন। আর যারা এখনও কাজে ফিরতে পারেননি, তারা বেকার ভাতা হারিয়ে নতুন মহামারিতে নিপতিত হয়েছেন।
এ বছরের জানুয়ারিতে গাড়ির গ্যাসের মূল্য ছিল প্রতি গ্যালনে দুই ডলার। ৬ অক্টোবর তা বেড়ে ৩.৪৯ ডলার হয়েছে। দাম কমার কোন লক্ষণ না দেখে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নিজেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এমন মূল্যবৃদ্ধিকে কোন যুক্তিতেই মেনে নেয়া যায় না মন্তব্য করে দু’সপ্তাহ আগে তিনি যথাযথ প্রক্রিয়ায় তদন্তের হুমকি দিয়েছেন। তবুও দাম কমেনি গ্যাসের। অধিকন্তু পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি এবং শ্রমিক সংকটের কারণে অনেক শিল্প এবং কৃষি খামারে উৎপাদন ব্যাহত হবার অজুহাত দাড় করিয়ে চাল, ডাল, আটা, ময়দা, চিনি, সয়াবিন তেল, রসুন, পেঁয়াজ, টমেটো, চিকেন ইত্যাদির দামও বেড়েছে আড়াই গুণের অধিক। প্রক্রিয়াজাত মুরগীর মাংস প্রতি পাউন্ড বিক্রি হয়েছে ১.৯৯ ডলার করে। এখন বেগে হয়েছে ২.২৯ ডলার। সয়াবিনের গ্যালন ছিল ১৯ ডলার, সেটি হয়েছে ৩৯ ডলার। ৫০ পাউন্ড ওজনের পেঁয়াজের বস্তা ছিল ১৬ ডলার, এখন হয়েছে ২৫ ডলার। ৫ পাউন্ডের রসুনের বস্তার দাম ছিল ১০ ডলার, এখন বিক্রি হচ্ছে ৩০ ডলার করে। ৯৯ সেন্ট ছিল রসুনের ৪/৫ কুয়ার দাম, এখন তা ২.৪৯ ডলারে উঠেছে। টমেটোর পাউন্ড ছিল ৯৯ সেন্ট করে। এখন তা ১.৪৯ ডলারে উঠেছে। ১.৪৯ ডলার ছিল এক পাউন্ড রসুনের দাম, তা বেড়ে ৩.৪৯ ডলার হয়েছে। চিকেন উইঙ্গসের ৪০ পাউন্ড বস্তার দাম ছিল ৯০ ডলার। তা বেড়ে ১৫০ ডলার হয়েছে। থাই চিকেনের দাম ছিল ২৫ ডলার করে। এখন বেড়ে ৬২ ডলার হয়েছে। চিকেনের রানের দাম ছিল ২৫ ডলার, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৩৫ ডলার করে। এভাবে নিত্য ব্যবহার্য প্রায় প্রতিটি পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে পাইকারি বিক্রেতারা। এদিকে, মূল্যবৃদ্ধির সাথে সঙ্গতি রেখে কোন কোন রেস্টুরেন্টে এক কাপ চায়ের দাম এক ডলার থেকে বাড়িয়ে দুই ডলার করা হয়েছে।
নিউইয়র্ক সিটির জ্যাকসন হাইটসের ‘কথা গ্রীল এ্যান্ড কাবাব’ রেস্টুরেন্টের মালিক রামকৃষ্ণ সাহা বুধবার সন্ধ্যায় উদ্ভূত পরিস্থিতির আলোকপাতকালে এ সংবাদদাতাকে বলেন, আমাদের পীঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তবুও কোন খাবারের দামই বাড়াইনি কমিউনিটির লোকজনের কথা বিবেচনা করে। এরফলে লাভের পরিমাণ একেবারেই কমে গেছে। শুধু বাড়িয়েছি এক ডলারের চা দেড় ডলারে। অন্য সবকিছু ঠিক আছে।
রামকৃষ্ণ সাহা জানালেন, আমরা যে স্টোর থেকে পাইকারি মূল্যে পণ্য ক্রয় করি সেখানে সাইনবোর্ডে লেখা হয়েছে যে, প্রতিটি পণ্যের মূল্য ৮% থেকে ৩৫% বেড়েছে। বৃদ্ধির হার উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বললেন, ২৫০০ প্লাস্টিক কাপের মূল্য ছিল ৩৮ ডলার, এখন হয়েছে ৬৫ ডলার। এক হাজার কাপের মূল্য ১২ ডলার থেকে বাড়িয়ে ২২.৫০ ডলার করা হয়েছে। চা পানের এক হাজার কাপের মূল্য ২৫ ডলার থেকে বাড়িয়ে ৪২ ডলার করা হয়েছে। চায়ের কাপের ক্যাপ ১০০০টির মূল্য ছিল ১৬ ডলার, বাড়িয়ে ২৩ ডলার করা হয়েছে। লাচ্ছির এক হাজার কাপের দাম ৪০ ডলার থেকে ৯৬ ডলার হয়েছে। ২৫ পাউন্ডের ময়দার বস্তা ছিল ৬.৫০ ডলার। এখন হয়েছে ১০ ডলার। ৫০ পাউন্ডের চিনির বস্তার দাম ২২ ডলার থেকে বাড়িয়ে ৩২ ডলার করা হয়েছে।
জ্যাকসন হাইটস বিজনেস এসোসিয়েশনের নেতা মোহাম্মদ কামরুজ্জামান কামরুল এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করলেন, বাংলাদেশ, বার্মা, চিন, থাইল্যান্ড, সেন্ট্রাল আমেরিকার বিভিন্ন দেশ থেকে কন্টেইনার ভরে আমদানী করা হয় বিভিন্ন পণ্য। সেই কন্টেইনারের ভাড়া আগে ছিল ৪ হাজার ডলার করে। এখন ২৬ হাজার ডলার হয়েছে। একইভাবে মাছসহ বিভিন্ন খাদ্য-শস্যের মূল্যও বাড়িয়ে দিয়েছেন উৎপাদন কেন্দ্রেই। উৎপাদনে ঘাটতি হচ্ছে শ্রমিকের অভাবে। আর এটি শুরু হয়েছে করোনায় লকডাউনে যাবার পর। এখন অনেক দেশেই করোনা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও পুরোদমে উৎপাদন শুরু করা সম্ভব হয়নি।
জ্যাকসন হাইটসে কেনাকাটা করার সময় ক্ষুব্ধচিত্তে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল বাশার চুন্নু এ সংবাদদাতাকে বললেন, রোজগার কমেছে। অথচ সবকিছু ক্রয় করতে হচ্ছে দ্বিগুণেরও অধিক দামে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সবকিছু ফ্যাকাশে হয়ে পড়েছে। করোনার ক্ষত কাটবে কীভাবে?
খাদ্য-সংকট এবং মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি নিয়ে গবেষণারতরা উল্লেখ করেছেন, নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য-শস্য’র দাম বেড়েছে চাহিদার পরিপূরক সরবরাহ না থাকায়। এর খেসারত দিতে হচ্ছে ভোক্তাদেরকে। উৎপাদন ও পরিবহন খরচ পুষিয়ে নিতে পাইকারদের কাছে অধিক মূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে। পাইকাররাও আরেক ধাপ বাড়িয়ে নিজেদের খরচ পুষিয়ে নিচ্ছেন। অবশেষে খুচরা বাজার তথা গ্রোসারি সমূহে আকাশচুম্বি হয়েছে সবকিছুর দাম। এমন অবস্থার আলোকে বড় বড় চেইন স্টোরসমূহে সাইন লাগিয়ে মূল্যবৃদ্ধিও ঘটনাকে জায়েজ করার কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। বাজার-পণ্য ইত্যাদি নিয়ে গবেষণারতরা বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং ফ্যাঞ্চে অত্যধিক তাপপ্রবাহ চলায় গম উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটেছে। একইভাবে ব্রাজিলেও সয়াবিন উৎপাদনে মারাত্মক সংকট দেখা দেয়। অতিবর্ষণের ফলে আর্জেন্টিনায়ও সয়াবিনের চাষ করা সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ করোনা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে জনজীবনে। এ অবস্থার ফায়দা নিচ্ছে চীন। নিজেরা যেমন অতিরিক্ত খাদ্য-শস্য উৎপাদন করেছে, একইসাথে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকেও বিপুল পরিমাণের শস্য আমদানী করেছে। তারা এখন সেগুলো অধিক দামে যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নতবিশ্বে রপ্তানী করছে।